ভারতীয় পণ্য ট্রান্সশিপমেন্ট: সড়ক ব্যবহারসহ আট খাতে চার্জ আরোপ

0

লোকসমাজ ডেস্ক ॥ চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে ভারতীয় পণ্য ট্রান্সশিপমেন্টের ওপর সড়ক ব্যবহারসহ মোট আটটি খাতে চার্জ ও ফি আরোপের দিকে এগোচ্ছে বাংলাদেশ। সড়ক ব্যবহার ছাড়া বাকি চার্জ ও ফি প্রশাসনিক কার্যক্রম সংক্রান্ত। পণ্য পরিবহন কার্যক্রমে প্রশাসনিকভাবে যেসব সহায়তা দেয়া হবে তার বিনিময়ে ওইসব ফি ও চার্জ আদায় করা হবে। যদিও কয়েকটি খাতে চার্জ ও ফি’র পরিমাণ নিয়ে ভারতের তুমুল আপত্তি রয়েছে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ইন্টার-গভর্নমেন্টাল কমিটির বৈঠকে এসব চার্জ ও ফি আরোপ নিয়ে আলোচনা হয়। ওই বৈঠকের আলোচনা ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সম্প্রতি সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোয় বৈঠকের কার্যবিবরণী পাঠানো হয়েছে। কার্যবিবরণীতে প্রস্তাবিত চার্জ ও ফি এবং ভারতের আপত্তির বিষয়গুলো উল্লেখ রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এসব তথ্য জানিয়েছে। চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় পণ্য সরবরাহ সম্পর্কিত একটি চুক্তি ২০১৮ সালে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়। সেই চুক্তি অনুযায়ী পণ্য পরিবহন সম্পর্কিত চার্জ ও ফি নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, নৌ-প্রটোকল চুক্তির তুলনায় চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারে প্রস্তাবিত চার্জ ও ফি কিছুটা বেশি প্রস্তাব করা হয়েছে। বাস্তবতার নিরিখেই এসব ফি আরোপের জন্য বলা হয়েছে। ডব্লিউটিও ও গ্যাট অনুযায়ী পণ্য ট্রান্সশিপমেন্টের ওপর বাড়তি ফি ধরা হয়নি। শুধু প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এসব ফি ও চার্জ ধরা হচ্ছে। তারা আরও জানান, পণ্য ট্রান্সশিপমেন্টের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যে শ্রম ও খরচ হবে তার তুলনায় ফি বেশি ধরা হচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ৪ ও ৫ ডিসেম্বর ঢাকায় বাংলাদেশ ও ভারতের সচিব পর্যায়ে দু’দিনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুস সামাদ বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের এবং ভারতের নৌ মন্ত্রণালয়ের সচিব গোপাল কৃঞ্চ ভারতের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন। ওই বৈঠকে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে ভারতের এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে পণ্য ট্রান্সশিপমেন্টের ফি ও চার্জ নির্ধারণ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। সেখানে বাংলাদেশ মোট আটটি খাতে চার্জ ও ফি আরোপের প্রস্তাব করে। সেগুলো হচ্ছে : চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর থেকে সড়কপথে যেসব স্থলবন্দর থেকে পণ্য ভারতের আরেক রাজ্যে যাবে সেসব সড়ক ব্যবহারের জন্য প্রতি কিলোমিটার ২ দশমিক ১০ টাকা/টন হারে ফি আরোপ হবে।
এ ছাড়া বন্দরে প্রতি টনে ডকুমেন্ট প্রসেসিং ফি ১০ টাকা, ট্রান্সশিপমেন্ট ফি ২০ টাকা, সিকিউরিটি চার্জ ১০০ টাকা, এসকর্ট চার্জ (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) ৫০ টাকা ও অন্যান্য প্রশাসনিক চার্জ ১০০ টাকা আরোপের কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া বন্দরে প্রতিটি কনটেইনার স্ক্যানিংয়ের চার্জ ২৫৪ টাকা এবং ভারতীয় পণ্যবাহী গাড়িতে যে ইলেকট্রনিক সিল ও লক লাগানো হবে তার চার্জ হিসেবে প্রথম ৪৮ ঘণ্টার জন্য ৬০০ টাকা আরোপের প্রস্তাব করা হয়। ৪৮ ঘণ্টা অতিক্রম করলে বাড়তি প্রতি ঘণ্টার জন্য ৫০ টাকা হারে চার্জ আরোপ হবে। চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, চুক্তি অনুযায়ী ভারতীয় পণ্যবাহী জাহাজ এই দুই বন্দরে অগ্রাধিকার পাবে। আমাদের দেশীয় পণ্য আমদানি-রফতানির জাহাজ বন্দরে যেসব হারে চার্জ ও ফি দিয়ে থাকে, ভারতীয় পণ্যবাহী জাহাজের ক্ষেত্রেও একই ফি আদায় হবে। এর সঙ্গে ট্রান্সশিপমেন্ট সংক্রান্ত যেসব সেবা দেয়া হবে, সে সংক্রান্ত চার্জ ও ফি আদায় করবে বাংলাদেশ।
বিআইডব্লিউটিএ সূত্র জানিয়েছে, নৌ-প্রটোকল চুক্তির আওতায় ২০১৬ সাল থেকে অভ্যন্তরীণ নৌবন্দর ও রুট ব্যবহার করে পণ্য ট্রান্সশিপমেন্ট করে আসছে ভারত। ওই চুক্তির আওতায় জাহাজে ভারতীয় পণ্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ বন্দরে এসে সড়ক পথে আখাউড়া হয়ে দেশটির পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় যাচ্ছে। সেখানেও বিভিন্ন ধরনের ফি আদায় করা হচ্ছে। প্রতি টনে ১৯২ টাকা ২২ পয়সা ফি দিচ্ছে ভারত। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড চার্জ হিসেবে ১৩০ টাকা, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) ১০ টাকা এবং সড়ক চার্জ ৫২ টাকা ২২ পয়সা আদায় করছে। পণ্য পরিবহনে নিরাপত্তা (এসকর্ট) দেয়া হলে প্রতি টনে অতিরিক্ত ৫০ টাকা চার্জ পরিশোধ করার বিধান রয়েছে। নৌ-প্রটোকল চুক্তির তুলনায় চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার ফি কিছুটা বেশি ধরা হয়েছে।
সড়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ভারতীয় ট্রান্সশিপমেন্ট পণ্য কোন কোন রুটে চলবে, ফি কত হতে পারে- এর একটি ধারণাপত্র তৈরি করেছেন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এতে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লার বিবিরবাজার স্থলবন্দর পর্যন্ত পথের জন্য ১৫ টনের একটি ট্রাককে ১৫ হাজার টাকা ফি দিতে হবে ভারতকে। এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুস সামাদের মোবাইল নম্বরে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু রিসিভ না করার তার বক্তব্য জানা যায়নি। কয়েকটি চার্জ ও ফি নিয়ে তুমুল আপত্তি ভারতের : প্রস্তাবিত আট ধরনের চার্জ ও ফি’র মধ্যে কয়েকটি খাত নিয়ে তুমুল আপত্তি রয়েছে ভারতের। বৈঠকে প্রতি টন পণ্যের সিকিউরিটি চার্জ ১০০ টাকা ও প্রশাসনিক চার্জ প্রতি টনে ১০০ টাকা আরোপে আপত্তি জানিয়েছে দেশটি। তারা প্রস্তাবিত চার্জ অর্ধেকে নামিয়ে আনতে বাংলাদেশকে অনুরোধ জানিয়েছে। এর যৌক্তিকতায় ভারতের প্রতিনিধিরা বলেছেন, নৌ-প্রটোকল চুক্তির আওতায় যেসব গাড়ি ভারতের ভেতরে প্রবেশ করে সেগুলোয় সিকিউরিটি চার্জ ও প্রশাসনিক চার্জ ধরা হয় না। এমনকি বাংলাদেশের যেসব ট্রাক ভারতের স্থলবন্দরগুলোয় যাতায়াত করে সেগুলোয় এসব চার্জ নেই। যদিও পাল্টা যুক্তিতে বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলেছেন, নৌ-প্রটোকল চুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই সিকিউরিটি চার্জ ধরা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতি টনে ১০ টাকা হারে ডকুমেন্ট প্রসেসিং ফি আরোপ নিয়ে আপত্তি রয়েছে ভারতের। দেশটি প্রতি টনে নয়, প্রতি ট্রিপ হিসাবে এ ফি নেয়ার প্রস্তাব করেছে।
বৈঠকে তিন সিদ্ধান্ত : আন্তঃসরকার বৈঠকে তিনটি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- রাজস্ব বোর্ড, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর সঙ্গে আলাপ করে প্রস্তাবিত চার্জ ও ফি’র হারে পরিবর্তন এনে তা ভারতের কাছে পাঠানো হবে। ফেব্র“য়ারির মধ্যে দুটি ট্রায়াল রান পরিচালনা করা হবে। তৃতীয়ত: ওই ট্রায়াল রানে কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান সমন্বয়কারী হবেন।