বিশ্ব রাজনীতিতে জোট না জট পেকেছে

0

 

নাজমুল আহসান ।। জি-২০ ভুক্ত দেশগুলো বিশ্ব উৎপাদনের ৮০ শতাংশ এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের ৭৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। যার মধ্যে রয়েছে বিশ্বের উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো। পাশাপাশি এবারের সম্মেলনে ৫৫টি আফ্রিকান দেশের সংগঠন আফ্রিকান ইউনিয়নকে জোটের স্থায়ী সদস্য করা হয়। তবে বিভক্তির একটি প্রকাশ হচ্ছে, সম্মেলনে চীন ও রাশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানদের অনুপস্থিত। তাই জি-২০ বিশ্ব বিভক্তিকে কতটা দূর করতে পারল, বিশ্বব্যাপী ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে কতটুকু অগ্রগতি অর্জন করতে পেরেছে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। যদিও সম্মেলনের ঘোষণায় বিশ্বে বৈষম্য হ্রাস, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই উন্নয়ন, সমন্বিত ও বহুপাক্ষিক বিশ্বব্যবস্থা এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর ঋণের বোঝা হ্রাস, খাদ্য সংকট মোকাবিলা ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি মাথায় রেখে সবুজ পৃথিবী গঠন ইত্যাদি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। পাশাপাশি এই ঘোষণায় জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত লক্ষ্য অর্জনে কার্বনকর আরোপ, জীবাশ্ম জ্বালানিতে ভর্তুকি বন্ধ, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। তবে সম্মেলনের সবচেয়ে ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত অর্জন হিসেবে বলা হয়, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের বিপরীতে ভারত থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ইউরোপ পর্যন্ত একটি বাণিজ্য রুট প্রতিষ্ঠার ঘোষণা।
এই সম্মেলনের কিছুদিন আগে গত ২২-২৪ আগস্ট সাউথ আফ্রিকার জোহানেসবার্গের ব্রিকসের শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। অনেকেই ব্রিকসকে পশ্চিমাবিরোধী জোট হিসেবে উল্লেখ করে থাকে। এবারের ব্রিকসের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে, নতুন সদস্যদের অন্তর্ভুক্তি যাদের অনেকের সঙ্গেই আবার পশ্চিমাদের দা-কুমড়া সম্পর্ক। আগামী বছর থেকেই ব্রিকস এগারো সদস্যের জোটে পরিণত হতে যাচ্ছে। নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও ব্রিকস শেষ পর্যন্ত নতুন সদস্য গ্রহণে আগ্রহী হয়ে ওঠে। বলা হচ্ছে, এই জোটের সদস্য হওয়ার জন্য ত্রিশটিরও বেশি দেশ আগ্রহ প্রকাশ করে। রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধের পর পশ্চিমের সঙ্গে উন্নয়নশীল দেশগুলোর এক ধরনের বিভেদ চোখে পড়ে। স্বভাবতই ব্রিকসে চীন ও রাশিয়ার আগ্রহ বেশি যেমনটা অনাগ্রহ জি২০ নিয়ে। অন্যদিকে জি২০ নিয়ে যাদের আগ্রহ আছে, তারা চীনের মোকাবিলায় ভারতের আপাত মিত্র হলেও ভারত তাদের সবাইকে সন্তুষ্ট করতে পারছে, তেমনটাও নয়। জি২০ সম্মেলনের পরই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ভিয়েতনাম সফর করেছেন, সেখানে গিয়ে তিনি অভিযোগ করেছেন ভারতে তাকে সাংবাদিকদেও সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া হয়নি এবং অন্যদিকে খালিস্তান ইস্যুতে কানাডা ও ভারতের মধ্যে কূটনৈতিক অস্থিরতা চরমে।
শিল্পোন্নত দেশগুলোর সংগঠন জি৭-এর সঙ্গে উদীয়মান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে নিয়ে জি২০ জোটের গঠন। এ বছর ছিল ১৮তম জি২০ সম্মেলন এবং একই সঙ্গে ১৫তম ব্রিকস সম্মেলন। বিকসের ঘোষণায় বিশে^ অন্তর্ভুক্তিমূলক বহুপাক্ষিক ব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘের সনদের মূলনীতি ও উদ্দেশ্য সমুন্নত রাখার কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি ব্রিকসের ঘোষণায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থা বলেছে মুক্ত, স্বচ্ছ, ন্যায্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন ও ন্যায়-নীতির ভিত্তিতে বাণিজ্যনীতির কথা। এই ঘোষণায় মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যকার উত্তেজনা প্রশমনকে স্বাগত জানানো হয়েছে এবং সিরিয়ান সার্বভৌমত্ব শিকার করে নেওয়া হয়েছে। দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূমিতে অবৈধ ইসরায়েলি বসতি স্থাপন ও অব্যাহত সহিংসতায় যে মানবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে সে সম্পর্কে উদ্বেগ জানানো হয়েছে। ব্রিকসের ঘোষণায় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কারে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ব্রিকস আসছে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের সফলতা এবং ২০২২-এর বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ক্ষয়ক্ষতি তহবিল গঠনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। প্যারিস জলবায়ু চুক্তির বাস্তবায়ন, প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুত জলবায়ু তহবিলের সংস্থান, অভিযোজনের জন্য তহবিল দ্বিগুণ করা ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ করেছে।
