চৌগাছায় এলজিইডির হিসাবরক্ষকের স্ত্রী ঠিকাদার!

0

এম এ রহিম, চৌগাছা (যশোর )॥ যশোরের চৌগাছা এলজিইডি (স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর) অফিসের হিসাবরক্ষক নাজমুল আহসানের স্ত্রী ওই প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদারি করছেন! তবে অভিযোগে জানা গেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নাহিদ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী হিসেবে স্ত্রী ফারজানা নাহিদকে কাগজে কলমে দেখিয়ে হিসাবরক্ষক নিজেই ঠিকাদারি কাজ করছেন।
সম্প্রতি উপজেলা রিসোর্স সেন্টারে (ইউআরসি) পিইডিপি-৪’র অধীনে মেরামত ও এসি সরবরাহ কাজের দরপত্র আহবান করা হয়। কাজটি পেয়েছে এলজিইডির হিসাবরক্ষক নাজমুল আহসানের স্ত্রীর নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নাহিদ এন্টারপ্রাইজ। দরপত্র (শেডিউল) অনুযায়ী রিসোর্স সেন্টারের প্রশিক্ষণ কক্ষের মেঝে টাইলস, মূল কলাপসিবল গেইট স্থাপন এবং এসি স্থাপন কাজ করার কথা। সিডিউলে চারটি ২ টনের এসি স্থাপনের কথা থাকলেও তিনি ২টি ২টনের ও ২টি ১.৫ টনের এসি সরবরাহ করে চারটি ২টনের এসি স্থাপন হয়েছে বলে চলতি বিল দাখিল করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পিইডিপি-৪’র আওতায় উপজেলা রিসোর্স সেন্টার মেরামতের কাজের টেন্ডার আহবান করা হয় গত ২ মে। কাজের প্রাক্কলিত মূল্য ছিলো ৮ লাখ ১৬ হাজার ৯২৯ টাকা। ৮ অক্টোবরের মধ্যে কাজটি স¤পাদনের শর্তে গত ৯ আগস্ট উপজেলা প্রকৌশলী রিয়াসাত ইমতিয়াজ কাজটির কার্যাদেশ দেন। একইদিন দরপত্র চুক্তি স¤পাদিত হয়। চুক্তিমূল্য ছিলো ৭ লাখ ৩৩ হাজার ৭৭২টাকা। চুক্তিপত্রে ফারজানা নাহিদের ছবি এবং সই থাকলেও তিনি চৌগাছা এলজিইডি অফিসে এসে সই করেননি বলে অফিসের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক চাকুরে নিশ্চিত করেছেন। তারা বলেন, হিসাবরক্ষক নাজমুল নিজে তার স্ত্রীর সই করে দিয়েছেন। তাছাড়া হিসাবরক্ষক নিজেই ঠিকাদার হওয়ায় কার্যাদেশের দিনেই চুক্তি স¤পাদন হয়েছে। তা না হলে কার্যাদেশ পেতে ঠিকাদারের অন্তত একদিন সময় লাগার কথা। আরও জানা গেছে, কাজটি স¤পাদন না করেই এমনকি ২টনের ৪টি এসি না দিয়েই চলতি বিল দাখিল করা হয়েছে গত ১০ সেপ্টেম্বর। যেখানে ২টনের ৪টি এসির বিল দাখিল করা হয়েছে ভ্যাট ও আইটি ছাড়া ৪ লাখ ৩৩ হাজার ৭৯৫টাকা। অথচ কাজটির চুক্তিমূল্য অনুযায়ী এটি ১০ শতাংশ কম মূল্যে সরবরাহ করার কথা। এক্ষেত্রে চৌগাছা এলজিইডি অফিসের উপসহকারী প্রকৌশলী বুলবুল আহমেদ বিল তৈরি করার, হিসাবরক্ষক নাজমুল আহসান নিরীক্ষার বা উপজেলা প্রকৌশলী রিয়াসাত ইমতিয়াজ বিলে সই করার সময় কোথাও ৮টনের জায়গায় ৭টন এসি সরবরাহের কথা বা ১০ শতাংশ নিম্ন দরে কাজ সম্পাদনের কথা উল্লেখ করেননি।
অন্যদিকে ইউআরসিতে এসি সরবরাহ বা কোন কাজের জন্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী ফারজানা নাহিদ বা তার কোন প্রতিনিধি যাননি বলে ইউআরসি সংশ্লিষ্টরা নিশ্চিত করেছেন। তারা জানান, সেখানে এসি সরবরাহ করেছেন এলজিইডির হিসাবরক্ষক নাজমুল আহসান।
চৌগাছা উপজেলা প্রকৌশল অফিস সূত্রে জানা গেছে, ছয়-সাত বছর ধরে নাজমুল আহসান এ উপজেলার প্রকৌশলীর দপ্তরে হিসাবরক্ষক হিসেবে রয়েছেন। দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই উপজেলার এলজিইডির অধীন সব উন্নয়ন কাজের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ নিজে নিতে প্রভাব খাটানো শুরু করেন। এ নিয়ে তার স্থানীয় একাধিক ঠিকাদারের সাথে, এমনকি কয়েকজন অফিস স্টাফের সাথেও বিরোধ ও তর্কাতর্কির ঘটনা ঘটেছে। একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনের কাজ সম্পূর্ণ না করেই হস্তান্তরের কাগজে সই করা নিয়ে একজন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে মারতে পর্যন্ত গিয়েছিলেন হিসাবরক্ষক নাজমুল আহসান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ঠিকাদার বলেন, হিসাবরক্ষক নাজমুল তাদের সাথে একাধিকবার খারাপ ব্যবহার করেছেন। তিনি ঠিকাদারি কাজ নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে যার তার দিকে তেড়ে যান। অশ্লীল ভাষা প্রয়োগ করেন।
এদিকে অভিযোগ অস্বীকার করে হিসাবরক্ষক নাজমুল আহসান বলেন, আমি অফিসে বিল নিরীক্ষার দায়িত্ব পালন করি। সে হিসেবে ফাইল তো আমিই ডিল করবো। সরকারি চাকরি করেও ঠিকাদারি করেন প্রশ্নে তিনি বলেন, না আমি করি না। আমার শ্বশুর ওই ঠিকাদারের প্রতিনিধি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নাহিদ এন্টারপ্রাইজের সত্বাধিকারী ফারজানা নাহিদ আপনার কে হন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমার শ্বশুরের মেয়ে। শ্বশুরের মেয়ে আপনার কে হন প্রশ্নে বলেন, আমার স্ত্রী। কাজ সম্পন্ন না করেই বিল দাখিল করেছেন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটা তো সম্পূর্ণ কাজের বিল না। চলতি বিল। যে কাজ করাই হয়নি সে কাজের চলতি বিল হলো কীভাবে প্রশ্নে তিনি বলেন, চার মাস আগে এসিগুলো সরবরাহ করা হয়েছে। এখনও বিল পাইনি। তাই ইউএনও স্যারের কাছে বিলটির তদবিরে গিয়েছিলাম। ১ টন এসি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পরে ইউআরসির অন্য একটি রুমে দিয়ে দেবে বলে জানিয়েছে। তাহলে স্টিমেটে ২ টনে ৪টি ধরা হয়েছে কেন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটা উপজেলা প্রকৌশলী বলতে পারবেন। আপনি হিসাবরক্ষক হয়েও এই প্রতিষ্ঠানের হয়ে ঠিকাদারি করেন কেন প্রশ্নে তিনি বলেন, না, আমি করিনা। এই লাইসেন্সে ওটিএম (ওপেন টেন্ডার মেথড) পদ্ধতিতে ১০ শতাংশ কমে কাজটি পেয়েছে। এই লাইসেন্সে উপজেলায় অন্য ছোট দুটি কাজ ছাড়া কোন কাজ করা হয়নি। তবে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, উপজেলা রিসোর্স সেন্টার মেরামত ও এসি সরবরাহ কাজের সাথে অভিজ্ঞতা সনদ হিসেবেই তিনি ২০১৮-১৯ ও ২০২০-২১ অর্থ বছরে ৮১ লাখ টাকায় চৌগাছা উপজেলার তাহেরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৭৩ লাখ টাকায় দুলালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ৫২ লাখ টাকায় ঝিনাইকুন্ডু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে ৭৮ লাখ টাকা ব্যয়ের উপজেলার সুখপুকুরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ কাজ করেছেন।

