সুচিকিৎসার সংকট যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালে

0

বিএম আসাদ ॥ যশোর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে ভুলভাল চিকিৎসা অহরহ ঘটছে। বিষ খাওয়া রোগীকে ভর্তি করা হচ্ছে করোনারী কেয়ার ইউনিটে, পেটে ব্যাথার রোগীর চিকিৎসা মেডিসিনের পরিবর্তে হচ্ছে সার্জারি ওয়ার্ডে। রোগী না দেখেই ওষুধ লিখে পাতা ভরিয়ে ফেলছেন চিকিৎসকরা। জীবণুর ভয়ে রোগীকে স্পর্শ থেকে দূরে থাকা চিকিৎসকরা ঘনঘন হ্যান্ড স্যানিটাইজারে মুছছেন হাত। ভুল চিকিৎসায় প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। সামর্থবানরা হাসপাতাল ছেড়ে যাচ্ছে প্রাইভেট হাসপাতালে।

যশোর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে নিয়মিত চিকিৎসকের সংখ্যা ১০৯ জন। মেডিকেল কলেজের ক্লিনিক্যাল চিকিৎসক আছেন ৪৫ জন। ইন্টার্ন চিকিৎসক আছেন ৭২ জন। সব মিলিয়ে কর্মরত চিকিৎসকের সংখ্যা ২২৬জন। এছাড়াও সেবিকা আছেন ২৩০ জন। কর্মচারীর সংখ্যা ১৩১ জন। স্বেচ্ছাসেবক আছেন আরো ১১০ জন। বিশাল জনবল নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে এ হাসপাতাল। এখানে প্রতিদিন গড়ে ৬শ রোগী ভর্তি থাকেন। আর বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেন ১ হাজার ৮০০। চিকিৎসক ও ভর্তি রোগীর সংখ্যা বিবেচনায় একজন চিকিৎসকের বিপরীতে রোগী তিনজনের কম। অথচ এই হাসপাতালে রোগীদেও চিকিৎসা জুটছে না বললেই চলে।

গত ৮ ফেব্রুয়ারি রাতে হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) রাজু খাঁ (৩৫) নামে এক রোগীর মৃত্যু হয়। সিসিইউ এ কর্মরত চিকিৎসক শুভাশিস তাকে মৃত ঘোষণা করেন। রাজু খাঁ বেনাপোল পোর্ট থানার কাজীপুর গ্রামের ইলিয়াস আলী খাঁর পুত্র। কীটনাশক পান করায় ওইদিন সন্ধ্যা ৬ টা ৩০ মিনিটে তাকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আনা হয়। চিকিৎসক জুবায়ের হোসেন তাকে মেডিসিন ওয়ার্ডে না পাঠিয়ে কার্ডিয়াক ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দেন। মৃত্যু ঘোষণার সময় ডা. শুভাশিস রিপোর্ট করেন, ‘আননোন পয়জোনিং বা অজ্ঞাত বিষ ক্রিয়ায় মৃত্যু।’ ইন্টারনাল ইনজুরিও উলে¬খ করেন তিনি। পরে রাজু খার লাশ ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠানো হয়। এরপর নিয়ম অনুযায়ী যশোর কোতোয়ালি থানায় অপমৃত্যু মামলা হয়। কোতোয়ালি থানার এস আই রেবেকা সুলতানা লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করেন। রিপোর্টে তিনি উলে¬খ করেন লাশের মুখে বিষের গন্ধ পাওয়া গেছে। তার পায়ের হাঁটুতে চামড়া ছেলা দাগ ছিল। লাশের ময়নাতদন্ত হয় এবং ময়নাতদন্ত শেষে স্বজনরা বাড়িতে নিয়ে গিয়ে দাফন করেন।

রাজু খাকে হাসপাতালে ভর্তি করেন জরুরি বিভাগের চিকিৎসক মো. জুবায়ের হোসেন। তিনি বলেন, রোগীর লোকজন বিষ পানের বিষয়ে কিছু বলেনি। বুকে ব্যাথার কথা বলায় সিসিইউতে পাঠনো হয়েছিল।

রাজু খার মত অসংখ্য রোগীর ওয়ার্ড নির্ধারণ করতে যেয়ে ভুল করছেন জরুরি বিভাগের চিকিৎসকরা। বিশেষ করে হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীদের ভুলে পাঠনো হয় মেডিসিন ওয়ার্ডে। আর একবার ওয়ার্ড ভুল হলে ওই রোগীর চিকিৎসা শুরু হতে দিন পার হয়ে যায়। খুব কম রোগী ওয়ার্ড পরিবর্তনের সুযোগ পান। ফলে ভুল চিকিৎসায় কারো কারো মৃত্যু হয়। অনেকে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে বাচেন।

শুধু ওয়ার্ড বদল নয় সুচিকিৎসা পাওয়াটা দুরূহ হয়ে উঠেছে এ হাসপাতালে। ওয়ার্ডে ভর্তির পর চিকিৎসা পেতে অবর্ণনীয় ঝামেলা পোহাতে হয় রোগীদের। রোগীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, অধিকাংশ চিকিৎসক রোগী না দেখে টিকিটে ওষুধ লিখে থাকেন। ইন্টার্ন চিকিৎসকদের এ কাজটি সবচেয়ে বেশি। তারা রোগী দেখুক বা নাই দেখুক টিকিট পেলেই সামান্য লক্ষণ শুনে টিকিট ভরে ওষুধ লিখতে থাকেন। টিকিটে লেখা ওষুধ ভুল হলেও তা ধরার উপায় নেই। খাওয়ানো হয় রোগীকে।

