যশোরে ৬টি আসনেই একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী নির্বাচন ঘিরে আ.লীগের তৃণমূলে বাড়ছে বিভক্তি

0

 

স্টাফ রিপোর্টার ॥ আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে যশোর আওয়ামী লীগের তৃণমূলে বিভক্তি বাড়ছে। গত ১৪ বছরে টানা ক্ষমতায় থাকা অনেক এমপিই এখন দলের ভেতরে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন। স্থানীয় নেতারা একে অপরের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য সমালোচনাও বাড়িয়ে দিয়েছেন। এতে করে সামনে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের আশঙ্কা স্পষ্ট হয়ে উঠছে বলে সব মহলে আলোচনা হচ্ছে।
রাজনৈতিক পরিসংখ্যানমতে, বিরোধীদলের অংশগ্রহণ ছাড়া ভোটারবিহীন এক তরফা নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের গত ১৪ বছরের শাসনামলে যশোর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা কার্যত সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের চেয়ে হালুয়া-রুটি ভাগাভাগিতেই ব্যস্ত সময় পার করেন। বিশেষ করে দলটির এমপি ও জেলা পর্যায়ের শীর্ষ নেতাদের ঘিরে একাধিক সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। এসব সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত নেতা-কর্মীদের দলীয় সাংগঠনিক কর্মকান্ডের চেয়ে বেশি প্রাধান্য ছিলো অবৈধ পন্থায় টাকা কামানো। এসব কারণেই অভ্যন্তরীণভাবে দলটির জেলা ও তৃণমূল পর্যায়ে একাধিক গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়ে। যা প্রকারান্তরে সংগঠনটির অঙ্গ সংগঠনের ওপরও বড় প্রভাব ফেলে। বিগত কয়েকটি স্থানীয় নির্বাচনে এর প্রমাণ পাওয়া যায়।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই যশোর আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে হচ্ছে। খোদ যশোর জেলা আওয়ামী লীগই এখন ত্রিধাবিভক্ত। এর আগে জেলা আওয়ামী লীগ দুই ভাগে বিভক্ত ছিলো। এর একটি নেতৃত্বে ছিলেন, সদর আসনের সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ ও অপরটি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক যশোর-৬ আসনের সংসদ সদস্য শাহীন চাকলাদার। এই দুই নেতার অনুসারীদের মধ্যে ইতঃপূর্বে একাধিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ঘটনাও ঘটেছে। তবে দ্বাদশ নির্বাচনকে ঘিরে দ্বিধাবিভক্ত জেলা আওয়ামী লীগ এখন ত্রিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে। এক সময়ে কাজী নাবিল আহমেদের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলনেরও একটি গ্রুপ তৈরি হয়েছে। ইতোমধ্যে শহিদুল ইসলাম মিলন আসন্ন দ্বাদশ নির্বাচনে যশোর সদর আসন থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে বিভিন্ন স্থানে গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। এতে করে সামনে এই আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় বিভ্িক্ত চরম পর্যায়ে যেতে পারে।
শুধু যশোর সদর আসন নয়, জেলার অন্যান্য উপজেলাতেও একই অবস্থা। বরং কোনো কোনো উপজেলাতে দলীয় কোন্দল প্রকট। দলীয় এমপিদের সাথে তৃণমূলের বৃহৎ একটি অংশের অনেক দূরত্বও লক্ষ্য করা গেছে। এসব এলাকায় মনোনয়নপ্রত্যাশীর ছড়াছড়ি।
যশোর (শার্শা)-১ আসনে গত ১৪ বছর ধরে টানা তিন বারের সংসদ সদস্য শেখ আফিল উদ্দীন এমপির সাথে দলটির তৃণমূল নেতাকর্মীদের বড় একটি অংশের দূরত্ব রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে সেটি আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। বর্তমান দলের মধ্যে বড় বিভক্তি তৈরি হয়েছে। একই আসনে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আশরাফুল আলম লিটন গতবারের মতো এবারও মনোনয়ন প্রত্যাশায় মাঠে আছেন। এছাড়াও ওই আসনে জেলা আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক মুজিব-উদ-দ্দৌলা সরদার কনক দলীয় মনোনয়নের প্রত্যাশায় মাঠে প্রচারণা অব্যাহত রেখেছেন। এতে করে নেতা-কর্মীরা ত্রিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছেন।
