যশোর শিক্ষা বোর্ডের পাঁচ হাজার স্কুল চলছে পরিচালনা কমিটি ছাড়া

0

তহীদ মনি ॥ যশোর মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের আওতাধীন ৫ হাজারেরও বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চলছে ‘কমিটি’ ছাড়া। প্রতিষ্ঠানের কাজের গতি ফেরাতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আ্যডহক কমিটি গঠনের নির্দেশনা দিয়েছে শিক্ষা বিভাগ।

যশোর বোর্ডের পক্ষ থেকে আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে কমিটির সদস্যদের নাম চাওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে (১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) ৩০০ প্রতিষ্ঠানে নতুন গঠিত হয়েছে। এদিকে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বোর্ডে নাম প্রস্তাব করতে যেয়ে ‘ত্রাহি’ অবস্থায় পড়েছে প্রতিষ্ঠান প্রধানরা। বিভিন্ন মহলের সুপারিশের চাপে তাদের এ অবস্থা হয়েছে।

পতিত ফ্যাসিস্ট আমলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কমিটি নিয়ে বিতর্কের শেষ ছিল না। পছন্দের লোকদের কমিটিতে রাখতে আওয়ামী লীগের নেতারা শিক্ষকদের হুমকী ধামকি দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি রীতিমত মারধর করেন। যশোরে আওয়ামী লীগ নেতা মোস্তফা ফরিদ আহমেদ ও যুবলীগ নেতা মাঝহারুল ইসলামের শিক্ষক নির্যাতন দেশব্যাপী নিন্দিত হয়। এরপরেও থেমে থাকেনি দলীয় প্রভাবে কমিটি গঠন। আওয়ামী লীগের পতনের পর দলীয় এসব কমিটি বাতিল করার দাবি ওঠে। সরকার সে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ২০২৪ সালের ২০ আগস্ট দেশের সব বেসরকারি স্কুল-কলেজের কমিটি ভেঙে দেয়।

বিশেষ করে স্কুল ও কলেজের গভর্নিং বডি ও ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিদের অপসারণ করে বিভাগীয় কমিশনার, ডিসি, ইউএনওদের দায়িত্¦ দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। গেল বছরের ২১ নভেম্বর বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (নিম্ন মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের) গভর্নিং বডি ও ম্যানেজিং কমিটির প্রবিধানমালা ২০২৪ এর প্রবিধি ৬৪ এর আওতায় এডহক কমিটি গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি করে শিক্ষা বিভাগ।

বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (নিম্ন মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের গভর্নিং বডি ও ম্যানেজিং কমিটি )প্রবিধানমালা, ২০২৪ এর সংশোধিত ৬৪(৩) ধারা মতে, সভাপতি মনোনয়নের ক্ষেত্রে মহানগরীর ক্ষেত্রে বিভাগীয় কমিশনার/ অন্যান্য ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকের সাথে আলোচনাক্রমে, শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি, খ্যাতিমান সমাজসেবক, জনপ্রতিনিধি অথবা কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে থেকে ৩জনের তালিকাসহ অন্যান্য সদস্যদের মনোনয়ন গ্রহণ করে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বোর্ডে পাঠাতে হবে।

ফলে নিয়ম অনুসারে স্কুল বা কলেজের প্যাডে নতুন কমিটির সভাপতির জন্যে ৩টি নাম প্রস্তাব করে লিখিত আকারে আবেদন পৌঁছাতে হবে সংশ্লিষ্ট জেলার জেলা প্রশাসকের দপ্তরে। এ আবেদনের ভিত্তিতে জেলা প্রশাসকের সম্মতিক্রমে দপ্তরের সিল স্বাক্ষর নিয়ে বোর্ডের ওয়েবসাইটে আবেদন পত্রটি জমা হবে।

এরপর শিক্ষা বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক এবং কলেজের ক্ষেত্রে কলেজ পরিদর্শক স্বাক্ষরিত আবেদনটি বোর্ড চেয়ারম্যানে কাছে উত্থাপিত হবে। সে আবেদনের সাথে জেলা শিক্ষা অফিস কর্তৃক মনোনীত শিক্ষক প্রতিনিধি, উপজেলা নির্বাহী অফিসার কর্তৃক মনোনীত অভিভাবক প্রতিনিধি ও বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এবং কলেজের ক্ষেত্রে কলেজ অধ্যক্ষের নামসহ ৪ সদস্যের পরিচালনা পরিষদের প্রস্তাবনা বোর্ড চেয়ারম্যানের অনুমোদনের পর ৬মাসের জন্য একটি এডহক কমিটি কাজ করতে পারবে। সেই কমিটি বিদ্যালয় এবং কলেজ পরিচালনা করবে।

যশোর শিক্ষা বোর্ডের আওতায় ১০ জেলার বিভিন্ন জেলায় কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান্যে নতুন পরিচালনা পরিষদ গঠিত হয়েছে, কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান নতুন কমিটি নিয়ে কাজও শুরু করেছে। তবে যশোর জেলার কোনো প্রতিষ্ঠানে এখনো নতুন কমিটি গঠিত হয়নি। শিক্ষা বোর্ডে এখনো কোনো আবেদনও জমা হয়নি। প্রাথমকিভাবে ২৮ ফেব্রুয়াারি স্কুলগুলোতে কমিটি অনুমোদনের শেষ সময় ধরা হয়েছে, এরপর কলেজ পর্যায়ে কমিটির কাজ শুরু হবে বলে বোর্ড সূত্র নিশ্চিত করেছে।

