ভারতের অর্থনীতির অধঃপতন যেভাবে হলো

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ চলতি বছরে দীপ্তি হারিয়েছে ভারতের অর্থনীতি। বছরব্যাপী চলা শ্লথগতি ও ঋণ সংকটের কারণে চাঙ্গা প্রবৃদ্ধির দেশ থেকে আর্থিক অস্থিরতার দেশে পরিণত হয়েছে ভারত। বিশ্বের খুব কম অর্থনীতিই এ রকম উল্টো রথ দেখেছে।
চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ, যা ২০১৮ সালের প্রথম প্রান্তিকের প্রায় অর্ধেক। ভোক্তা আস্থা ২০১৪ সালের পর সর্বনিম্নে দাঁড়িয়েছে। প্রায় ১৩৪ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশটির জন্য গুরুত্বপূর্ণ শ্রমবাজার খুব অস্থির। বেকারত্ব হার ৬ দশমিক ১০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা ৪৫ বছরের সর্বোচ্চে।
গত বছর বিশ্বের প্রধান অর্থনীতিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দ্রুত সম্প্রসারমাণ ছিল ভারত। গত দশকে প্রায় সব পূর্বাভাসে বলা হচ্ছিল যে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সঙ্গে বৈশ্বিক বাণিজ্যের বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ থাকবে ভারতের হাতে। কিন্তু সর্বশেষ প্রান্তিকে ভারতের চেয়ে চাঙ্গা প্রবৃদ্ধি ছিল ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়ার। মালয়েশিয়া ভারতের ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যবিরোধে শ্লথগতিতে থাকলেও চীনের ৬ শতাংশ সম্মানজনক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে এবং ৭ দশমিক ৩০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে অনেক এগিয়ে আছে ভিয়েতনাম।
ভারতের অর্থনীতিতে দুঃসময়ের পেছনে বড় ভূমিকা পালন করেছে এর নড়বড়ে আর্থিক ব্যবস্থা। ভারতীয় ব্যাংকগুলো কুঋণে ধুঁকছে, যা বিশ্বের সর্বোচ্চে দাঁড়িয়েছে। প্রথাগত ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো ছায়া ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ঋণের বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। তবে তাদেরও দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। এ রকম আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড গত বছর দেউলিয়া ঘোষিত হয়েছে। যদিও সরকার কোম্পানিটির দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। তবে তাদের কার্যক্রম শুরু হলো মাত্র। গত মাসে মর্টগেজ খাতে বড় প্রতিষ্ঠান দেওয়ান হাউজিং ফিন্যান্সের পরিচালনা পর্ষদ অপসারণ করে তাদেরকেও দেউলিয়ার জন্য আদালতে উপস্থাপন করেছে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কার্যক্রমের রাশ টেনে ধরছে।
রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার (আরবিআই) জন্য সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, এক বছরে পাঁচবার সুদহার কর্তন করলেও অর্থনীতিতে গতি ফেরাতে পারেনি। আগেভাগে বেশ আগ্রাসী নীতি গ্রহণ করলেও আরবিআইয়ের শিথিল মুদ্রানীতির সুবিধা প্রকৃত অর্থনীতিতে সমভাবে পড়েনি। কঠিন সময়ে সাধারণত আরবিআই কঠোর হস্তে লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা করে। কিন্তু চলতি বছর বেশ কয়েকবার বিনিয়োগকারীদের অবাক করেছে আরবিআই। গত আগস্টে অর্থনীতিবিদদের প্রত্যাশিত সুদহার ২৫ বেসিস পয়েন্ট না কমিয়ে ৩৫ বেসিস পয়েন্ট কমানোর ঘোষণা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যা দূরদর্শিতার চেয়ে ছেলেমানুষি মনোভাবের প্রকাশ বলে মনে করছেন অনেকে। চলতি মাসে যেখানে সুদহার কর্তন অনিবার্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছিল, তখন সে সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটার ঘোষণা দেন আরবিআইয়ের কর্তাব্যক্তিরা।
তারপর প্রশ্ন উঠেছে বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারের অনির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান নিয়ে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাবেক এক সহকারী একটি গবেষণা প্রবন্ধে দাবি করেন, কয়েক বছর ধরে ভারতের প্রবৃদ্ধি গত প্রান্তিকের ৪ দশমিক ৫০ শতাংশের আশপাশেই ছিল।
চীনের উত্থানের সঙ্গে ভারতের তুলনা করলে নয়াদিল্লির অনুরাগীরা কিছুটা ক্ষিপ্ত হন। কারণ তারা মনে করেন, ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ, যার শক্তিশালী ফেডারেল ব্যবস্থা ও একটি স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা রয়েছে। এটাকে আবার প্রতিবন্ধকতা হিসেবেও দেখছেন অনেকে। এক পার্টি শাসিত চীনে দেং শিয়াওপিং যে বিশাল সংস্কারকাজ শুরু করেছিলেন এবং তার মাধ্যমে মূল ভূখণ্ড চীনকে রফতানি ও ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের শক্তিঘরে পরিণত করেছিলেন, ফেডারেল ভারতের পক্ষে একই পথ অনুসরণ করা খুব কঠিন। খারাপ সময়ে চীনের সঙ্গে তুলনায় ক্ষিপ্ত হলেও সুসময়ে অবশ্য চীনের সঙ্গে তুলনায় সুখবোধ করেন ভারতীয় নেতারা। সূত্র: ব্লুমবার্গ