উপকূলজুড়ে রিমালের ক্ষত ১০ জনের প্রাণহানি

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ ঘূর্ণিঝড় রিমাল চলে গেলেও উপকূলজুড়ে রেখে গেছে ক্ষতচিহ্ন। কেড়ে নিয়েছে ১০ জনের প্রাণ। ভেঙে গেছে প্রায় ৩৫ সহস্রাধিক ঘর-বাড়ি। ভাসিয়ে নিয়ে গেছে কয়েকশ ঘের-পুকুরের মাছ। জোয়ারের পানিতে বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত করেছে উপকূলীয় জনপদ। অসংখ্য গাছপালা ও খাম্বা উপড়ে পড়ে রোববার সকাল ৯টা থেকে গতকাল এ সংবাদ লেখা পর্যন্ত বিদ্যুৎহীন হয়ে আছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক এলাকা। ক্ষতির মুখে পড়েছে উপকূল ও আশপাশের ১৯ জেলা। এগুলো হলো সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরগুনা, ভোলা, ফেনী, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নড়াইল, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর ও যশোর।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মহিববুর রহমান গতকাল সোমবার বিকেলে সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, এখন পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে খুলনা, সাতক্ষীরা, বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা ও চট্টগ্রামে ১০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে খুলনায় এক, সাতক্ষীরায় এক, বরিশালে তিন, পটুয়াখালীতে এক, ভোলায় তিন, চট্টগ্রামে একজনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। ঘর, গাছ ও দেয়াল চাপা এবং পানিতে ডুবে তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে ব্রিফিংয়ে জানানো হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় রিমাল রোববার রাত আটটার দিকে মোংলার দক্ষিণ-পশ্চিম দিক দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ উপকূল ও বাংলাদেশের খেপুপাড়া উপকূল অতিক্রম শুরু করে। এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী, বরগুনাসহ উপকূলের বিভিন্ন জেলায় ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যায়। রাত দেড়টা থেকে দুইটার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১১১ কিলোমিটার গতিতে বাতাস বয়ে গেছে পটুয়াখালীর খেপুপাড়ায়। এই ঝড়ের প্রভাবে জলোচ্ছ্বাসে উপকূলের অনেক এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ভেসে গেছে বহু মাছের ঘের।
সংবাদ সম্মেলনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মহিববুর রহমান বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে ১৯ জেলার ১০৭টি উপজেলার বাসিন্দারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এসব এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৩৭ লাখ ৫৮ হাজারের বেশি। সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে ৩৫ হাজার ৪৮৩টি ঘরবাড়ি। এ ছাড়া আংশিকভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে ১ লাখ ১৪ হাজার ৯৯২টি ঘরবাড়ি।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ইতিমধ্যে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার জন্য ৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৫টি জেলায় নগদ সহায়তার ৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা, ৫ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন চাল, ৫ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, শিশুখাদ্য কেনার জন্য ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা, গোখাদ্য কেনার জন্য ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে।
প্রতিমন্ত্রী মহিববুর রহমান জানান, ঘূর্ণিঝড় সতর্কতার পরিপ্রেক্ষিতে উপকূলীয় এলাকাগুলোতে ৯ হাজার ৪২৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্র ও স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৮ লাখের বেশি মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। গরু, মহিষ, ছাগল-ভেড়াসহ আশ্রিত পশুর সংখ্যা ৫২ হাজার ১৪৬। এ ছাড়া দুর্গত মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিতে ১ হাজার ৪৭১টি মেডিকেল দল গঠন করা হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় রিমাল কয়রা থেকে উত্তর দিকে অগ্রসর ও দুর্বল হয়ে গতকাল রাত পর্যন্ত গভীর স্থল নি¤œচাপ হিসাবে যশোর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করে। এটি আরো উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে ক্রমশ বৃষ্টিপাত ঝরিয়ে স্থল নি¤œচাপে পরিণত হবে বলে গতকাল সকাল ১০টায় আবহাওয়াবিদ মো: বজলুর রশিদ স্বাক্ষরিত আবহাওয়ার বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, পায়রা ও মোংলা সমুদ্রবন্দরকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত নামিয়ে তার পরিবর্তে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরকে ৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেত নামিয়ে তার পরিবর্তে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় রেমালের অগ্রভাগ আঘাত হানা শুরু করে রোববার সন্ধ্যা থেকে। তখন আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছিল মধ্যরাত নাগাদ এটি উপকূল ও স্থলভাগ অতিক্রম করবে।
