এলজিইডির ভুলে অসমাপ্ত ৮ সেতু নিয়ে দুর্ভোগে যশোরের লক্ষাধিক মানুষ

0

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ভৈরব নদের বুক চিরে সারি সারি বাঁশ পুঁতে তাতে দড়ি টানানো হয়েছে। সেই দড়ি ধরে ধীরে ধীরে চলছে ছোট নৌকা। আধুনিক যন্ত্রপাতির এই যুগেও এমন প্রাচীন পদ্ধতিতে প্রতিদিন নদী পার হচ্ছেন যশোর সদর উপজেলার কচুয়া ও বাঘারপাড়ার ছাতিয়ানতলা ইউনিয়নের কয়েক হাজার মানুষ।

কারণ, নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণ শুরু হয়েছিল ২০২২ সালে, কিন্তু মাঝপথে তা বন্ধ হয়ে যায়। একই অবস্থা জেলার আরও সাতটি সেতুর। প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে থেমে আছে এসব সেতুর নির্মাণকাজ। বন্ধ হয়ে আছে উন্নয়ন, ব্যাহত হচ্ছে মানুষের যাতায়াত ও দৈনন্দিন জীবনযাত্রা।

২০২২ সালে পুরনো সেতুটি ভেঙে পড়ার পর স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা ব্যয়ে কচুয়া-ছাতিয়ানতলা সংযোগ সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করে। কিন্তু বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডবি¬উটিএ) অনুমোদন না নিয়েই এবং প্রয়োজনীয় উচ্চতা নির্ধারণ ছাড়াই কাজ শুরু হয়।

এ ঘটনায় ‘ভৈরব নদ সংস্কার আন্দোলন’ নামের একটি পরিবেশবাদী সংগঠন আদালতে রিট করলে উচ্চ আদালতের নির্দেশে নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে যায়। তখন সেতুর প্রায় ৬০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছিল।

এলাকাবাসীর দুর্ভোগ এখানেই শেষ নয়। যশোর জেলার আরও চারটি নদীর ওপর নির্মাণাধীন আটটি সেতুরও প্রায় একই অবস্থা। দায়তলা, রাজারহাট হামিদপুর, ছাতিয়ানতলা, নাভারণ ঘোড়পাড়া (দুটি), মনিরামপুর-নেহালপুর এবং মুক্তেশ্বরী নদীর ওপর দুটি সেতু সবগুলোই বিআইডবি¬উটিএর অনুমোদন ছাড়া কম উচ্চতায় নির্মাণ শুরু করায় আদালতের নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ে।

স্থানীয় ও পরিবেশবাদী সংগঠনের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সেতুগুলোর কাজ থমকে যায়। আটটি সেতুর গড় অগ্রগতি ৭৮ শতাংশের বেশি হলেও গত সাড়ে তিন বছর ধরে কোনো অগ্রগতি নেই।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, নির্মাণ বন্ধ থাকায় দুই পাড়ের কয়েক লক্ষাধিক মানুষ প্রতিদিন চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। কোথাও সাঁকো ভেঙে গেছে, কোথাও নদীর দুই পাড়ে বাঁশ পুঁতে দড়ি টেনে চলতে হয় নৌকায়।
কচুয়া ইউনিয়নের ঘোপ গ্রামের স্কুলশিক্ষার্থী আফজালুজ্জামান বলেন, “আমি ছাতিয়ানতলা সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ি। আগে বাঁশের সাঁকো দিয়ে যেতাম, এখন সেটিও ভেঙে গেছে। এখন প্রতিদিন দড়ি ধরে নৌকা পার হতে হয়, ফলে স্কুলে পৌঁছাতে দেরি হয়।”

একই অভিযোগ ছাতিয়ানতলা হাটের ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলামের। তিনি জানান, ‘এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় হাট হচ্ছে ছাতিয়ানতলা। কিন্তু সেতু না থাকায় ফসল, সবজি কিংবা অন্যান্য পণ্য পরিবহন করা যাচ্ছে না ঠিকভাবে। এতে কৃষক ও ব্যবসায়ী দু’পক্ষই ক্ষতির মুখে।’

নদী রক্ষা আন্দোলনের নেতা জিল¬ুর রহমান ভিটু বলেন, ‘সেতুগুলোর উচ্চতা ছিল মাত্র ৪ দশমিক ৫৯ থেকে ১১ দশমিক ৫০ ফুট পর্যন্ত, যা নৌ চলাচলের জন্য একেবারেই অপর্যাপ্ত। অথচ নিয়ম অনুযায়ী প্রথম শ্রেণির নদীতে সেতুর উচ্চতা কমপক্ষে ৬০ ফুট, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ৪০ ফুট, তৃতীয় শ্রেণিতে ২৫ ফুট এবং চতুর্থ শ্রেণিতে ১৬ ফুট হতে হয়। কিন্তু এই নিয়ম উপেক্ষা করেই এলজিইডি সেতুগুলোর কাজ শুরু করেছিল। ফলে আদালত নির্দেশনায় কাজ বন্ধ হয়ে যায়।’

ভৈরব নদ সংস্কার আন্দোলনের উপদেষ্টা কমরেড ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, ‘নিয়ম না মেনে নদী হত্যার ষড়যন্ত্র চলছিল বলেই আমরা আদালতের দ্বারস্থ হই। আদালতে এলজিইডি কর্তৃপক্ষ নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে ছয় মাসের মধ্যে নতুন নকশা করে কাজ শুরু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে কোনো কাজ হয়নি। তিন বছরেরও বেশি সময় কেটে গেলেও তারা কাজ শুরু করতে পারেনি। এই দায় জনগণের নয়, এটি সরকারের গাফিলতির ফল।’

এলজিইডি যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী আহমেদ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘সেতুগুলোর উচ্চতা-সংক্রান্ত মামলা আদালতে চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে শুনানি শুরু হয়েছে। আশা করছি দ্রুত আদালতের নির্দেশনা পাওয়া যাবে। এরপরই নতুন নকশা অনুযায়ী কাজ শুরু করা হবে।’