বিস্ময়ের বাংলাদেশ: সম্ভাবনা আর অন্ধকারে মাঝামাঝি

0

 

শরিফুজ্জামান শরিফ ।। আসছে ডিসেম্বরে বাংলাদেশ তার বিজয়ের ৫২ বছর পূর্ণ করবে। তার প্রাক্কালে এই লেখা, চেষ্টা করছি জানতে কতোটুকু এগুলো সেই দেশটা? যে দেশটা তার বিজয়ের পথে অসংখ্য লড়াই আর সংগ্রামের ভেতর দিয়ে এগিয়েছে। শত- সহস্র- লাখো শহিদের আত্মত্যাগ আছে তার সুদীর্ঘ সংগ্রামে। হঠাৎ করে জন্ম নয়- একটু একটু করে এগোতে হয়েছে তাকে আবার কখনো পিছাতে হয়েছে লক্ষ্য পুরনের কৌশল অর্জন করতে । পৃথিবীর বহু দেশের স্বাধীনতার থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভিন্নতা আছে। আলোচনার টেবিলে বসে- মানচিত্র ধরে ভাগাভাগি নয়, এই দেশটি জন্মের ইতিহাস লড়াই- আত্মদান আর যুদ্ধের পরিসমাপ্তির ভেতর। আমাদের পূর্ব পুরুষরা হঠাৎ যুদ্ধে জড়ায়নি। কেন যুদ্ধে যাচ্ছি- জয়ী হয়ে কেমন দেশ গঠন করবো- তার ঘোষণা ছিল, ১৭ এপ্রিল ১৯৭১, মেহেরপুর এর বৈদ্যনাথ তলায় আম বাগানে।
তারা বলেছিলেন, সমতার বাংলাদেশ হবে- মৈত্রীর সমাজ হবে, মানুষের স্বাধীনতা স্বীকার করে নেবো। মানুষ তার মতামত প্রকাশ করতে পারবে- কথায়,লেখায়, চিন্তার প্রকাশে কেউ বাধা দিবে না। বাংলাদেশের ভিত্তি হবে চিন্তার স্বাধীনতা- বলার স্বাধীনতা, পেশার স্বাধীনতা- বাচবার স্বাধীনতা সরকার পছন্দ করার স্বাধীনতা থাকবে।
কিন্তু সেই বাংলাদেশ আমাদের থাকেনি, নাগরিকের অধিকার থাকেনি- সমতা প্রতিষ্ঠা হয়নি, সাম্যের সমাজ হয়নি। তার বিপরীতে বিভাজন রেখা স্পষ্ট হয়েছে। বাংলাদেশ আর্থিকভাবে যতটুকু এগিয়েছে আদর্শিকভাবে পিছিয়েছে তার চেয়ে বেশি।
যে বাংলাদেশের জন্য হরি দাসীর সিঁথির সিদুর মুছেছে, কমলা রানীর হাতের সাখা ভেঙেছে- আব্দুল আলী তার সন্তানকে হারিয়েছেন সেই বাংলাদেশ তাদের হয়নি।
বড় লোক- প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত লোকজন ইতিহাস দখল করে নিজেরা ইতিহাসের চালক বনে গেছেন। সেখানে কামার- জেলে- আদিবাসী- গ্রামের গরীব মানুষের যায়গা হয়নি- তাদের অবদান স্বীকৃতি পায়নি।
এক দেশের মধ্যে দুই অর্থনৈতিক কাঠামো- দুই সমাজ- একই সীমানার মধ্যে দুটো রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে।
সেই রাস্ট্র গড়ে উঠেছে যেখানে একজন চা শ্রমিক এর দৈনিক মজুরী ১৭০ টাকা। তাহলে ৩ হাজার ডলার বা তারচেয়ে বেশি মাথাপিছু আয়ের হিসাব কোই? রাষ্ট্র্র তিন হাজার ডলারের গল্প বলে তৃপ্তির হাসি দেয় কিন্তু পোশাক শ্রমিক মা পুষ্টির অভাবে দুর্বল সন্তানের জন্ম দিচ্ছে- অসুখে সামান্য ওষুধ- চিকিৎসা পায়না, সেটা স্বীকার করে না।
সাত কোটি মানুষের দেশে বাইশ পরিবারের শাসনের অবসান হলেও আঠারো কোটি মানুষের দেশে কয়েক হাজার পরিবার অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে। শরীরে গরম অনুভব করলে বিদেশে চিকিৎসা নিতে যায়। তাদের শিক্ষা- চিকিৎসা- বিনোদন- জীবনাচরণে দেশের সংস্কৃতি, অর্থনীতির কোন ছাপ নেই। লাখ লাখ বেকার যুবকের চাকরি নেই, স্বস্তি নেই। বাজারে বড় মাছটি যেমনি টাকাওয়ালা বাবার ঘরে যায় তেমনি গ্রাম শহরের বড় চাকরিটি বড়লোক বাবার সন্তানের জন্য নির্ধারিত। যে বাবার টাকা বেশি সে তার সন্তানের জন্য একটা ভালো চাকরি কিনে নেন। শহর কেন্দ্রিক অবকাঠামোগত উন্নয়ন আছে কিন্তু শিল্পায়ন নেই,কমিশন- বাণিজ্য- তদ্বির- ফটকাবাজী এখন কর্মসংস্থান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
গ্রামের সাথে শহরে বৈষম্য- জেলার সাথে অপর জেলার বৈষম্য প্রকট হচ্ছে। যোগাযোগ এর ক্ষেত্রে দৃশ্যমান অগ্রগতি আছে কিন্তু তার খরচ নিয়ে অস্বচ্ছতা আছে। শিক্ষার হার বাড়লেও তার মান বাড়েনি। যা শেখানো হচ্ছে তাতে সু নাগরিক তৈরি হওয়ার সম্ভাবনার বিপরীতে সমাজের বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
