স্মৃতিচারণ : রহস্যে ঘেরা মনি কিশোরের জীবন

0

আহসান কবীর

 

গেল শতাব্দীর নব্বই দশকে যারা বেড়ে উঠছিলেন, ক্যাসেট প্লেয়ারে ‘কী ছিলে আমার বলোনা তুমি’ গানটি পছন্দ করেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। এক সময়ের তুমুল জনপ্রিয় এই কণ্ঠ শিল্পীর মরদেহ গত শনিবার রাতে রাজধানীর রামপুরা এলাকায় তাঁর ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হয়।
আজীবন ছন্নছাড়া মনি কিশোর সম্বন্ধে মানুষ কমই জানে। তাঁর ব্যক্তি জীবনও ছিল রহস্যে ঘেরা। মৃত্যুর পর তাকে দাফন নাকি দাহ করা হবে, তা নিয়েও সৃষ্টি হয় জটিলতা।
স্থানীয় সংস্কৃতি কর্মীরা বলছেন, আশির দশকের শেষ দিকে মনি কিশোরের আবির্ভাব ঘটে যশোর শহরে। সেই সময় তিনি শহরের কিছু অনুষ্ঠানে গান গেয়ে শ্রোতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তখন মূলত তিনি ভারতের বিখ্যাত শিল্পী কিশোর কুমারের গান পরিবেশন করতেন।
শহরের বেজপাড়া এলাকায় তেমনই একটি অনুষ্ঠানে মনির সঙ্গে দেখা হয় শঙ্কর বিশ্বাস শ্যামের। শ্যাম তখন স্থানীয় মাইকেল সঙ্গীত অ্যাকাডেমির সদস্য। এই অ্যাকাডেমির উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন প্রণব ঘোষ; যিনি পরবর্তীকালে সঙ্গীত পরিচালক ও সুরারোপ করে দেশজুড়ে খ্যাতি অর্জন করেন।
শঙ্কর বিশ্বাস শ্যাম বলছিলেন, ‘আমি প্রণবদাকে বলি, মনি মণ্ডল নামে একজন তরুণ শিল্পীর গান শুনলাম। অসাধারণ গায়।’
প্রণব ঘোষের কথা মতো ওই তরুণকে তাঁর কাছে আনেন শ্যাম। এরপর প্রণবের শিষ্য বনে যান মনি। চলতে থাকে গান-আড্ডা আর ঢাকায় যাতায়াত। ততদিনে নিজ নাম ‘মনিমণ্ডল’ বদলে ‘মনিকিশোর’ রেখেছেন শিল্পী।
নব্বই দশকে মনি কিশোরের অ্যালবামগুলো একের পর এক প্রকাশিত হতে থাকলে তরুণদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগে। ‘কী ছিলে আমার বলোনা তুমি’ ছাড়াও তাঁর গাওয়া‘ সেই দুটি চোখ কোথায় তোমার’, ‘তুমি শুধু আমারই জন্য’, ‘মুখে বলো ভালোবাসি’, ‘আমি মরে গেলে জানি তুমি’ প্রভৃতি গান শ্রোতাদের হৃদয়ে স্থান করে নেয়।
মনি কিশোরকে দিয়ে ১২টি অ্যালবাম করিয়েছেন প্রখ্যাত গীতিকার, সঙ্গীত পরিচালক মিল্টন খন্দকার। তিনি বলছিলেন, মনি কিশোর ছিলেন অসাধারণ গায়ক। যেকোনো গানে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন তিনি। কিন্তু ব্যক্তি জীবনে মনি ছিলেন রহস্যময়। ঢাকায় কোথায় থাকতেন তাও কাউকে বলতেন না। তাঁদের যোগাযোগ হতো সামাজিক মাধ্যমে। এলোমেলো জীবন ছিল তাঁর। কারও শাসন মানতে চাইতেন না।
“বছর খানেক আগে মনি কিশোর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। আমি তাঁকে বললাম, দেখ মনি, আল্লাহ তোকে ওয়ার্নিং দিয়েছেন। এবার জীবনটা শৃঙ্খলায় ফেরা। মনি বললো, ‘আমি ঠিক হয়ে যাচ্ছি,’’বলছিলেন মিল্টন খন্দকার।
