মনিরামপুরের ভরতপুর গ্রামে আমন্ত্রিত ভিক্ষুকদের আনন্দ উৎসবের দু যুগপূর্তি

0

ওসমান গণি, রাজগঞ্জ (যশোর) ॥ আলেয়া বেগম। ষাট বছর পার হলেও কখনো তাল বেলুন ফাঁটানো বা বালিশ খেলা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ হয়নি। দু বেলা দু মুঠো খাবার জোগাড় করতে প্রতিকূলতার মুখোমুখি হওয়া ষাটোর্ধ্ব এ ভিক্ষুক বুধবার আরও ২৫ জনের সাথে এ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পুরস্কার জিতেছেন। আলেয়া বেগমের মত আরও অসহায়, ভিক্ষুক কয়েক শ নারী-পুরুষ দিনভর বেলুন ফাঁটানোসহ নৌকাবাইচ, বালিশ খেলা, হাড়িভাঙা প্রতিযোগিতা ও ফুটবল প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। এর মাঝে পেট পুরে একবেলা আহার করেছেন গোশসহ রকমারি উপাদেয় খাবার দিয়ে। আর বাড়ি ফিরেছেন নতুন পোশাক নিয়ে। এভাবেই নানা আয়োজনের মধ্যে দিয়ে যশোরের মনিরামপুর উপজেলার বন্যাকবলিত মশ্বিমনগর ইউনয়নের ভরতপুর গ্রামে দুস্থদের নিয়ে ‘ঈদ পুনর্মিলনীর’ ২৪ বছর পার হয়েছে। উদ্যোক্তা যশোর জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক,জেলা বিএনপির সাবেক সহআইন বিষয়ক সম্পাদক ও  মশ্বিমনগর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান অ্যাড. আব্দুল গফুর। তিনি জানিয়েছেন, প্রতিবারের মতো এবারও বন্যাকবলিত এ ইউনিয়নসহ আশপাশের ৪১টি গ্রামের
সহস্রাধিক অসহায় মানুষকে নিয়ে ‘ঈদ পুনর্মিলনীর’ িআয়োজন করা হয়। যেখানে দিনভর অসহায় মানুষেরা নানা ইভেন্টে
আমোদ ফূর্তি করেন। অ্যাড. আব্দুল গফুর আরও জানান, ২০০০ সালে ভয়াবহ বন্যায় মানুষের অসহায়ত্ব দেখে এমন উদ্যোগের চিন্তা প্রথম মাথায় আসে। সে চিন্তা থেকেই পরের বছর ছোট পরিসরে আয়োজন করি। তবে ২০০৩ সাল থেকে বেশ বড় করে ‘ঈদ পুনর্মিলনীর’ আয়োজন শুরু করা হয়। আর এ আয়োজনের মূল অতিথি হিসেবে নির্বাচন করা হয় বৃহত্তর মনিরামপুর উপজেলার পশ্চিমাঞ্চলের ৬ ইউনিয়নের ৪১টি গ্রামের ভিক্ষুকদের। যাতে অসহায় এ মানুষগুলো বছরের অন্তত ১টি দিন সাধারণ মানুষের মত উৎসবে মেতে উঠতে পারেন। পেট ভরে ভালো-মন্দ আহার করতে পারেন একসাথে। আবার উপহার নিয়ে বাড়িও ফিরতে পারেন। মশ্মিমনগর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান দেওয়ান আনছার আলী বলেন, গফুর উকিল যখন আমাদের সাথে বিষয়টি শেয়ার করলো, আমাদের কাছেও তা খুব ভালো লেগেছে। আমরা সেই শুরু থেকেই এ আয়োজনে তার পাশে রয়েছি। ঈদের দ্বিতীয় দিন আয়োজন হলেও, কেনাকাটা থেকে শুরু করে সবকিছু শেষ করতে আমরা ঈদের আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে থাকি। আমরা সবাই আনন্দের সাথেই অসহায় মানুষগুলোর সাথে উৎসবে