এছাড়া যশোর-২ (ঝিকরগাছা-চৌগাছা) আসনে দলীয় সংসদ সদস্য মেজর জেনারেল (অব.) অধ্যাপক ডা. মো. নাসির উদ্দীনের বিপরীতে ৯জন মনোনয়নপ্রত্যাশী মাঠে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা হলেন বর্তমান সংসদ সদস্য, যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি অ্যাডভোকেট আহসানুল হক, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাবেক সংসদ সদস্য মো. মনিরুল ইসলাম, সাবেক বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ও তার ছেলে যশোর জেলা আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সদস্য মোস্তফা আশীষ ইসলাম, কেন্দ্রীয় আওয়ামী যুবলীগ নেতা মো. আনোয়ার হোসেন, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আলী রায়হান, চৌগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা এস এম হাবিবুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক ও ইউপি চেয়ারম্যান মেহেদী মাসুদ চৌধুরী, উপজেলা চেয়ারম্যান ড. মোস্তানিছুর রহমান, বেপজার সাবেক সভাপতি ও মেজর জেনারেল (অব.) হাবিবুর রহমান খান, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা কামাল হোসেন, ডা. মো. তৌহিদুজ্জামান, ঝিকরগাছা উপজেলার হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি গিলবাট নির্মল বিশ্বাস।
যশোর-৪ (বাঘারপাড়া-অভয়নগর) আসনে নির্বাচনকে ঘিরে দলটির অভ্যন্তরীণ বিরোধ চরমে। ওই আসনের সংসদ সদস্য রণজিৎ কুমার রায়কে চ্যালেঞ্জ দিয়েছে দলটির ৮ জন মনোনয়নপ্রত্যাশী। প্রতিনিয়ত তারা প্রচার-প্রচারণা অব্যাহত রেখেছেন। তারা প্রতিনিয়ত আলাদা আলাদা কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছেন। যেকারণে দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও একাধিকভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। ওই আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী ইঞ্জিনিয়ার বিপুল ফারাজী বলেন, দলীয় মনোনয়নের প্রত্যাশায় মাঠে আছেন। এক্ষেত্রে দলের তৃণমূলের বৃহৎ একটি অংশ তার সাথে আছে বলে তিনি দাবি করেন। বিপুল ফারাজী ছাড়াও দলের একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশীরাও মাঠে চষে বেড়াচ্ছেন। এতে দলীয় কোন্দল চরমে উঠার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
যশোর-৫ (মণিরামপুর) আসনেও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে দলীয় কোন্দল মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ওই আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্যর বিপক্ষে অন্তত ৯ জন মনোনয়নপ্রত্যাশায় মাঠে আছেন। এরমধ্যে জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আব্দুল মজিদ, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ধর্মবিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য এসএম ইয়াকুব আলী, আওয়ামী লীগ নেতা কামরুল হাসান বারী, অ্যাডভোকেট খান টিপু সুলতানের স্ত্রী ডাক্তার জেসমিন আরা ও পুত্র কেন্দ্রীয় যুবলীগ ও জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য হুমায়ুন সুলতান, জেলা যুবলীগের সভাপতি ও যশোর সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মোস্তফা ফরিদ আহমেদ চৌধুরী, মনিরামপুরের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন লাভলু। এ ছাড়া বর্তমান সংসদ সদস্য স্বপন ভট্টাচার্যের সহোদর আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য পীযূষ কান্তি ভট্টাচার্য রয়েছেন। আসন্ন নির্বাচনে প্রার্থী বদলে একাট্টা এসব মনোনয়নপ্রত্যাশীর অধিকাংশরাই।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ধর্মবিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য এসএম ইয়াকুব আলী বলেন, তিনি ওই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে মাঠে আছেন। দল তাকে মূল্যায়ন করবে বলে তিনি আশা করেন।
যশোর-৬ (কেশবপুর) আসনেও আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সংকট রয়েছে। ওই আসনের বিগত দুই বারের টানা সংসদ সদস্য সাবেক জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেক মৃত্যুবরণ করায় উপনির্বাচনে মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার। নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই তিনি কেশবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেন। তবে এরই মাঝে স্থানীয় নেতাদের বড় একটি অংশ তার বিরোধিতা করছে। আসন্ন নির্বাচনে তার বিপরীতে উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান এইচ এম আমীর হোসেন দলীয় মনোনয়ন চাইবেন বলে জানা গেছে। এ আসনের দলীয় নেতাকর্মীরা আগামী নির্বাচনে আর বাইরের কোনো প্রার্থী চান না বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
তবে এ বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন দাবি করেন, যশোর জেলা আওয়ামী লীগের কোথাও কোনো দলীয় কোন্দল নেই। নির্বাচনে দলের কাছে যে কেউ মনোনয়ন চাইতে পারেন। তবে শেষমেষ যিনি নৌকা পাবেন তার পক্ষেই সবাই এক হয়ে কাজ করবেন। এতে কোনো দ্বন্দ্ব সংঘাতের আশঙ্কা নেই বলে তিনি দাবি করেন।