সঙ্গীত জীবনে খ্যাতি লাভের মাঝেই মনি কিশোর বিয়ে করেন শামীমা চৌধুরী নামে এক মুসলিম নারীকে। সেই সময় তিনি সনাতন ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্মগ্রহণ করেন বলে জানান তাঁর নিকটস্থরা। যদিও প্রায় দেড় যুগ আগে এই দম্পতির বিচ্ছেদ হয়েছে। শিল্পীর সনাতন ধর্মাবলম্বী আত্মীয়-স্বজনরা এই বিষয়ে কথা বলতে মোটেই আগ্রহী নন। রোববার সন্ধ্যায় বউদি রেণুমণ্ডল শিল্পী মণি কিশোর সম্বন্ধে অনেক কথাই বললেন। কিন্তু তাঁর পারিবারিক জীবন সম্বন্ধে একটি কথাও বললেন না। এমনকী স্ত্রী-সন্তানের নামও ‘জানেননা’ বলে জানালেন।
ঢাকায় অবস্থানরত ভগ্নিপতি প্রদীপ কুমার মিস্ত্রিও কাছে প্রশ্ন করেও শিল্পীর স্ত্রী-সন্তান সম্বন্ধে কোনো তথ্য বের করা যায়নি।
বিকেলে রাজধানীর বাসাবো শ্মশানে মনি কিশোরকে দাহ করা হতে পারে বলে মিল্টন খন্দকার রোববার দুপুরে জানিয়ে ছিলেন। ওই দিন বিকেলে যোগাযোগ করা হলে ভগ্নিপতি প্রদীপ মিস্ত্রি এই সম্বন্ধে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। শুধু জানান, শিল্পীর যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মেয়ের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছেন তারা। পরে গণমাধ্যমে খবর আসে, মনি কিশোর একমাত্র মেয়ে নিন্তিকে বলে গেছেন, দাহনা, তাঁকে যেন দাফন করা হয়।
মনি কিশোর প্রায়ই যশোর আসতেন। ঘনিষ্ঠ বন্ধু-শিল্পী ছাড়াও দেখা করতেন আত্মীয়-স্বজন এবং শহরের ষষ্ঠিতলা পাড়ায় তাঁর এক সময়ের ভাড়া বাসার প্রতিবেশীদের সঙ্গে। বউদি রেণু মণ্ডল জানালেন, বছর দুয়েক আগে মনি কিশোর শেষবার তাঁদের যশোর শহরের টিবি ক্লিনিক রোডের বাড়িতে এসেছেন।
মাইকেল সঙ্গীত অ্যাকাডেমির সাধারণ সম্পাদক অখিল বিশ^াস জানান, মনি কিশোর ছিলেন প্রণব ঘোষের শিষ্য। প্রণব ঘোষের মৃত্যুর পর তাঁর যশোর আগমন কমে যায়। তবে তিনি যশোর এলে মাইকেল সঙ্গীত অ্যাকাডেমিতে একবার ঢুঁ মারতে ভুলতেন না।
দেশের আরেক প্রবীণ সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক আশরাফ হোসেন বলেন, ‘মগবাজারে আমার অন্তরা স্টুডিওতে মনির যাতায়াত ছিল। কিন্তু ২০১৫ সালে স্টুডিওটি বন্ধ করে আমি যশোরের বাড়িতে চলে আসায় যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। মনি ছিল ছন্নছাড়া টাইপ। বাঁধাধরা কোনো জীবন ছিলনা তাঁর।’
আর মিল্টন খন্দকার বলেন, ‘মনিকে আমি ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে জানি। কিন্তু ও এতটাই আড়ালে থাকতো যে, আমি মাত্র গতকালই জানলাম সে রামপুরায় বিটিভি স্টেশনেরকাছে একটি বাসায় থাকতো।’