পাকিস্তান সংবিধানের বিতর্কিত সংশোধনী পাস, ক্ষমতা আরও বাড়লো সেনাপ্রধানের

0

লোকসমাজ ডেস্ক ॥ পাকিস্তানের পার্লামেন্ট দেশটির সংবিধানের বিতর্কিত ২৭তম সংশোধনী পাস করেছে। সমালোচকদের মতে, এই সংশোধনী দেশটির সেনাপ্রধানের ক্ষমতা আরও বাড়াবে এবং তাকে আজীবন আইনি দায়মুক্তি দেবে, পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্টের স্বাধীনতাও সীমিত করবে। সমালোচকেরা একে ‘গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেক’ বলে বর্ণনা করেছেন।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্থানীয় সময় বুধবার (১২ নভেম্বর) রাতে পাকিস্তানের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি তথা জাতীয় পরিষদে বিলটি পাস হয়। পাকিস্তানের ক্ষমতাধর সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির-যিনি দেশটির ডি-ফ্যাক্টো শাসক হিসেবে পরিচিত-এই ২৭তম সংশোধনীর প্রধান উপকারভোগী।

বিলটি এখন সামান্য পরিবর্তনের জন্য সিনেটে ফেরত পাঠানো হবে, যেখানে উচ্চকক্ষ সোমবার (১০ নভেম্বর) এটি অনুমোদন করেছিল। এরপর প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারি এতে স্বাক্ষর করলে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে সংবিধানের অংশ হয়ে যাবে। এই সংশোধনীর অধীনে এ বছর শুরুর দিকে পাঁচ তারকাবিশিষ্ট জেনারেল হিসেবে মনোনীত হওয়া সেনাপ্রধান আসিম মুনির অভূতপূর্ব ক্ষমতা অর্জন করবেন।

মুনিরকে ‘চিফ অব ডিফেন্স ফোর্সেস’ নামে নতুন একটি পদে উন্নীত করা হবে, যার ফলে তিনি কেবল সেনাবাহিনী নয়, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীরও প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। পাশাপাশি তাকে আজীবন ফৌজদারি বিচারের হাত থেকে দায়মুক্তি দেওয়া হবে।

জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাডজাঙ্কট অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ও সামরিক রাজনীতি বিশ্লেষক আকিল শাহ বলেছেন, মুনির সাংবিধানিকভাবে অভূতপূর্ব এক সুরক্ষিত পদ সৃষ্টির মাধ্যমে নিজে ও ভবিষ্যতের সেনাপ্রধানদের ক্ষমতায় স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তার মতে, এই দায়মুক্তি নাগরিক কর্তৃত্বের নীতিকে উপহাসে পরিণত করেছে।

এই সংশোধনী সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা ও কার্যপরিধিও ব্যাপকভাবে খর্ব করেছে। সংশোধনী অনুযায়ী, সুপ্রিম কোর্টের ঊর্ধ্বে একটি নতুন ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত গঠন করা হবে, যার বিচারপতিদের মনোনয়ন দেবে নির্বাহী বিভাগ।

সমালোচকেরা বলছেন, এতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অবশিষ্ট প্রতীকটিও ভেঙে পড়বে। বিচারপতিদের বদলি বা স্থানান্তর সংক্রান্ত সিদ্ধান্তও এখন থেকে এককভাবে প্রেসিডেন্টের হাতে থাকবে, ফলে বিচার বিভাগে জবাবদিহির ধারণা পুরোপুরি বিলুপ্ত হবে।

সাংবিধানিক আইনজীবী সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, এই সংশোধনী পাকিস্তানের বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ধারণাটিকেই ধ্বংস করে দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, এর মাধ্যমে দেশটি কার্যত আজীবন একনায়কতন্ত্রের পথে হাঁটছে। বিরোধীরা বলছেন, এই আইন সামরিক শাসনকে সংবিধানে স্থায়ী রূপ দিচ্ছে।

২০২২ সালে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার পর আসিম মুনির আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কার্যত রাষ্ট্রপ্রধানের মতো সফর করেছেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন। সরকারি জোটের নেতা প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ এবং তার মন্ত্রিসভার সদস্যরা এই সংশোধনীকে ‘ন্যায়বিচার ও সেনাবাহিনীর আধুনিকীকরণ ও দক্ষতা বৃদ্ধি’র উদ্যোগ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন।

অতীতে যেখানে সংবিধান পরিবর্তনের প্রস্তাব নিয়ে সপ্তাহজুড়ে বিতর্ক হতো, সেখানে এবার তা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দুই কক্ষেই পাস হয়ে যায়। বুধবার কেবল চারজন সংসদ সদস্য বিলটির বিরোধিতা করেন।

পাকিস্তানের বৃহত্তম বিরোধী দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) এই ভোট বর্জন করেছে। দলের নেতা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে কারাগারে আছেন। বহুদলীয় বিরোধী জোট তেহরিক-ই-তাহাফুজ-ই-আইন-ই-পাকিস্তান (টিটিএপি) অভিযোগ করেছে যে, সরকার সংবিধানের ভিত্তি নড়িয়ে দিয়েছে। শতাধিক আইনজীবী ও অধিকারকর্মী এই প্রক্রিয়াকে সংবিধান বিকৃতি বলে আখ্যা দিয়েছেন।