মেতে উঠি। মশ্মিমনগর ইউপির সাবেক সদস্য আবু কাসেম বলেন, আমাদের একটি স্বেচ্ছাসেবী দল রয়েছে। আমরা কুরবানির এক মাস আগে থেকেই প্রকৃত ভিক্ষুক, অসহায়দের চিহ্নিত করি। এরপর নিমন্ত্রণপত্র তৈরি করি। সেগুলো আবার বৃহত্তর এ উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের ৪১ গ্রাম ঘুরে ঘুরে আমন্ত্রিতদের হাতে পৌঁছে দেই। এরপর শুরু হয় আয়োজনটির সফলভাবে বাস্তবায়নের কাজ। উৎসব কমিটির আহ্বায়ক সমাজসেবক আসাদুজ্জামান আসাদ জানান, ১৯জুন বুধবার সকাল থেকেই একে একে নিমন্ত্রিতরা আসতে থাকে। তাদের বসার স্থান নিশ্চিত করার পাশাপাশি শরবত দিয়ে আপ্যায়নের মাধ্যমে শুরু হয় উৎসবের কর্মসূচি। বেলা সাড়ে ১১টায় কপোতাক্ষ নদে নৌকাবাইচ অনুষ্ঠিত হয়। তাতে বিভিন্ন এলাকার ৮টি দল অংশগ্রহণ করে। এরপর চাপাতলা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে আমন্ত্রিতদের মাঝে ফুটবল খেলা অনুষ্ঠিত হয়। ফুটবল খেলা শেষে উদ্যোক্তা অ্যাড. আব্দুল গফুরের বাড়ির প্রাঙ্গনে আমন্ত্রিতদের জন্য খাবারের আয়োজন করা হয়। উৎসব কমিটির আহ্বায়ক আসাদুজ্জামান আসাদ আরও জানান, উৎসবের দ্বিতীয় অংশে উদ্যোক্তার বাড়ির প্রাঙ্গনে আমন্ত্রিত নারী ও শিশুদের নিয়ে বালিশ খেলা, হাড়ি ভাঙা, বেলুন ফাঁটানো এবং পুরস্কার বিতরণীর আয়োজন করা হয়। এসময় বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করা হলেও বাদ যাননি আমন্ত্রিত কোনো অতিথিই। সৌজন্য পুরস্কার হিসেবে পুরুষদের মাঝে লুঙ্গি, মহিলাদের মাঝে শাড়ি এবং শিশুদের মাঝে জামা- কাপড় বিতরণ করা হয়। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও মনিরামপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মুছা, সাবেক চেয়ারম্যান দেওয়ান আনছার আলী, মুক্তিযোদ্ধা কওছার আলী, ব্যবসায়ী নুরুজ্জামান ও শাহিন কবির, সাবেক ইউপি সদস্য আবু কাসেম, মোহাম্মদ আবু, আবু সাঈদ, মোবারক আলী, আব্দুল ওয়াদুদ ও সমাজসেবক আব্দুর রউফ প্রমুখ। এ সময় প্রধান অতিথির বক্তব্যে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও মনিরামপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মুছা বলেন, অসহায়দের সাথে একটি দিন কাটাতে পেরে আমি খুবই আনন্দিত। দেশের প্রতিটি স্থানেই যদি এ ধরনের আয়োজন হতো তাহলে দস্থ মানুষেরাও সবার মত সমানভাবে ঈদের উৎসব ভাগ করে নিতে পারতো। ২৪ বছর ধরে আব্দুল গফুরের এমন আয়োজন দেশবাসীর কাছে উদাহরণ। মোহাম্মদ মুছা আরও বলেন, অনুষ্ঠানে এসে আমি সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিজ্ঞা করলাম। সেইসাথে সমাজের বিত্তবানদের প্রতিও এ ধরনের আরও উৎসব আয়োজনের আহ্বান থাকবে আমার।