ঘূর্ণিঝড় ‘রিমাল’ আতঙ্কে খুলনার উপকূলে নির্ঘুম রাত যাপন

0

জামাল হোসেন,খুলনা॥ ঘূর্ণিঝড় রিমাল আতংকে উপকূলের নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে অনেকে। রাত জেগে স্বেচ্ছাশ্রমে দুর্বল বেড়িবাঁধ সংস্কার করার চিত্র দেখা গেছে। রাতে হালকা বাতাস ও গুম গুম আওয়াজ আতঙ্ক ছড়িয়েছে। ভোরে বৃষ্টির দেখা মেলে। পরবর্তীতে দিনভর হালকা ও মাঝারি বৃষ্টিপাত হয়।
২৫ মে রাতে মোংলা বন্দরে ৭ নং বিপদ সংকেত ঘোষণার পরে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা এলাকায় আতঙ্ক বাড়ে। সাথে সাথে এসব উপকূল এলাকায় ঘূর্ণিঝড় রিমাল মোকাবেলায় মানুষকে সচেতন করার লক্ষ্যে মাইকিংয়ের মাধ্যমে প্রচারণা চালানো হয়। মানুষদের আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। এসব এলাকায় জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়।
এদিকে, দক্ষিণ উপকূলীয় এলাকার অধিকাংশ বেড়িবাঁধই দুর্বল। যদিও পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, খুলনার দাকোপ, বটিয়াঘাটা, পাইকগাছা, কয়রার ৬৩০ কিলোমিটারের মধ্যে মাত্র ১০ কিলোমিটার বেড়িবাধ ঝুঁকিপূর্ণ। আর সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর আওতায় বেড়িবাঁধ রয়েছে ৩৮০ কিলোমিটার। এরমধ্যে ৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। বারবার বাঁধ ভাংায় উপকূলবাসী সংকেত পেলেই আতঙ্কে থাকেন।
খুলনার ও সাতক্ষীরা উপকূলীয় এলাকায় ২০০৯ সালের ২৫ মে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় আইলা। আইলার সেই ক্ষত কাটিয়ে ওঠার আগেই ২০১৩ সালের ১৬ মে মহাসেন, ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই কোমেন, ২০১৬ সালের ২১ মে রোয়ানু, ২০১৭ সালের ৩০ মে মোরা, ২০১৯ সালের ৪ মে ফণী, একই বছরের ১০ নভেম্বর বুলবুল আঘাত হানে। ২০২০ সালের ২০ মে আম্পান, ২০২১ সালের ২৬ মে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস। ২০২২ সালের ১২ মে আসনি, এরপর একই বছরের ২৫ অক্টোবর সিত্রাং এবং সর্বশেষ ‘মোখা’ আঘাত হানে। এসব ঘূর্ণিঝড়ের সময় বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় কয়রা, দাকোপ, আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়ন। যার ক্ষত এখনো শুকায়নি। সর্বশেষ আসে ঘূর্ণিঝড় রিমাল।
উপকূলীয় সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের বেড়িবাঁধের অনেক জায়গা দিয়ে চুইয়ে পানি ঢুকেছে বলে জানা যায়। সুভদ্রাকাটি এলাকার একটি জরাজীর্ণ বাঁধ গভীর রাতে স্বেচ্ছাশ্রমে এলাকাবাসী মেরামত করেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে সেখানে জিও ব্যাগের ব্যবস্থা করা হয়। আর এলাকাবাসী জিও ব্যাগে মাটি ভরে রাস্তা সংস্কার করেন। যে কোন সময় দুর্বল বেড়িবাঁধ নদী গর্ভে বিলীন হয়ে প্লাবিত হতে পারে বিস্তীর্ণ এলাকা। এমন আশংকা নিয়ে নির্ঘুম রাত কাটান খুলনা জেলার কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা, সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর, আশাশুনির ও বাগেরহাট উপকূলের মানুষ।
কয়রা উপজেলার গোবরা গ্রামের বাঁধের পাশে বসবাসকারী আখতারুজ্জামান ও বিল্লাল হোসেন জানান, আইলার সময় ঘাঁটাখালি বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় তাদের বসতবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়। এরপরে প্রায় দুই মাস আশ্রয় কেন্দ্রে থাকেন। সেখান থেকে বাঁধের ওপরে ঝুপড়ি বেঁধে বসবাস শুরু করেন। একপর্যায়ে জনপ্রতিনিধিদের কথায় বাঁধের স্লোবে পুনরায় ঘর তৈরি করে বসবাস করছেন। আইলার ১৫ বছর পরেও তারা নিজ ঠিকানায় ফিরতে পারেন নি। সেখানে বাঁধের পাশে প্রায় শতাধিক পরিবার রয়েছে। তারা রিমাল ঝড়ের সংকেত পেয়ে আতঙ্কে ছিলেন। নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন।
কয়রার দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আছের আলী মোড়ল জানান, তার ইউনিয়নের ঘড়িলাল থেকে চরামুখা খেয়াঘাট, খেয়াঘাট থেকে হলদিবুনিয়া পর্যন্ত বেশি ঝুঁর্কিপূর্ণ।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সালাউদ্দিন জানান, আমাদের আওতায় বেড়িবাঁধ রয়েছে ৩৮০ কিলোমিটার। এরমধ্যে ৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। তবে গাবুরায় মেগা প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। কিছু জায়গায় সমস্যা রয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে কোন সমস্যা হলে সে জন্যে কাজ করার সুযোগ রয়েছে।
খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ড (বিভাগ-২) এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম বলেন, আমার এরিয়ার মধ্যে ৬৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ১০ কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। এছাড়া তাৎক্ষণিক কোন সমস্যা হলে জরুরি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
এদিকে, ঘূর্ণিঝড় ‘রিমালে’র ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে খুলনা উপকূলবর্তী তিনটি উপজেলায় প্রস্তুত ছিল ৬০৪টি আশ্রয় কেন্দ্র। এছাড়া ৩টি মুজিব কিল্লা ও ৫ সহস্রাধিক স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তত ছিল। এসব আশ্রয় কেন্দ্রে ৩ লাখ ১৫ হাজার মানুষের থকার ব্যবস্থা ছিল।
খুলনা জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, উপকূলবর্তী খুলনার তিনটি উপজেলা কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিজ নিজ কর্মস্থলে থাকার জন্যে বলা হয়। সতর্ক থাকার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদেরকে নির্দেশনা দেওয়া হয়।
খুলনা জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফীন জানান, ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতি এড়াতে কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছা উপজেলায় ৫ হাজার ২৮০ জন স্বেচ্ছাসেবককে প্রস্তুত থাকতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। এছাড়া ৬০৪টি সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত রাখা হয়।
অপরদিকে, ঘূর্ণিঝড়-পূর্ব, ঘূর্ণিঝড় সময়কালীন এবং ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী কর্মতৎপরতা সমন্বয় করতে খোলা হয় খুলনা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের বিভাগীয় মনিটরিং সেল। সার্বিকভাবে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত ছিল ফায়ার সার্ভিস।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স খুলনার উপপরিচালক মামুন মাহমুদ বলেন, ঘূর্ণিঝড় রিমালে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের ৩০টি টিম শনিবার সকাল ৬টা থেকে কাজ শুরু করে। এরমধ্যে খুলনায় ১৪টি ফায়ার স্টেশন রয়েছে। যারমধ্যে একটি রিভার ফায়ার স্টেশন আছে। এছাড়া বাগেরহাটে ১০টি এবং সাতক্ষীরায় ৬টি ফায়ার স্টেশনের টিম কাজ করে। খুলনা সদর দপ্তরে স্ট্যান্ডবাই রাখা হয় ২০ সদস্যের স্পেশাল টিম।