গত ৬ মে চৌগাছা উপজেলা প্রকৌশলী রিয়াসাত ইমতিয়াজ যার পেমেন্ট সার্টিফিকেট দিয়েছেন। অর্থাৎ এই ঠিকাদার যে কাজগুলো করেছেন তার সনদ দিয়েছেন। এছাড়াও এডিপি, জাইকা, পিইডিপি ও জিওবিসহ বিভিন্ন ফান্ডের উন্নয়ন কাজের ঠিকাদারি তিনি নিয়মিত করেন।
উপসহাকারী প্রকৌশলী বুলবুল আহমেদ বলেন, বিষয়টি দেখছি। চলতি বিল দাখিল করায় বিষয়টি সেভাবে দেখা হয়নি। যেটুকু কাজ হয়েছে তার চেয়ে বেশি চলতি বিল দাখিল হয়েছে কীভাবে প্রশ্নে তিনি বলেন, স্টিমেটটা অনেক আগের। বিষয়টি ভালো করে দেখছি।
উপজেলা প্রকৌশলী রিয়াসাত ইমতিয়াজ বলেন, সরকারি চাকরিবিধি অনুযায়ী হিসাবরক্ষক ঠিকাদারি করতে পারেন না। তবে তার স্ত্রী তো সরকারি চাকরি করেন না। তিনি বলেন, ঠিকাদারের প্রতিনিধি বিল দাখিল করেছেন। আর অফিসে বিল নিরীক্ষার কাজতো হিসাবরক্ষকই করে থাকেন। ৮টন এসি সরবরাহ না করেই চলতি বিল দাখিল বিষয়ে তিনি বলেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পরে ওই ১টন এসি দিয়ে দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। হিসাবরক্ষকের বিরুদ্ধে ঠিকাদারি করার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ বিষয়ে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইরুফা সুলতানা বলেন, বিল দাখিল হওয়ার পর খোঁজ নিয়ে জেনেছি সেখানে ৮টনের জায়গায় ৭টন সরবরাহ করা হয়েছে। ঠিকাদারকে কাজ সম্পূর্ণ করার পর বিল দাখিলের জন্যে বলা হয়েছে। এলজিইডির হিসাবরক্ষক নিজেই ঠিকাদারি করছেন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটি আমার জানা নেই। তবে হিসাবরক্ষক বারবার বিলটি ছেড়ে দেয়ার জন্যে তদবির করেছেন। ইউএনও বলেন, সরকারি কর্মচারী হয়ে তিনি ঠিকাদারি করতে পারেন না। তাছাড়া তিনি নিজেই তো বিল নিরীক্ষার দায়িত্ব পালন করেন।