গত ৬ ফেব্রুয়ারি শাকিল (২১) নামে এক যুবক পেটের যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে সার্জারি ওয়ার্ডে সেবিকারদের টেবিলে যান। শাকিল ঝিকরগাছা উপজেলার বেনেয়ালী গ্রামের মোহাম্মদ আলী পুত্র। হাসপাতলে পেটে ব্যথা নিয়ে ভর্তি হওয়ার পর দু’দিনেও সার্জারি ওয়ার্ডের কোন চিকিৎসক তাকে দেখেননি বলে জানান শাকিল। পরে দেখা যায় রোগী টিকিটে চিকিৎসক তাকে একাধিকবার দেখেছেন এবং ওষুধ লিখে টিকিট ভর্তি করে ফেলেছেন। রোগী না দেখে টিকিটে ওষুধ লেখার ঘটনা শুনে সেখানে উপস্থিত লোকজন বিস্ময় প্রকাশ করেন। আর উপস্থিত সেবিকা পান্না বলেন, আমাদের কিছু করার নেই। চিকিৎসক যা লিখবেন। আমরা সেই ওষুধ দেব। পরে ওই রোগী চিকিৎসা নেওয়ার জন্য নিজ ইচ্ছায় বাইরে চলে যান। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হ্যান্ড স্যানিটাইজার নিয়মিত ব্যবহার করেন কিন্তু রোগীর শরীরে হাত দেন না এমন চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়ছে।
হাসপাতালের বহির্বিভাগেও একই অবস্থা। টেবিলের সামনে রোগী আসে আর যায়। ডাক্তারের সামনে টিকিট ধরার সাথে সাথে ওষুধ লেখা শেষ। সমস্যা শোনার প্রয়োজন মনে করেন না চিকিৎসকরা। এক একজন রোগী মাত্র এক থেকে দেড় মিনিট সময় পাচ্ছেন।

এ নিয়ে চিকিৎসকরা বলেন, হাসপাতালে প্রতিদিন শ শ রোগী আসে। কোন বিভাগে ২ শর ওপরে রোগী দেখা হয়। দেড় মিনিট দুই মিনিট করে এক এক জন রোগী দেখলে হাসপাতালের সময় শেষ হয়ে যায়। সুতরাং দীর্ঘ সময় নিয়ে রোগীর চিকিৎসা দেয়া সম্ভব না । প্রতিদিন সকালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা ওয়ার্ডে রোগীদের চিকিৎসা দেন। সারা দিন আর তাদের দেখা মেলে না। হাসপাতাল সামলান ইন্টার্নরা। অনকলে হাসপাতালে আসতে বাধ্য হওয়া সিনিয়র চিকিৎসকরা রোগীদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেন। ঝামেলা এড়াতে রেফার করে দেন।

রোগীদের অভিযোগ, শুধু আন্তরিকতা ও দায়িত্বশীলতার অভাবে রোগীরা সেবা পাচ্ছে না। শুধু চিকিৎসা না ওষুধ না পাওয়ার অভিযোগ আছে। হাসপাতালে প্রতিবছর সরকারি ওষুধ বরাদ্দ হয় ৫ কোটি টাকার বেশি। অথচ রোগীরা তাদের চাহিদা অনুযায়ী ওষুধ পান না। বর্তমানে হাসপাতালে ওষুধের সংকট রয়েছে। সার্বজনীন প্রয়োজনীয় ওষুধ মোনাস, ন্যাপরোসিনের মত অনেক ওষুধ নেই হাসপাতালে। ওষুধ না পেয়ে গরিব ও দুস্থ রোগীরা চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। ওষুধের বাজার মূল্য বেড়ে যাওয়ায় তারা বাজারে ওষুধ কিনে খেতে পারছেন না।

এ অবস্থায় চিকিৎসা সংকট ও ওষুধ সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে হাসপাতালে। সংকটের ভেতরে চলছে যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতাল। হাসপাতালের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক। অথচ তত্ত্বাবধায়কের পদটি শূন্য রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। একজন কনসালটেন্ট ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধাক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

এ ব্যাপারে ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক ডা. হিমাদ্রি সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এত রোগী যা হাসপাতালের ধারণক্ষমতার বাইরে। এ অবস্থায় কিছুটা সংকট থাকবে। তবে সব ধরা যাবে না।

ভারপ্রাপ্ত আবাসিক মেডিকেল অফিসার আরএমও ডা. মো বজলুর রশিদ টুলু বলেন, অভিযোগ কিছুটা সঠিক। আবার কিছু সঠিক নাও হতে পারে।

বিষয়টি খতিয়ে দেখার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, রোগীর ভিড়ে অনেক ধরনের সংকট হয়। যশোরে ৫০০ বেডের মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হলে সংকট কেটে যাবে বলে ডা. মো. বজলুর রশিদ টুলু প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।