এর আগে ১৯-২১ মে ২০২৩ সালে জাপানের হিরোশিমায় জি৭-এর ৪৯তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই তিনটি জোটের মধ্যে এটি হচ্ছে সবচেয়ে পুরনো এবং নিঃসন্দেহে বিশ্ব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মঞ্চে সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী। অন্যদিকে জি৭ সম্মেলনের অন্যতম আকর্ষণ ছিল, সম্মেলনের মাঝে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের সম্মেলন কেন্দ্রে উপস্থিতি ও সমর্থন আদায়। অন্য দুটি সম্মেলনের ক্ষেত্রে জেলেনস্কি যা করতে সমর্থ হয়নি। এমনকি জি৭-এর মতো ব্রিকস ও জি২০ রাশিয়ার বিরুদ্ধে সরাসরি সমালোচনাও করেনি। অন্যদিকে সম্মেলনে জি৭ নেতৃবৃন্দ রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপে একমত পোষণ করে। এ সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য রাশিয়ার বিরুদ্ধে নতুন নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করে। জি৭ চীনের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন না হয়ে কীভাবে অর্থনীতিকে ঝুঁকিমুক্ত করা যায়, সরবরাহ কীভাবে চীনের বাইরে বৈচিত্র্যমুক্ত করা যায় তার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। জি৭ নেতৃবৃন্দ প্যারিস জলবায়ু চুক্তি বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করলেও কীভাবে লক্ষ্যে পৌঁছানো যায় সে সম্পর্কে কোনো পথনির্দেশিকা প্রদানে ব্যর্থ হয়েছে। তবে জি৭-এ জ্বালানি রূপান্তরের অংশীদারত্বের কথা বলা হয়েছে এবং বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বহুপাক্ষিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিকাশের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। জি৭ দেশগুলো ২০৩৫ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ বা বেশিরভাগ জ্বালানি খাত কার্বনমুক্ত করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে। আবার একই সঙ্গে দেশগুলো যে পরিকল্পনা করেছে তাতে প্রাকৃতিক গ্যাস খাতে বিনিয়োগের কথা হয়েছে। অন্যদিকে জি৭ সম্মেলনে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সুরক্ষায় প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছে। যেহেতু সম্মেলনটি হয়েছে জাপানের হিরোশিমায় তাই স্বাভাবিকভাবেই পরমাণু অস্ত্রের বিস্তার রোধে উদ্যোগ গ্রহণ একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। পাশাপাশি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, মহামারী প্রতিরোধে বিশ্বব্যাপী টিকা উৎপাদনে বিনিয়োগ, অন্তর্ভুক্তিমূলক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, শান্তি, সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিতে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।
পর পর তিনটি বড় সম্মেলনের আলোচনা, ঘোষণা ও ফলাফল পৃথিবীতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা প্রকাশ করে। জি২০ সম্মেলনে চীনের বিরুদ্ধে ভারত ও পশ্চিমা সহযোগী বিশেষ করে মার্কিনিদের প্রচেষ্টা ছিল, অন্যদিকে ব্রিকসের ভূমিকা ছিল পশ্চিমাবিরোধী, আবার জি৭ সম্মেলনে চীন ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে সদস্য দেশগুলোর অবস্থান স্পষ্ট।
মূলত বিশ্বে যুদ্ধ চলছে দ্বিপক্ষীয়, একটি হচ্ছে অর্থনৈতিক যুদ্ধ অন্যটি সরাসরি সামরিক। অর্থনৈতিক যুদ্ধে প্রতিপক্ষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ শুরু করেছে এবং এই মুহূর্তে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। অন্যদিকে রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ, যেখানে প্রতিপক্ষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা জোট ও অন্যদিকে সরাসরি যুক্ত না থাকলেও রাশিয়ার প্রতি সমর্থন জোগাচ্ছে আফ্রিকা ও এশিয়ার বেশ কিছু উন্নয়নশীল দেশ। আবার এ সময়ের হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যকার যুদ্ধ এখন হয়তো বিশ্বরাজনীতির ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যুক্ত করছে। বিশ্বরাজনীতি এখন আর একদিকে আমেরিকা, ইউরোপ ও অন্যদিকে রাশিয়া ও চীন বা ভারতের মধ্যে থাকল না, রাজনীতির মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য হঠাৎ প্রবলভাবে ঢুকে পড়ল।
সবকিছু পর্যালোচনায় মনে হয়, সংকট সমাধানে জি৭, জি২০, ব্রিকস বা আরও বড় বড় বহুপাক্ষিক ব্যবস্থাগুলো হয়তো ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ছে। বিশ্ব সম্প্রতি ও বিশ্ব সমৃদ্ধির যে আকাক্সক্ষা থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ব্যবস্থাগুলো গড়ে উঠেছিল তা ধীরে ধীরে নিজেদের জাতি ও গোষ্ঠীগত স্বার্থের কাছে নতি শিকার করতে বাধ্য হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে উপেক্ষিত থাকছে বিশ্ব শান্তি ও সামাষ্টিক উন্নতির দৃষ্টিভিঙ্গি। বিশ্ব আজ ভয়াবহ মানবাধিকার ও গণতন্ত্রহীনতার ঝুঁকিতে আছে, আর এই ঝুঁকি তৈরি হয়েছে জোট রাজনৈতিক হীন স্বার্থ আদায়ের প্রচেষ্টা থেকে। কারণ গণতন্ত্র ও মানবাধিকার শুধু রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না, একে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বিস্তৃত পরিসরে চর্চার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে তা নাহলে বিশ্ব শান্তিতে জট পাকাতেই থাকবে।
(লেখক: উন্নয়নকর্মী ও কলামিস্ট)