আওয়ামী লীগ নেতাদের পারাপারে সক্রিয় বেনাপোলের বাদশা সিন্ডিকেট

0
বাদশাহ মল্লিক - ফাইল ফটো

বিশেষ প্রতিবেদক ॥ বেনাপোল দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা ও সন্ত্রাসীদের নিরাপদ পলায়নে সহায়তা করছেন আলোচিত বাদশা মিয়া। শেখ হাসিনা জামানা শেষ হলেও বাদশা মিয়ার গদি অটুট থাকায় তিনি এ সুযোগ পাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। আওয়ামী লীগ নেতাদের আশ্রয় প্রশ্রয়ে সন্ত্রাসী বনে যাওয়া বাদশা নিজ দলের নেতাদের নিরাপদ পারাপারে রীতিমত ব্যবসা খুলে বসেছেন। কামাচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জোরদার কোন পদক্ষেপ দৃশ্যমান হচ্ছেনা।

৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর নতুন করে ভাগ্য খুলেছে বাদশা মিয়ার। বেসামাল হয়ে পড়া আওয়ামী লীগের এমপি, শীর্ষ রাজনীতিক ও সন্ত্রাসীদের তিনি টাকার বিনিময়ে ভারতে পলায়নের সুযোগ করে দিয়েছেন। বাদশা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ভারত গেলেই থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা পাচ্ছেন নেতারা। পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁ শহরে বাদশার বাড়িতেই উঠছেন তারা। টাকা একটু বেশি খরচ হলেও পারাপার ও আবাসন এক প্যাকেজে থাকায় বাদশা সিন্ডিকেট বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন এমপি, শীর্ষ রাজনীতিক এবং যুবলীগ-ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসীদের ভারতে পলায়নের সুযোগ করে দিয়ে আয় করেছেন লাখ লাখ টাকা।

যশোর শার্শা উপজেলার পোর্ট থানাধীন রঘুনাথপুর গ্রামের কেরামত মল্লিকের ছেলে বাদশা মল্লিক ওরফে বাদশা মিয়া (৫৫)। এক সময় নুন আনতে পান্তা ফুরালেও আজ কোটি কোটি টাকার মালিক এই বাদশা। অপরাধ জগত অবাধ বিচরণের মাধ্যমে আয় করেছেন এ অর্থ। অস্ত্র, মাদক ও হুন্ডি, সোনা পাচার তার নিয়মিত ব্যবসা। সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে ও জড়িতি তিনি! অঢেল টাকার মালিক হওয়ার পর বাদশা যশোরের শার্শা ও চৌগাছার বিভিন্ন সীমান্ত ঘাটের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন। গড়ে তোলেন নিজ নামে ‘বাদশা সিন্ডিকেট।’ অভিযোগ আছে এ সিন্ডিকেটের পেছনের শক্তি ছিলেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় সংসদ সদস্য আফিল উদ্দিনের আশীর্বাদ ও সহযোগিতা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে বাদশা মিয়া চোরাচালানের সাথে জড়িত। প্রথম দিকে তিনি ভারত থেকে চোরাই পথে আনতেন শুধুমাত্র ফেনসিডিল। অধিক মুনাফা হওয়ায় বাদশা জোরদার করেন অবৈধ এই ব্যবসা। পরবর্তীতে সব ঘাট ম্যানেজ করে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ফেনসিডিলের বড় বড় চালান পাচারের মাধ্যমে বাদশা বনে যান লাখ লাখ টাকার মালিক। ফলে আর পেছনে না তাকিয়ে অবৈধ ব্যবসার বিস্তার ঘটাতে তিনি নিজ নামে গড়ে তোলেন ‘বাদশা সিন্ডিকেট।’ শুরু হয় নতুন উদ্যমে বাদশার মাদকদ্রব্য, অস্ত্র, সোনা ও ধুড় পাচার। একই সাথে জোরদার করেন হুন্ডি ব্যবসাও। সীমান্তরক্ষী থেকে শুরু করে থানা পুলিশকে ম্যানেজের মাধ্যমে বাদশার রমরমা ব্যবসা চললেও বিপত্তি ঘটে ২০১৮ সালে।

