বাপ-দাদার বসতি হারিয়ে এখন কপোতাক্ষ পাড়ের ঝুপড়ি ঘরই সাঁওতালদের একমাত্র ভরসা

0

মুকুরুল ইসলাম মিন্টু, চৌগাছা (যশোর) ॥ চৌগাছায় বসবাসরত সাঁওতালরা নানা সমস্যায় জর্জরিত। বিভিন্ন কারণে বাপ-দাদাদের রেখে যাওয়া বসতি জমি বিক্রি করে তারা এখন বিভিন্ন এলাকাতে ঝুপড়ি ঘর করে একেকটি ঘরে একাধিক মানুষ বাস করছেন। এ সব পরিবারের শিশুরা নিদারুণ কষ্টে রোগশোকে আক্রান্ত হয়ে বেড়ে উঠছে। মহল্লায় মহল্লায় নেই পর্যাপ্ত স্যানিটেশন ব্যবস্থা, সংকট আছে সুপেয় পানি। সরকারি ভাবে এদেরকে সঠিক দেখাশোনা করা না হলে হয়ত কোনো এক সময় তারা হারিয়ে যাবে অভিমত অনেকের।

উপজেলায় সাঁওতালদের বসবাস নেহাত কম নয়। বৃটিশ শাসনামলে আগমন ঘটে সাঁওতালদের। ব্রিটিশ বাংলা ছেড়ে চলে গেলেও থেকে যায় সাঁওতালরা। সীমান্তবর্তী উপজেলা চৌগাছায় এক সময় এদের ব্যাপক বসবাস দেখা গেলেও সময়ের সাথে এরাও হারিয়ে যাচ্ছে। নানা কারণে তারা এলাকা ছেড়ে বিভিন্ন উপজেলা বা গ্রামাঞ্চলে গিয়ে বসতি গড়ে তুলছেন। আবার অনেকে বাপ-দাদাদের ভিটে জমি বিক্রি করে এখন সরকারি জমিতে ঝুপড়ি ঘর বানিয়ে নিদারুণ কষ্টে বসবাস করছেন।

শুক্রবার জেলা পরিষদ ডাকবাংলো সংলগ্ন কপোতাক্ষ নদের পাড়ে গিয়ে দেখা যায়, শতাধিক সাঁওতাল বসতি গড়ে তুলেছেন। খননকৃত কপোতাক্ষ নদের পাড়ের মাটি সমান করে তারা মাথাগোঁজার জায়গা করেছেন। অনেকে আবার শশ্মান ঘাটেও তৈরি করেছেন বাঁশ, খুঁটি আর বেড়া দিয়ে বসতি। এদের নেই তেমন কোন স্যানিটেশন ব্যবস্থা, কষ্ট আছে সুপেয় পানির। কোথাও যাওয়ার জায়গা না থাকায় কষ্ট হলেও ঝুঁকিপূর্ণ এই স্থানকে তারা বসবাসের জন্য বেছে নিয়েছেন।

কথা হয় সাঁওতাল সর্দার নিমাইয়ের সাথে। তিনি বলেন, বাপ-দাদাদের মুখে গল্প শুনেছি উপজেলা পরিষদ, থানা চত্বর, পাইলট হাইস্কুল থেকে ডাকবাংলোপাড়া সবই ছিলো সাঁওতালদের । অভাব অনটন আর প্রলোভনে পড়ে তারা জমি জায়গা বিক্রি করেছেন। এখন তাদের প্রজন্মরা মাথা গোঁজার জায়গাটুকু পাচ্ছে না। এক সময় শিক্ষার কোনো আলো ছিলো না সাঁওতাল মহল্লাতে। তবে বর্তমানে ছেলে মেয়েরা পড়ালেখা শিখছে ঠিকই কিন্তু বাবা, মা তো অশিক্ষিত ফলে পারিবারিক নানা সমস্যা তাদেরকে কুরে কুরে খাচ্ছে। যত কষ্টই হোক না কেন যদি প্রত্যেক সাঁওতালের মাথা গোঁজার জায়গাটুকু থাকতো তাহলে তারা নিরাপদ থাকতো।

সাঁওতাল মহল্লার একাধিক নারি পুরুষ বলেন, আমরা বরাবরই সব কিছু থেকে বঞ্চিত। যখন যে সরকার আসে তার লোকজন আমাদেরকে ব্যবহার করেন। তারা সরকারি সুযোগ সুবিধা অন্য ধর্মের লোকজনের মাঝে যে পরিমাণ দেন তার সামান্য পরিমাণও দেন না আমাদের।

সাঁওতালরা জানান, বর্তমানে আর শিকার হয় না। ফলে অনেকে পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন। কেউ সেলুন করে চুল কাটেন, কেউ ভ্যান চালায়, কেউবা হাটে মুটের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। সাঁওতাল নারিরা পুরুষের মতই পরিশ্রমী। সকাল হলেই তারা কাজের জন্য বের হন আর সন্ধ্যায় ঘরে ফেরেন। সারাদিন পরিশ্রম করলেও তাদের মাঝে ক্লান্তি নেই। রাতে খাবারের পর তারা একত্রিত হয়ে গান বাজনায় মেতে উঠেন।

জনশ্রুত আছে, বৃটিশ শাসনামলে নীল চাষের শ্রমিক হিসেবে স্থানীয়রা একপর্যায়ে শ্রম দিতে অপরাগতা প্রকাশ করেন এবং এক সময় তারা বিদ্রোহ শুরু করেন। সেই সুযোগে ইংরেজ বাবুরা ভারতের নাগপুর ও বিভিন্ন স্থানের সাঁওতাল সম্প্রদায়ভুক্তদের শ্রমিক হিসেবে বিভিন্ন নীল কুঠিতে নিয়ে আসে। ইংরেজরা বিদায় হলেও সাঁওতালরা এ জনপদের মানুষের সাথে মিশে যাওয়ায় তারা আর ফিরে যায়নি।

নানা সমস্যায় জর্জরিত উপজেলার বিভিন্ন এলাকাতে বসবাসরত সাঁওতালদের সরকারি ভাবে সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান জরুরি বলে মনে করছেন উপজেলার সচেতন মহল।