১০ বাংলাদেশিকে রাশিয়ায় পাচার, জোর করে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ ভাগ্য বদলের আশায় পাড়ি জমিয়েছিলেন রাশিয়ায়। দালালের খপ্পরে পড়ে নামতে হয়েছে যুদ্ধের ময়দানে। বাংলাদেশ থেকে ১০ জন যুবককে প্রথমে সৌদি আরব নিয়ে যাওয়া হয়। পরে নেওয়া হয় রাশিয়ায়। সেখানে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর অধীনে ১৫ দিনের নামমাত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে পাঠানো হয় যুদ্ধক্ষেত্রে। নির্মম এমন প্রতারণার কারিগর বাংলাদেশি দালালরা। এ ঘটনায় নাম এসেছে ড্রিমহোম ট্রাভেলস এবং তামান্না ট্রাভেল এজেন্সি নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের।

ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর দাবি, ফুলের বাগান পরিচর্যার কাজের কথা বলে তাদের রাশিয়া নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আদায় করা হয়েছে মোটা অংকের টাকা। রাশিয়ায় যুদ্ধের প্রশিক্ষণের সময় তারা ট্রাভেল এজেন্সিতে যোগাযোগ করলে ‘যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে রাশিয়ায় সবার প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক’ বলে জানানো হয়। ১৫ দিন পরে যখন যুদ্ধের ময়দানে নামানো হয়, তখন ‘মহড়া দিতে নামানো হয়েছে’ বলে ভুক্তভোগী পরিবারকে জানায় এজেন্সি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে রাশিয়ায় অবস্থান করছেন যশোর সদরের চাঁচড়ার সরদার পাড়ার জাফর হোসেন, রাজবাড়ীর আরমান মন্ডল, নওগাঁর রহমত আলী, কেরানীগঞ্জের আনিসুর রহমান, নারায়ণগঞ্জের আকরাম হোসেন, নরসিংদীর তুহিন, সোহান, মোবারকসহ মোট ১০ বাংলাদেশি। নাটোরের এক বাসিন্দা কবীর গত ২৬ জানুয়ারি যুদ্ধের ময়দানে নিহত হয়েছেন। যারা বেঁচে আছেন, তাদের আলাদা আলাদা জায়গায় রাখা হয়েছে। সঙ্গীরা কে কোথায় আছেন তা কেউই বলতে পারেন না।

গত সপ্তাহে রাশিয়ায় থাকা আরমান মন্ডল রাশিয়ার অধিকৃত ইউক্রেন অঞ্চলে যুদ্ধ চলমান অবস্থায় মাইন বিষ্ফোরণে আহত হয়ে সেখানকার রোস্তভ অন ডনের সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। গণমাধ্যমে তিনি বলেন, আমাদের মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে রাশিয়া আনা হয়েছে। ১৫ দিনের ট্রেনিং শেষে যুদ্ধে নামিয়ে দিয়েছে। আমরা যুদ্ধের কিছু জানি না, বুঝি না। গত সপ্তাহে যুদ্ধের ময়দানে মাইন বিষ্ফোরণে আমার পা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন আমি সেনাবাহিনীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছি। সুস্থ হলে এরা আমাকে আবারও যুদ্ধে পাঠাবে। এবার নিয়ে গেলে মারা যাবো। আমাকে দেশে ফিরিয়ে নেন। আমি দেশে ফিরতে চাই। সরকারের কাছে অনুরোধ, আমাদের যেন দেশে ফিরিয়ে নেয়।

আরমানের মা ফাহিমা বেগম বলেন, আমার ছেলেকে দেশে ফেরত চাই। আমার একটা মাত্র ছেলে। টাকা-পয়সা কিছু চাই না। সরকারের কাছে অনুরোধ, আমার ছেলেকে ফিরিয়ে এনে দেন।

ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে ৯ লাখ টাকা খরচ করে পাঁচ মাস আগে ঢাকার একটি এজেন্সির মাধ্যমে সৌদি আরবে পৌছান যশোর সদর উপজেলার চাচড়া ইউনিয়নের সরদার পাড়া গ্রামের খায়রুল সরদারের ছেলে জাফর হোসেন। কথা ছিলো সাইপ্রাসে পরিছন্ন কর্মীর চাকরি পাওয়ার। কিন্তু দালালের প্রতারণার শিকার হয়ে প্রথমে সৌদিয়া আরবে থাকতে হয় ২ মাস। এরপর দুবাই, তুরষ্ক হয়ে রাশিয়ায় পাঠানো হয় তাকে। সেখানে স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করিয়ে পাঠানো হয় সেনাবাহিনির সাথে রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধে। সন্তানের মুখে এ ঘটনা শুনে স্তব্ধ পরিবার। বাড়ির এক কোনায় বসে সারাক্ষণ বিলাপ করছেন স্ত্রী খাদিজা খাতুন। পাশেই আছে দুই সন্তান আল মুভীন ও জান্নাতী। স্বামীর চিন্তায় কিছুতেই যেন কথা বলতে পারছেন না তিনি। এ ঘটনায় শঙ্কিত বাবা মা, চাই সন্তানকে দেশে ফিরিয়ে আনতে। প্রতারক দালালের শাস্তির দাবিও জানান তারা।