আঞ্চলিক রাজনীতি, বৈদেশিক সম্পর্কের বেলায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা দেশটি বিদেশিদের খেলার দাবার কোট হতে চলেছে। রাজনীতিতে বিদেশিদের খবরদারী, যথেচ্ছ হস্তক্ষেপ একটা স্বাধীন দেশের জন্য অসম্মানজনক হয়ে উঠছে।
মানুষের অধিকার সংকুচিত করে ফেলা- কেড়ে নেয়া- মানবাধিকার ও ভোটাধিকারের অনুপস্থিতি, প্রতিষ্ঠান ধ্বংস বিদেশিদের নাক গলাতে প্ররোচিত করছে।
অর্থনীতির জগৎ চলে গেছে পুরোপুরি লুটেরাদের হাতে, ঋন খেলাপি নামের ব্যাংক ডাকাতের কব্জায় আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণ । এরা আবার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে, আইন প্রনেতা হচ্ছে। সামাজিক নেতৃত্ব নিয়ে নিচ্ছে।
কিন্তু তারপরও অর্থনীতি- সমাজ এগুচ্ছে। প্রান্তিক মানুষের শ্রম অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে। গ্রামের গরীব কৃষক- শহরে থাকা তার কিশোরী মেয়েটার হাতে বানানো পোশাকের রপ্তানি থেকে আয়- বিদেশে যাওয়া তার সন্তানের পাঠানো রেমিট্যান্স অর্থনীতিতে আলো ছড়াচ্ছে। গত দুই বছরে বিশ লাখ তরুন বিদেশে গিয়েছে। লাখ লাখ অভিবাসী যুবকের শ্রম অর্থনীতির প্রাণ ভোমরা হলেও সেই শ্রমের স্বীকৃতি আছে? আমরা মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠিয়েছি-পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বানাচ্ছি- টানেল বানাচ্ছি, অবশ্যই এগুলো আমাদের সক্ষমতার উদাহরণ। কিন্তু এগুলো বলতে গিয়ে আমরা অনেক সময় অর্ধেক সত্য বলি। আমাদের এগিয়ে যাওয়ার অফুরন্ত সম্ভাবনা আছে।যে জাতি যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করে তার এগিয়ে যাওয়াকে বাঁধা দিয়ে রাখে এমন সাধ্য কার? আমরা দুই হাজার কোটি টাকা দিয়ে স্যাটেলাইট বানালাম। আগে বানাতে পারলে আরো ভালো হতো, কিন্তু আমাদের অনেকে এটা বলতে চান না যে, বেসিক ব্যাংক থেকে বাচ্চু নামের এক সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ৭ হাজার কোটি টাকা লুটে নিলো তা যদি সরকার উদ্ধার করতে পারতো আমরা আরো তিনটি স্যাটেলাইট বানাতে পারতাম।
কয়টা হাসপাতাল বানাতে পারতাম, জনতা ব্যাংক দুজন মানুষকে ৯ হাজার কোটি টাকা দিয়ে দিলো! এ টাকা দিয়ে আমরা পাচটি স্যাটেলাইট পাঠাতে পারতাম।
গত কয়েক বছরে ৪৫ হাজার কোটি টাকা খেলাফি ঋন মাফ করে দিলাম! এখনো খেলাপি ঋন চার লাখ কোটি টাকা এটা উদ্ধার করতে চাইনা, যদিও আপনি যদি দশ হাজার টাকা নিয়ে জমিতে সার দেন- সেই টাকা আদায়ে রাষ্ট্র আপনাকে জেলে পর্যন্ত নিয়ে যায়।
আপনার মা গ্রামের বাড়ি থাকেন। তার অসুস্থতার খবর জেনে তার চিকিৎসার জন্য আপনি দশ হাজার টাকা পাঠাবেন, ব্যাংকে গেলে আপনাকে এই কাগজ সেই কাগজ দেখাতে হবে কিন্তু একজন মানুষ সরকারের কোন নিয়ম না মেনে ১ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাঠালেন-তিনি বিদেশে এই টাকা বিনিয়োগ করবেন, এই বেআইনি কাজটির প্রতিকার পেতে একজন আদালতের কাছে গেলেন আদালত বলে দিল আগামী বছরের জানুয়ারির আগে এটা নিয়ে কোন শুনানিও হবে না।
আপনি আমাকে সেতু দেখান-রাস্তা দেখান, চীন- ইউরোপ- আমেরিকা প্রতি কিলোমিটার রাস্তায় ১৫/ ৩০ কোটি টাকা খরচ কওে,আমি সেই রাস্তায় কেন ৮৫- ৯০ কোটি টাকা খরচ করবো? আপনি এ প্রশ্নটি তোলেন না! ২৯ পয়সার ব্যান্ড উইথ কেন আমাকে ২০০ টাকায় কিনতে হবে? আমি সেটা জানতে চাই, আপনি চান না। আপনার সাথে আমার পার্থক্য এখানে।
গত কয়েক বছর ৬ লাখ কোটি টাকা যে পাচার হলো তাতে আপনি বিচলিত হন না। আমরা কালো কে কালো বলতে পারছিনা- অর্ধশতক পেরিয়ে আসা দেশটিতে উৎপাদনশীল একটা সমাজ দরকার – সমতার অর্থনীতি দরকার, সহনশীল রাজনীতি দরকার- দরকার গণতান্ত্রিক শাসন, শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। সেই পথে আমাদের হাটতে হবে-পথ যতোই কঠিন হোক।
[শরিফুজ্জামান শরিফ, সাবেক সভাপতি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন,
টকশো ব্যক্তিত্ব।]