আওয়ামী লীগের হাতে মার খাচ্ছে আওয়ামী লীগ

0

বিশেষ প্রতিবেদক ।। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু হতেই আওয়ামী লীগের হাতে মার খেতে শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। গত ২০ ডিসেম্বর লোকসমাজে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, বেনাপোলে নির্বাচনী প্রচারণায় গেলে নৌকা প্রতীকের সমর্থকদের হামলার মুখে পড়েন যশোর-১ (শার্শা) আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল আলম লিটন। এ ঘটনায় তার ১০জন নেতা-কর্মী আহত হন এবং বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। গত ১৯ ডিসেম্বর মনিরামপুরে স্বতন্ত্র প্রার্থী ইয়াকুব আলীর সমর্থকদের ওপর নৌকা প্রতীকের সমর্থকদের হামলা ও মারধরের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ সময় স্বতন্ত্র প্রার্থীর তিন জন সমর্থক আহত হন। এ ঘটনায় থানায় মামলা করতে গেলেও পুলিশ তা গ্রহণ করেনি বলে অভিযোগ করেছেন ইয়াকুব আলীর প্রধান নির্বাচন সমন্বয়ক ( ভোজগাতী ইউনিয়ন) শহীদুল ইসলাম মোড়ল।
উভয় ঘটনায় হামলার শিকার হয়েছেন আওয়ামী লীগেরই নেতা-কর্মী যারা স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন।
যশোর-১ আসনে ঈগল প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন বেনাপোল পৌরসভার সাবেক মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল আলম লিটন। দ্বিতীয় ঘটনায় ভুক্তভোগী যশোর-৫ ( মনিরামপুর )আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক উপকমিটির নির্বাহী সদস্য ও জেলা কৃষক লীগের সহ-সভাপতি আলহাজ এস এম ইয়াকুব আলী। আশরাফুল আলম লিটন নির্বাচন করছেন যশোর-১ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য শেখ আফিল উদ্দিনের নৌকা প্রতীকের বিপক্ষে। ইয়াকুব আলীর মনিরামপুর আসনে প্রতিপক্ষ বর্তমান সংসদ সদস্য ও প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য । শেখ আফিল উদ্দিনের বিরুদ্ধে বহু আগে থেকেই বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর ব্যাপক নির্যাতনের অভিযোগ আছে। তার আশ্রিত সন্ত্রাসী বাহিনী গোটা অঞ্চলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে বলে প্রচলিত আছে। অন্যদিকে পুলিশ প্রশাসনে প্রতিমন্ত্রীর আত্মীয় থাকায় নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড না থাকার আশঙ্কা প্রকাশ করেন মনিরামপুরের আওয়ামী লীগ নেতারা। স্বতন্ত্র প্রার্থী ও সমর্থকদের ওপর হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা এ সকল অঞ্চলের বিরাজমান বাস্তবতাকেই নির্দেশ করে।
প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছে। বিরোধী দলগুলোর অনুপস্থিতিতে বিগত দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো এটিও একটি একতরফা নির্বাচন হতে চলেছে। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। ‘ভোটার বিহীন নির্বাচন’ খ্যাত সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলেও ভোটের প্রচারণা চালাতে পারেনি। আওয়ামী সন্ত্রাসীদের তান্ডবে সারা দেশে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়। বিভিন্ন আসনে বিরোধী দলীয় প্রার্থীদের ওপর হামলা চালিয়ে আহত ও রক্তাক্ত করা হয়। ‘নিশিরাতের নির্বাচন খ্যাত’ সেই নির্বাচনে আগের রাতেই প্রশাসনের সহায়তায় ব্যালট পেপারে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে রাখে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এখন যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের তোড়জোড় চালানো হচ্ছে সেটাও মূলত বিরোধী দল বিহীন নির্বাচন। সরকারের সাথে আঁতাত করে জাতীয় পার্টি ও ১৪ দল আসন ভাগাভাগি করায় এই নির্বাচনের ফলও প্রায় নির্ধারিত। বিগত নির্বাচনগুলোতে সাধারণ জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। ফলে আওয়ামী লীগের অধীনে অনুষ্ঠিত সকল প্রকারের নির্বাচন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় সাধারণ ভোটার। আওয়ামী লীগের অধীনে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ সংসদ সদস্য নির্বাচন হয় ঢাকা -১৯ আসনে । সেই নির্বাচনে মাত্র ১১ শতাংশ ভোট পড়ে।
ব্যাপক ভোটার সংকট মোকাবিলা ও একতরফা আরেকটি জাতীয় নির্বাচন নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করতে সরকারি দল আওয়ামী লীগ নতুন কৌশল নেয়। তারা নিজেদের নেতা-কর্মীদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে উৎসাহিত করে। ফলে দেশজুড়ে প্রায় সকল আসনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে প্রার্থী হন আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত নেতা-কর্মীরা। এখন দেখা যাচ্ছে, এতদিন বিরোধী দলের নেতা-কর্মী ও তাদের বাড়িতে বাড়িতে হামলা চালানোয় পারদর্শী আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা হামলা চালাচ্ছেন নিজের দলেরই নেতা-কর্মীদের ওপর। বিরোধী মতকে সহ্য করার ধৈর্য্য তাদের নেই, তা সে নিজের দলের নেতা বা কর্মী যেই হোক। আওয়ামী লীগের পদধারী নেতা হওয়া সত্ত্বেও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা প্রশাসনের কাছেও সুবিচার পাচ্ছেন না। বৃহস্পতিবার প্রেস ক্লাব যশোরে মনিরামপুরের স্বতন্ত্র প্রার্থী ইয়াকুব আলী , মনিরামপুরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আলী হাসানের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তোলেন। তার দাবি, গত ২০ ডিসেম্বর নৌকা প্রতীকের সমর্থকরা তার কর্মীদের মারধর করলেও উল্টো তাদেরকেই জরিমানা করা হয়। তিনি, এ ধরনের ঘটনার প্রতিকার চান। অন্যদিকে, হামলার শিকার যশোর-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল আলম লিটন বলেন, এ অবস্থায় আসলে যে ফ্রি ফেয়ার নির্বাচনের কথা হচ্ছে তা কতটুকু সম্ভব হবে জানি না। প্রতি ইউনিয়নে এরকম ১০/১৫ জন সন্ত্রাসী প্রতি জায়গায় হুমকি দিচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে যোগাযোগ করা হলে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক অধ্যাপক নার্গিস বেগম বলেন, আমরা বরাবরই বলে এসেছি নির্বাচন করার পরিবেশ দেশে নেই। ন্যূনতম আইনের শাসন না থাকায় সারাদেশ আজ আওয়ামী সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। এসব সন্ত্রাসী আমাদের নেতা-কর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর করেছে। আজ তারা নিজেরাই নিজের প্রতিপক্ষ। একটি ন্যাক্কারজনক ও এক তরফা নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখাতে নিজেদের নেতা-কর্মীদের ডামি প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করানোর যে কৌশল আওয়ামী লীগ নিয়েছে তা বুমেরাং হয়ে তাদের নিজেদেরই আঘাত করছে।