নবচেতনায় উদ্ভাসিত মহান স্বাধীনতা দিবস আজ

0

শিকদার খালিদ ॥ জুলাই বিপ্লবের নবচেতনায় উদ্ভাসিত মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস আজ। দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপনের লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। সারাদেশে দিনের প্রথম প্রহরে একত্রিশবার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসটির সূচনা হয়েছে। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এছাড়া জেলা ও উপজেলার স্মৃতিসৌধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হচ্ছে। দিবসটি উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টা, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব আলাদা বাণী দিয়েছেন। আজ সরকারি ছুটির দিন।

২৪-এর জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে নতুন এক প্রেক্ষাপটে এসেছে এবারের স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। তারুণ্যের আধিপত্যে নতুন এক বাংলাদেশ এখন রাজনীতিতে। স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী দল হিসেবে ইতিহাসে স্থান পাওয়া আওয়ামী লীগ যখন দেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিবেশী দেশের কাছে বিকিয়ে দিয়ে জনমতকে পদদলিত করে দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে বৈষম্যবাদ, ভোটাধিকার ও বাক স্বাধীনতা হরণ করে এবং একের পর এক হত্যা ও গুম করে চলছিল সেই অবস্থায় গত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে জন্ম নিয়েছে নতুন এক বাংলাদেশ। জনতার বিপ্লব আরও একবার প্রমাণ করেছে কোন স্বৈরাচার ও আধিপত্যবাদকে মেনে নিতে শেখেনি এ বঙ্গের মানুষ। যেমন ১৯৪৭ থেকে দখলদার পাকিস্তানের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ফসল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মহান স্বাধীনতা, তেমনি ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার বিপ্লবে বাংলাদেশ ফিরে পায় বহুদলীয় গণতন্ত্র ও বাক স্বাধীনতা, ১৯৯৬ সালের স্বৈরাচারবিরোধী অভ্যুত্থানে অবসান ঘটে একনায়কতন্ত্রের, তেমনি ২০২৪-এ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রক্ষা পায় দেশের সার্বভৌমত্ব, ভোটাধিকার ও বাক স্বাধীনতা। তাই এ বছরের ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস নতুন এক চেতনায় পালন করবে দেশবাসী।
স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী দল হিসেবে ইতিহাসে নাম থাকলেও আওয়ামী লীগ তার টানা এক দশক শাসনামলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বিকৃত ঘটানোর অপচেষ্টা করেছে। তারা প্রথম আঘাত হানে স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ওপর। স্বাধীনতার ঘোষণার ইতিহাসের বিকৃতি ঘটায়। এমনকি জিয়াউর রহমানকে দেওয়া মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার প্রত্যাহার করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর বিকৃত প্রতিহিংসা দেখায়। অথচ পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে বর্বর সামরিক অভিযান চালিয়ে যখন নিরীহ, নিরস্ত্র বাঙালিকে নিমর্মভাবে হত্যা করছিল, তখনই মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিল থেকে এ প্রমাণ পাওয়া যায়।
স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস থেকে অন্যান্য সকল সংগঠক ও বীরশ্রেষ্ঠদের ভূমিকা অবমূল্যায়ন করে ফ্যাসিস্ট বলে কুখ্যাত আওয়ামী লীগের স্বৈরাচার সভানেত্রী পলাতক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুধুমাত্র তার পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ও তার মা-ভাইদের প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে এসেও জাতিকে মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকার- দুই ভাগে বিভক্ত করে ক্ষমতা ধরে রাখার অপচেষ্টা করেছেন। পরিবারকে প্রাধান্য দিয়ে একদলীয় শাসন কায়েম করতে গিয়ে নির্মম নির্যাতন, হত্যা-গুম ও মামলার পর মামলা দিয়েছেন বিরোধী মতের রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের। বিতর্কিত করে তুলেছেন পুলিশ প্রশাসনসহ রাষ্ট্রের সকল বিভাগকে। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন প্রতিবেশী ভারতের এজেন্ট রূপে। যা আওয়ামী লীগের শাসনকাল থেকে শুরু করে পতনের পর পর্যন্ত আলোচনার শীর্ষে রয়েছে। শেখ হাসিনার পতন ও পালিয়ে ভারতের গিয়ে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকে ভারত সরকারের নানা মন্তব্য, সেদেশের প্রচার মাধ্যমগুলোর একের পর এক গুজব প্রমাণ করছে শেখ হাসিনা তাদের কাছে কী ছিলেন।
সেই শেখ হাসিনার মুখরা ভূমিকা-ই তাকে শেষ পর্যন্ত পতন ঘটিয়েছে। চাকরির কোটা নিয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদেরকেও তিনি রাজাকারের ‘নাতিপুতি’ বলে আখ্যায়িত করেন। ২০২৪ সালের আগস্টে এক সংবাদ সম্মেলনে কোটা বিরোধী আন্দোলনকারীদের তিনি উল্লিখিত উক্তি করেন। সাথে সাথে মোড় ঘুরে যায় আন্দোলনের। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে অপশাসনে সকল বৈষম্যের শিকার রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষের পুঞ্জিভুত ক্ষোভ বিপ্লব আকারে যুুক্ত হয় কোটা বিরোধী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সাথে। যা পরিণত হয় এক দফার আন্দোলনে। ছাত্র-জনতার বহ্নিশিখায় ছারখার হয়ে যায় আওয়ামী অপশাসন। পালিয়ে রক্ষা পান অপশাসক শেখ হাসিনা ও তার দোসররা। এভাবেই আরও একটি সফল গণ-অভ্যুত্থানে জন্ম নেয় নতুন একটি বাংলাদেশ। দেশবাসী লাভ করে বাক ও ভোটের স্বাধীনতা।

মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের শহীদদের প্রতি আজ স্মৃতিস্তম্ভে

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে বাঙালি জাতির ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অতর্কিত গণহত্যা অভিযানের পর রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের সূচনা হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু হলে শেখ মুজিবুর রহমানকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানি বাহিনী। এরপর চট্টগ্রাম কালুর ঘাট স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ২৭ মার্চ তৎকালীন সেনাবাহিনীর মেজর মুক্তিযুদ্ধের জেড ফোর্সের সর্বাধিনায়ক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তৎকালীন পূর্ববঙ্গের সর্বস্তরের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তির সংগ্রামে। ১৭ এপ্রিল শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামানকে মন্ত্রী করে মুজিবনগর সরকার শপথগ্রহণ করে। পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধকে সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য সারা দেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয় । দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র যুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয়।
মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে গতকাল স্বাধীনতা পদক প্রদানকালে ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। তাদের আত্মত্যাগের কারণে আমরা একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখার সুযোগ পেয়েছি। এ সুযোগ আমরা কোনোক্রমেই বৃথা যেতে দেবো না।’
ড. ইউনূস বলেন, ‘১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিল একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে আইনের শাসন থাকবে, মানুষের মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত হবে এবং একটি বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে এখনো ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। দীর্ঘদিন ধরে এদেশের মানুষকে তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। দুর্নীতি, লুটপাটতন্ত্র ও গুম-খুনের রাজত্ব চালিয়ে দেশে একটি ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা কায়েম করা হয়েছে।’
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান জাতির সম্মিলিত ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ‘৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা বহুমত ও পথের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সমুন্নত রাখার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, দুর্ভাগ্যক্রমে গণতন্ত্রবিনাশী শক্তির চক্রান্ত এখনো থেমে নেই। বার বার ফ্যাসিবাদী, স্বৈরাচারী ও অবৈধ শক্তি আমাদের সে লক্ষ্য পূরণ করতে দেয়নি। দেশি-বিদেশি চক্রান্তের ফলে আমাদের গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি হোঁচট খেয়েছে এবং স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হয়েছে।
গতকাল মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে এক বিবৃতিতে তিনি এ আহ্বান জানান।
মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আজ সকল সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবনে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে জাতীয় পতাকা এবং ঢাকা শহরে সহজে দৃশ্যমান ভবনসমূহে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে এবং গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনাসমূহ আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়েছে।
এছাড়া দেশের সকল বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সংগীত পরিবেশন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের সমাবেশ ও কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হচ্ছে।