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মিতুল হোসেন বলেন, আমার ভাগিনা আরমান রাশিয়া যাওয়ার পরে তাকে যুদ্ধের ট্রেনিং করানো হয়েছে। আমরা এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। তখন তারা বলে, রাশিয়ায় এসময় ট্রেনিং করা বাধ্যতামূলক। পরে তাদের ভারী অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধে নামানো হয়েছে। মাইন বিস্ফোরণে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। এখন সরকার যদি বিষয়টা গুরুত্ব সহকারে দেখে তাহলে তাকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। আমরা সরকারকে অনুরোধ করবো, দূতাবাসের মাধ্যমে রাশিয়ার সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে সবাইকে যেন দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।

নওগাঁর রহমত আলী তার পরিবারের কাছে হোয়াটসঅ্যাপে একটি ভয়েস রেকর্ড পাঠিয়েছেন। এতে রহমতকে বলতে শোনা যায়, আমি খুব বিপদে আছি। কালকে আবার আমাক যুদ্ধে লিয়া যাবি। যুদ্ধে লিয়া গেলি নির্ঘাত মৃত্যু। আমরা তো যুদ্ধের কোনো কলাকৌশল যানি নে। ১৫ দিনের ট্রেনিং দিয়া আমাক যুদ্ধে লিয়া যাইতাছে। এর আগেও একবার লিয়া গেছে। তোমার মামা (নাটোরের কবীর) মারা গেছে আমার কোলের উপরে। আমি কোনো হালে পলায়ে আইছি। এহন ট্রেনিং দিয়া আবার লিয়া যাইতেছে। একবার গেছি, আর যাইতে পারবো না। আামাক বাঁচা।

গত বছরের অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে এই ১০ জনকে সৌদি আরবে পাঠানো হয়। পরে সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয় রাশিয়া। যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যাওয়া কবীরের ভাগিনা মিজানুর রহমান বলেন, আমার মামা কবীর আর খালু রহমত আলী একসঙ্গে রাশিয়া গিয়েছে। আমার মামা মারা গেছে। খালু ভয়েস মেসেজে বলেছে, তার হাতের ওপর আমার মামা মারা গেছে। এ অবস্থায় থাকলে খালুও মারা যাবে।

তিনি বলেন, মামা-খালুসহ আরও ১০ জনকে প্রথমে সৌদী আরব নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পরে আমাদের পরিবারের কাছে আরও টাকা দাবি করে ড্রিমহোম ট্রাভেলস। তারা বলে, টাকা না দিলে রাশিয়ায় পাঠাবে না, বাংলাদেশেও ফিরিয়ে আনবে না। বাধ্য হয়ে পরিবারের গহনা, জমি বিক্রি করে টাকা পাঠিয়েছে। মামা মারা গেছে, আমরা চাই মামার লাশ আর খালুকে দেশে ফিরিয়ে আনতে। সরকারের কাছে অনুরোধ, তারা যেন ব্যবস্থা নেন।

মিজানুর রহমান আরও বলেন, রাশিয়া থেকে যখন বললো তাদের যুদ্ধে পাঠানো হচ্ছে, আমরা ট্রাভেল এজেন্সিতে যোগাযোগ করেও পাইনি। তাদের অফিসে গিয়ে দেখি তালা লাগানো। এখন সরকার ছাড়া আমাদের কোনো ভরসা নেই।

এসব বিষয়ে জানতে অভিযুক্ত এজেন্সি ড্রিমহোম ট্রাভেলসের চেয়ারম্যান আবুল হাসান ও তামান্না ট্রাভেল এজেন্সির মুঠোফোনে একাধিক দিনে একাধিকবার চেষ্টা করলেও নম্বরগুলো বন্ধ পাওয়া যায়।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা এ নিয়ে বলেন, এ ঘটনায় আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে রাশিয়ার পররাষ্ট্র দপ্তরে জানানো হয়ছে। তাদের বলা হয়েছে, বিষয়টি খতিয়ে দেখতে। আমাদের লোকজনের যেন কোনো ক্ষতি না হয়।

তিনি বলেন, যে এজেন্সির মাধ্যমে গেছে তাদের সম্পর্কে খোঁজ নেওয়ার জন্য আমরা গোয়েন্দা সংস্থাকে বলেছি। তাদের প্রতিবেদন পাওয়ার পর আমরা ব্যবস্থা নেবো।