তৎকালীন খুলনা রেঞ্জ পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শকের মাদক বিরোধী অভিযানে কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী বাদশাকে আটকের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে ধুরন্ধর বাদশা পালিয়ে যান ভারতে। যদিও সেখানে বসেও তিনি মাদকের ব্যবসা পরিচালনা করেছেন। এরপর আওয়ামী লীগের একজন এমপির সবুজ সংকেত পেয়ে ২০২০ সালে বাদশা ফিরে আসেন বেনাপোলে। সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত বাদশা নির্ভয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন অবৈধ ব্যবসা। বর্তমানে তিনি যশোর সীমান্তের ৪টি ঘাট নিয়ন্ত্রণ করছেন। এগুলো হচ্ছে-শার্শা উপজেলার রঘুনাথপুর, ঘিবা ও ধান্যখোলা এবং চৌগাছা উপজেলার মাশিলা সীমান্ত ঘাট। এই ঘাটগুলো দিয়েই বাদশা সিন্ডিকেটের চোরাচালান পণ্য অবাধে আনা-নেয়া করা হয়।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, শার্শার রঘুনাথপুরের ওপারে (ভারতে) মাফিয়া ডন খ্যাত বস গৌতম, রবিউল, আজগার, নাসির, অপু সাহার সাথে রয়েছে বাদশার হট কানেকশন। এদের কাছে সোনার চালান পাঠিয়ে বাদশা নিয়ে আসেন ডলার, অস্ত্র ও ফেনসিডিলের বড় বড় চালান। একই ভাবে ভারতের সুধীর, সাক্ষাত ওরফে সক্ষাত ও কবির সিন্ডিকেটের মাধ্যমেও বাদশা চোরাচালান পণ্য আনা-নেয়া করেন।

জানা গেছে, শার্শার নারানপুরে তার রয়েছে পাঁচতলা বাড়ি। এছাড়া ভারতের বনগাঁতেও তিনি বাড়ি করেছেন। নারানপুরের বাড়িতে বাদশার আমন্ত্রণে স্থানীয় এমপি বেশ কয়েকবার গিয়েছেন। এই এমপি দুধর্ষ বাদশা ও তার অস্ত্রধারী সহযোগীদের নানা অপরাধ কর্মকা-ে ব্যবহার করেছেন। অন্যদিকে এমপির আস্থাভাজন হয়ে ধুরন্ধর বাদশাও সীমান্তের চোরাচালান ঘাটগুলো দখলে নিয়ে বিস্তার করেছেন একচ্ছত্র আধিপত্য।নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বাদশার বিরুদ্ধে হত্যা, অস্ত্র ও চোরাচালান সংক্রান্ত প্রায় দেড় ডজন মামলা রয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলার রায়ে তার ৩২ বছরের সাজা হয়। যদিও এই মামলায় কিছুদিন কারাভোগের পর তিনি জামিনে মুক্তি পান এবং আবারও নেমে পড়েন অবৈধ ব্যবসায়। কুখ্যাত বাদশার বিরুদ্ধে বেনাপোল পোর্ট থানা, শার্শা থানা ও রাজধানী ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা রয়েছে বলে জানা গেছে।

এলাকাবাসী সূত্র জানা গেছে, দুর্র্ধষ বাদশা ধর্মীয় লেবাসে তার অপরাধ তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। অত্যাচার -নির্যাতনের ভয়ে তার বিরুদ্ধে কেউ টু-শব্দ করার সাহস পান না। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও বাদশা ঘাটগুলো বহাল থাকায় তিনি যা ইচ্ছে তাই করছেন। স্থানীয়রা বলছেন, যত দ্রুত সম্ভব বাদশা যুগের অবসান হওয়া উচিৎ। প্রশাসন উদ্যোগী হলেই আওয়ামী লীগের লালিত এ সিন্ডিকেট ভেঙ্গে ফেলা সহজ হবে।