এদিকে সরকারি নিয়ম রক্ষা করে নাম পাঠতে নানামুখি চাপে পড়েছেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টরা। কয়েকজন প্রধান শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তারা মনে করেছিলেন, বিদ্যোৎসাহী কাউকে সভাপতি করবেন, এত দিন বিগত সরকারের আমলে সভাপতি তৈরি নিয়ে যে বাণিজ্য হয়েছে, দলীয় মনোনয়ন পেতে হয়েছে, এমপি বা উপজেলা চেয়ারম্যানের সম্মতি মানতে হয়েছে এখন তেমন হবে না। সত্যিকারের শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিকে পাওয়া যাবে। বাস্তবে স্থানীয় নানা মতের প্রভাব মানতে হচ্ছে, কোনো কোনো গ্রুপ একাধিক ব্যক্তির নাম সুপারিশ করছেন, এমনকি পূর্বের ক্ষমতবানরা তাদের মনোনীত অন্যদের নামও জমা দিচ্ছেন। অলিখিত চাপও আসছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন প্রধান শিক্ষক বলেন, পতিত সরকারের আমলে যশোর সদরের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মোস্তফা ফরিদ আহমেদ যেমন কোনো একজন প্রধান শিক্ষককে কমিটি গঠন নিয়ে মারাত্মক আহত করেছিলেন বা শিক্ষা অফিসে ভাঙ্চুর করেছিলেন তত সমস্যা না হলেও কিছু চাপ মেনে নিতে হচ্ছে। এমনকি কোন তিনজনের নাম শেষ পর্যন্ত জমা দিচ্ছেন তাও জানতে দিতে চাচ্ছেন না। এরপর কমিটি অনুমেদিত হয়ে আসার পর কী হবে তা নিয়ে ভয়ে আছি।

যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সচিব প্রফেসর এস এম মাহাবুবুল ইসলাম জানান, বিদ্যালয়ের জন্যে কমিটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিছুটা দেরি হচ্ছে বিধায় দ্রুত কমিটি গঠনের তাগিদ দিয়ে বোর্ড থেকে জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্টদের দপ্তরে চিঠি পাঠানো হয়েছে। তিনি আরো বলেন, বিষয়টি দ্রুত শেষ করার উপর গুরুত্ব দিতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশনা দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রনালয়। তিনি জানান, ফ্যাসিবাদের কেউ কমিটিতে স্থান পাক তা যেমন কাম্য নয় তেমনি কমিটি গঠন বা সভাপতি হয়ে কেউ প্রতিষ্ঠানকে শিক্ষা ব্যবস্থার বাইরে রাজনৈতিক আশ্রয়স্থল বা দুর্নীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করুক তাও বোর্ড সচিব হিসেবে তিনি বা বোর্ড কর্তৃপক্ষ কেউ আশা করে না।

এ সময় তিনি জানান, যশোর বোর্ডের আওতায় ৫ হাজারের বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যশোর জেলায় রয়েছে এক হাজার ৪৫ টি স্কুল। এ পর্যন্ত মাত্র ৩শটি বিদ্যালয়ে কমিটি দেয়া সম্ভব হয়েছে। আরো ৫শ আবেদন জমা আছে। তবে যশোর জেলার একটি আবেদনও জমা পড়েনি।

যশোরের জেলা প্রশাসক মো. আজাহারুল ইসলাম মোবাইল ফোনে জানান, বিষয়টি তারা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করছেন। ইতোমধ্যে উপজেলা নির্বাহী অফিসারদেরকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, তারা সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষকের সাথে আলাপ আলোচনা করে কমিটির সভাপতির নামসহ প্রস্তাবনা যশোর শিক্ষা বোর্ডে পাঠাবেন।

তিনি আরো বলেন, ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় রয়েছে, খুুব শিগগিরই তারা সব আবেদন শিক্ষা বোর্ডে পাঠাতে পারবেন। প্রশ্নে জবাবে জেলা প্রশাসক আরও জানান, ম্যানেজিং কমিটি গঠন নিয়ে আইন শৃঙ্খলার যেনো কোনো প্রকার অবনতি না হয় বা স্থানীয় পর্যায়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয় যে বিষয়টি মাথায় রেখেই তারা কমিটি গঠনের ব্যপারে কাজ করছেন।

তবে তিনি জানান, বর্তমান পদ্ধতিতে শিক্ষকরা মাসের বেতনের সরকারি অংশ ঘরে বসেই ব্যাংকের মাধ্যমে পাচ্ছেন, আাগের মতো বিড়ম্বনা নেই। ফলে কমিটি গঠনে একটু দেরি হলেও কাজের ক্ষেত্রে খুব একটা সমস্যা হওয়ার কথা না। কমিটি গঠন বা সভাপতির নাম প্রস্তাবের ক্ষেত্রে কোনো চাপ আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি অস্বীকার করেন।