সেই ভোগান্তি ভবদহে

৮১ কি.মি নদী খনন ও টিআরএম বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিতা পর্যবেক্ষণে চীনা প্রতিনিধি দল পাঠালো সরকার

0

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ভরা বর্ষায় বন্যা অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে যশোরের ভবদহ অঞ্চলে। ইতোমধ্যেই ৪৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। অপরদিকে অভয়নগরে আতাই নদীর পানি বেড়ে প্লাবিত হয়েছে দুই গ্রাম। এছাড়া মনিরামপুরে ঝাঁপা, খেদাপাড়া, পারখাজুরা ও হরিহরনগর বাওড়ের পানি উপচে পড়ে বিস্তীর্ণ এলাকার কৃষি জমি তলিয়ে যাওয়ায় আমন চাষ নিয়ে কৃষক চরম বিপাকে পড়েছেন।

এদিকে ভবদহ অঞ্চলের দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে আলোচনা ও সরেজমিন পর্যবেক্ষণের জন্য চীনের চাংজিয়াং ওয়াটার রিসোর্সেস কমিশনের ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল গতকাল ভবদহ এলাকায় যায়। তারা ভবদহ ২১ ভেন্ট সুইচ গেট এবং কেশবপুর থানাধীন আগরহাটি শৈলগাতী ব্রিজ এলাকা পরিদর্শন করেন। তাদের সাথে ছিলেন পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মো. লুৎফর রহমান।

গতকাল ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ এক বিবৃতিতে বলেছেন, সরকার আমডাঙ্গা খাল, ৮১ কিলোমিটার নদী খনন এবং টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট (টিআরএম) প্রক্রিয়া গ্রহণের উদ্যোগ নিলেও দীর্ঘসূত্রিতার কারণে আবারও বিপর্যয় নেমে এসেছে। বর্তমানে ভবদহ সুইচগেটের ২১টি ভেন্টের মধ্যে মাত্র ৬টি খোলা রয়েছে, বাকি গেটগুলো বন্ধ থাকায় পানি দ্রুত নিষ্কাশন হতে পারছে না। তারা অবিলম্বে বন্ধ গেটগুলো খুলে দিয়ে দ্রুত পানি বের করার দাবি জানিয়েছেন। যা সম্ভাব্য বিপর্যয় থেকে মানুষকে রক্ষা করতে পারে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রিতা সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে কমিটি মনে করে।

কমিটির আহ্বায়ক রনজিত বাওয়ালি, যুগ্ম আহ্বায়ক গাজী আব্দুল হামিদ এবং সদস্য সচিব চৈতন্য কুমার পাল এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, ভবদহ এলাকার কুলটিয়া ইউনিয়নের ১৪টি, চলিশা ইউনিয়নের ৫টি, সুন্দলী ইউনিয়নের ১০টি, পায়রা ইউনিয়নের ৫টি, হোগলাডাঙ্গা ইউনিয়নের ৮টি এবং নেহালপুর ইউনিয়নের ৩টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। প্রতিদিন এই সংখ্যা বাড়ছে এবং বাড়িঘর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ফসলের জমি ও উপাসনালয়সমূহ পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে।

এদিকে ভবদহ জলাবদ্ধতা নিরসনে এবার সরকার চীনের একটি প্রতিনিধি দল পাঠালো দুর্গত এলাকায়। বাংলাদেশ পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মো. লুৎফর রহমানের নেতৃত্বে চীনা প্রতিনিধি দলটি সকাল ১০টা ৩৫ মিনিটে যশোর বিমানবন্দরে পৌঁছায়। এরপর তারা যশোর সার্কিট হাউজে আসেন।

যশোর সার্কিট হাউজের হলরুমে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যাণার্জী ভবদহ বিলের ভবিষ্যৎ সমস্যা নিরসন সংক্রান্ত একটি তথ্যচিত্র উপস্থাপন করেন। এতে বর্তমান জলাবদ্ধতার চিত্র, এর কারণ এবং টেকসই সমাধানের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়। সংশিষ্ট কর্মকর্তাগণও তাদের তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করেন।

সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসক মো. আজহারুল ইসলাম, পুলিশ সুপার রওনক জাহান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ।

চীনা প্রতিনিধি দলে ছিলেন, মিসেস সাই রংরং, মিস্টার সু ঝাওমিং, মিস্টার চেন ইয়ংশেন, মিস্টার চেন ইংজিয়ান, মিস্টার হুয়াং হুইয়ং, মিস্টার ডেং ইউজিয়ে।