অনেকেই ভেবেছিল মধ্যরাতের মধ্যে ঝড় থেমে যাবে। কিন্তু মধ্যরাতের পরই শুরু হয় মূল ঝড়।
ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৬৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ তখন ছিল ৯০ কিলোমিটার; যা দমকা বা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ছিল। খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার বেশিরভাগ রাস্তায় ভেঙে পড়ে বড় বড় গাছ। গাছের সাথে অনেক জায়গায় বিদ্যুতের খুটি ভেঙ্গে পড়েছে রাস্তায়।
এদিকে রোববার সন্ধ্যার পর ঘূর্ণিঝড়ের অগ্রভাগ যখন উপকূলে আঘাত হানতে শুরু করে তখন সে সব এলাকার সমুদ্র ও নদীতে ভাটা চলছিল। যে কারণে ঝড়ের সাথে খুব জলোচ্ছ্বাস তৈরি হয়নি।
নির্ধারিত সময় অনুযায়ী রোববার রাত ৯টা ৪০ মিনিটে শুরু হয় জোয়ার। নদী খালে আস্তে আস্তে বাড়তে শুরু করে পানি। রাত ২টা নাগাদ ঝোড়ো বাতাসের সাথে পূর্ণ জোয়ারের একে একে প্লাবিত হতে থাকে নদী ও তীর ও আশপাশের এলাকা। মধ্যরাতে স্বাভাবিকের চেয়ে সাত-আট ফুট বেশি উচ্চতার জোয়ারের চাপে খুলনার কয়রা, সাতক্ষীরা, বরগুনাসহ কয়েক জেলায় বেড়িবাঁধে ভাঙন দেখা যায়। উপকূলীয় নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকে প্লাবিত হয়েছে শত শত গ্রাম। সাতক্ষীরার শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়নের মুল বাঁধটি অক্ষত থাকলেও টেকসই বেড়িবাঁধ রক্ষায় নির্মিত রিং বাঁধটি ভেঙে গেছে।
ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে দেশের উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় এক কোটি ৫৫ লাখ গ্রাহকের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিল গতকাল। ঝড়ের তান্ডবের মধ্যে ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে এসব গ্রাহকের সরবরাহ বন্ধ রাখেছে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। অনেক স্থানে বিদ্যুৎবিহীন পরিস্থিতি ১৫-১৬ ঘন্টা অতিক্রম করে।
বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) পরিচালক (কারিগরি) মো. রফিকুল ইসলাম সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে দুর্ঘটনা এড়াতে সোমবার বেলা ১২টা পর্যন্ত পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির এক কোটি ৫৫ লাখ গ্রাহকের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। ঝড় কমে যাওয়ার পর দ্রুত বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক করে দিতে আমাদের কর্মীরা প্রস্তুত। তবে ঘূণিঝড়ের প্রভাবে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার প্রকৃত চিত্র এখনো জানা যায়নি।
বাগেরহাট সংবাদদাতা জানান, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ভারী নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়ে বাগেরহাটের উপকূলীয় উপজেলা মোরেলগঞ্জ, শরণখোলা, মোংলা ও রামপালে তান্ডব চালিয়েছে ‘রিমাল’। প্রায় সাত ঘণ্টা ধরে তান্ডব চালায় ঘূর্ণিঝড় রিমাল। এতে নিম্নাঞ্চল তলিয়ে মাছ ও কৃষির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বিধ্বস্ত হয়েছে কাঁচাঘর।
বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন চার লাখেরও বেশি মানুষ। রাস্তাঘাট প্লাবিত হয়ে যোগাযোগব্যবস্থা প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
বাগেরহাট পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মহাব্যবস্থাপক সুশান্ত রায় বলেন, জেলায় চার লাখ ৮৫ হাজারের বেশি গ্রাহক রয়েছেন। ঝড়ের প্রভাবে পল্লী বিদ্যুতের মূল সঞ্চালন লাইনের বিভিন্ন স্থানে গাছপালা উপড়ে পড়ায় বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দুর্যোগ শেষ হলে লাইনে কাজ করে বিদ্যুৎ সংযোগ পুনরায় চালু করা হবে।
মোরেলগঞ্জ উপজেলার পশুর বুনিয়া সাইক্লোন সেল্টারে আশ্রয় নেওয়া মোবারক হোসেন বলেন, ‘সিডর ও আইলার মতো ঘূর্ণিঝড় দেখেছি কিন্তু জলোচ্ছ্বাস এত দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। আশ্রয়কেন্দ্রের বাইরে পানি থৈ থৈ করছে। কোনটা রাস্তা, কোনটা পুকুর-বিল কিছুই বোঝার উপায় নেই।’
সন্ন্যাসী বাজারের সাইক্লোন সেল্টারে আশ্রয় নেওয়া দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘জলোচ্ছ্বাসের পানি যদি না নামে গবাদিপশু বাঁচানো যাবে না। মাছ আর কৃষিতো শেষ হয়ে গেছে।’
এ বিষয়ে মোরেলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম তারেক সুলতান বলেন, দুর্যোগ মোকাবিলায় একাধিক মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। ৫১টি কমিউনিটি ক্লিনিক চালু রাখা হয়েছে। তবে পানি না কমলে দুর্ভোগ আরও বাড়বে