সভা শেষে প্রতিনিধি দলটি অভয়নগর উপজেলার ভবদহ ২১ ভেন্ট সুইচ গেট এবং কেশবপুর থানাধীন আগরহাটি শৈলগাতী ব্রিজ এলাকা পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন শেষে তারা খুলনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, চীনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এই বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধিদের পর্যবেক্ষণ ও মতামত ভবদহ জলাবদ্ধতা সমস্যা নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে সহায়ক হবে।

অপরদিকে নজরুল ইসলাম মল্লিক,অভয়নগর (যশোর) জানান, নিম্নচাপের প্রভাবে টানা বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে যশোরের অভয়নগর উপজেলার সিদ্দিপাশা ইউনিয়নের ২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। আতাই নদের পানি কয়েক ফুট বেড়ে যাওয়ায় তীরবর্তী শান্তিপুর ও রামনগর গ্রামের শ শ পরিবার পানিবন্দী হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। তলিয়ে গেছে ফসলি জমি, মাছের ঘের ও গ্রামীণ সড়ক। টেকসই বাঁধ সংস্কারের দাবি করেছেন গ্রামবাসী। দ্রুত সময়ের মধ্যে ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পার্থ প্রতিম শীল।

উপজেলার সিদ্দিপাশা ইউনিয়নে ভৈরব নদের ত্রিমোহনী থেকে বয়ে যাওয়া মজুদখালী নদীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আতাই নদ। সেই আতাই নদের দুর্বল বাঁধের প্রায় ২ শ মিটার অংশ দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে শান্তিপুর ও রামনগর গ্রামের কিছু অংশ প্লাবিত হয়েছে।

সিদ্দিপাশা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ আবুল কাশেম বলেন, আমার ইউনিয়নের শান্তিপুর ও রামনগর গ্রাম জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে। উপজেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে কথা বলে বাঁধ সংস্কারের ব্যবস্থা করা হবে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পার্থ প্রতিম শীল বলেন, সিদ্দিপাশা ইউনিয়নের ২টি গ্রামে জোয়ারের পানি ঢুকে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা ওই বাঁধের দুর্বল অংশে প্রাথমিক সংস্কারের উদ্যোগ নেবে বলে জানিয়েছে। তাছাড়া বর্ষা মৌসুমের পর ওই বাঁধের টেকসই সংস্কার করা হবে বলেও আশ্বাস দিয়েছেন তারা। এ বিষয়ে যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যার্নাজী জানান, ওই এলাকা পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ওসমান গণি, রাজগঞ্জ (যশোর) জানান, টানা বর্ষণে উপজেলার ঝাঁপা, খেদাপাড়া, পারখাজুরা ও হরিহরনগর বাওড়ের পানি উপচে পড়ে বিস্তীর্ণ এলাকার কৃষি জমি তলিয়ে যাওয়ায় আমন চাষ নিয়ে চাষিরা চরম বিপাকে পড়েছেন। দ্রুত এই সমস্যার সমাধান না হলে এ বছর আমন চাষ সম্ভব নয় বলে আশংকা করছেন স্থানীয় কৃষকেরা।

গত কয়েক দিনের বৃষ্টিপাতে তলিয়ে গেছে আমন ধানের বীজতলাও। এ উপজেলার একটি পৌরসভা এবং ১৭টি ইউনিয়নের ভবদহ অঞ্চল, নেহালপুর, ভোজগাতি, কুলটিয়া, মনোহরপুর খানপুর, দুর্বাডাঙ্গা, ঢাকুরিয়া, মনিরামপুর সদর, ভোজগাতি, রোহিতা, কাশিমনগর, হরিহরনগর, খেদাপাড়া, ঝাঁপা, মশ্মিমনগর, শ্যামকুড় ও চালুয়াহাটি ইউনিয়নে আমন ধানের বীজতলা সম্পূর্ণ পানির নিচে।

মনিরামপুর উপজেলা কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছেন, চলতি মৌসুমে বৃহত্তর এ উপজেলার একটি পৌরসভা এবং ১৭টি ইউনিয়নে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২২হাজার ৫৮ হেক্টর জমিতে। সেখানে জলাবদ্ধতার কারণে এ পর্যন্ত চাষ হয়েছে ৮ হাজার হেক্টর জমিতে। আমন চাষ এখনও অব্যাহত রয়েছে। ফলে শেষ পর্যন্ত বাড়তে আমন চাষের সংখ্যা। এদিকে চলতি মৌসুমে বৃহত্তর এ উপজেলায় আউশ ধান চাষ হয়েছে ৩২শ হেক্টর জমিতে। এরমধ্যে পানির নিচে ২হাজার ১৪হেক্টর আউশ এবং আমন পচে নষ্ট হয়ে গেছে। সর্বমোট ২হাজার ৫ হেক্টর জমিতে জলাবদ্ধতার কারণে রোপণকৃত আউশ এবং আমন সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে।