চৌগাছায় ভরা মৌসুমেও চালের দাম নাগালের বাইরে

0

এম এ রহিম, চৌগাছা (যশোর)॥ যশোরের চৌগাছায় আমনের ভরা মৌসুমেও চালের দাম সাধারণের নাগালের বাইরে। বাজারে সব চালের দামসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় ওএমএসের দোকানের সামনে বাড়ছে ভিড়। এখানে নিন্মবিত্ত ও মধ্যবিত্তরাও লাইনে দাঁড়াচ্ছেন । চৌগাছা পৌর শহরের স্বর্ণপট্টি মোড়ে শারীরিক প্রতিবন্ধী কবির হোসেনের ছোট্ট একটি চায়ের দোকান রয়েছে। দিনে তার আয় ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে তার সংসার। উপজেলার স্বরুপদাহ ইউনিয়নের আন্দারকোটা গ্রামে বসবাস তার। বড় মেয়ে আন্দারকোটা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণি ও ছোট মেয়ে ২য় শ্রেণির ছাত্রী। ছোট্ট এই চা দোকানের আয় দিয়েই চলে তার সংসার। অল্প আয়ে সংসার চালাতে গিয়ে বেকারিতে ১২/১৩ হাজার টাকা দেনা হয়েছেন । এই কয়েক মাসে চাল-ডাল, আটা-তেল, ময়দা-চিনি, পেঁয়াজ-রসুন, মসলা ও তরি-তরকারির দাম যেহারে বেড়েছে, তাতে সংসার তার গলার কাঁটা হয়ে গেছে। ভাতে ভর্তায় চলছে তার সংসার। কষ্টের কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ তার দু-চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু। ওপেন মার্কেট সেলের (ওএমএস) দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে তার মতো আরো অনেকে জীবন যুদ্ধের গল্প বলতে থাকেন। তারা এসেছেন (ওএমএস) চাল কিনতে। বাজারে সব নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় ওএমএসের দোকানের সামনে লাইনে দাঁড়িয়েছেন তারা। নিন্মবিত্ত ও মধ্যবিত্তরাও লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। তারা জানান, সাধারণ মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। ওপেন মার্কেটে (ওএমএস) লাইনে দাঁড়ানো সুন্দরী বেগমের বৃদ্ধ স্বামী বেকারি কর্মচারী। পৌর শহরের যশোর স্ট্যান্ড এলাকায় দুই ছেলে ও মেয়ে নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকেন। বড় কষ্টে আছেন তারা। বেশির ভাগ দিন ভাতের সাথে আলু সিদ্ধ ও শাকপাতা খেয়েই দিন কাটছে তাদের। মাছ- গোশ কেনার কথা কল্পনারও বাইরে। সুন্দরী বেগম বললেন, আমাদের কষ্টের কথা শুনার কেউ নেই স্যার। এক কেজি সবজি কিনতে লাগে ৩০ থেকে ৪০ টাকা। এখন আর সবজি তেমন খাওয়া হয় না। পাতলা ডালের সাথে কখনো আলু সিদ্ধ, কখনো বা শাক-পাতাড়ি এসবই বেশি খাই। কোরবানির সময় লোকের দেয়া সেই গোশত খেয়েছি। চৌগাছা হুদাপাড়া গ্রামের ভ্যানচালক রফিকুল ইসলাম বলেন, সংসারে স্ত্রী ও ছেলে মেয়ের মুখে দু বেলা দু-মুঠো ভাত দেয়ার জন্যে ভোর বেলাই ভ্যান নিয়ে বের হই আর বাড়ি ফিরি রাত ১০ টায়। আয় রোজগার আগের মতোই আছে। কিন্তু সব কিছুর দাম বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হওয়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। ভ্যানের চাকা ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ঘুরালেও সংসারের চাকা যেন আর ঘোরে না। তিনি বলেন, দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর মাত্র পাঁচ কেজি চাল কিনতে পারব, এটি দুঃখজনক। বড় সংসার, একসাথে ১০ কেজি চাল পেলেও হতো। আবার দুই দিন পর এসে লাইনে দাঁড়াতে হবে। সাইফুল ইসলাস পেশায় একজন লন্ড্রি ব্যবসায়ী। তিনি শারীরিকভাবে দারুণ অসুস্থ। লন্ড্রি থেকে যা আয় হয় তাতে তার ওষুধের টাকাও হয় না। স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে তিনি বসবাস করেন পৌর শহরের ছুটিপুর স্ট্যান্ড এলাকায়। একার আয় দিয়েই সংসার চালাতে হয় তাকে। তিনি বলেন, বলা যায় যুদ্ধ করে বেঁচে আছি। আর পারছি না। এখন মেয়ে দুটোর লেখাপড়া বন্ধ করা ছাড়া কোনো উপায় দেখছি না। কার্তিক চন্দ্র বিশ্বাস পৌর শহরের হিন্দুপাড়ার বাসিন্দা। স্ত্রী অসুস্থ, বোন বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, মেয়ে পড়ে যশোর একটি কলেজে। ছেলে ৪র্থ শ্রেণিতে। ফুটপথে বসে ফল বিক্রি করে যা আয় হয় তাই দিয়ে চলে পাঁচজনের সংসার। পাঁচ কেজি মোটা চালের আশায় সাত সকালেই ওপেন মার্কেট সেলের (ওএমএস) দোকানের সামনে হাজির। পাকা চার ঘণ্টা দাঁড়িয়ে জীর্ণ শরীরে। এ যেন সেই কবিতার আসমানি। পরনে হালকা রঙের ফিনফিনে পোষাক। শীতের সকালে হালকা তেজি রোদে কপাল ভিজে গেছে তার। একটি সুতির ছেঁড়া গামছা দিয়ে বারবার মুখের ঘাম মুছছিলেন। তিনি বলেন, গতদিন সারাক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও চাল পাইনি। খালি হাতে বাড়ি ফিরতে হয়েছে। বর্তমানে বাজারে নিত্যপণ্যের যে দাম তাতে স্বল্প আয়ে সংসার আর চলে না। সকালে পানতা ভাত লবণ-ঝাঁল ডলে খাইছি। অনেক দিন ধরেই ভাতে-ভর্তায় খেয়ে আছি। আমনের ভরা মৌসুমেও চালের দাম সাধারণের নাগালের বাইরে। পাঁচ কেজি চাল (ওএমএস) দোকান থেকে কিনলে ১০০ টাকা কমে পাওয়া যায়। ১০০ টাকা বাঁচাতেই এতো কষ্ট করছি। চৌগাছা বাজারে বাজার করতে আসা গার্মেন্টেস কর্মী সাইদুল আলম বলেন, নিত্যপণ্যের দাম শুধু বেড়েই চলছে, কিন্তু আয় তো আমার বাড়েনি। কম কিনে, কম খেয়ে কোনোমতে দিন পার করছি। তিনি বলেন, অনেক ক্রেতা পণ্যের দাম শুনে না কিনেই ফিরে যাচ্ছেন। যেটা না কিনলেই নয়, সেটিই শুধু কিনছেন। এক কেজির জায়গায় আধা কেজি নিচ্ছেন। দ্রব্যমূল্যের এ অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতিতে মানবেতর জীবনযাপন করছেন আমাদের মত বেশির ভাগ মানুষ। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ইতিহাসের সব রেকর্ড ভেঙেছে। মানুষের ন্যূনতম বেঁচে থাকার জন্য যেটুকু প্রয়োজন, সেটুকু এখন সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। জীবন সংসারে যেন মানুষের হাহাকার নেমে আসছে। চৌগাছা পৌর শহরের ওএমএস এর চালের ডিলার সাহাজ্জেল হোসেন বলেন, বর্তমানে ওএমএস’র চাল প্রতিদিন ডিলার প্রতি দেয়া হয় ৭৫০ কেজি। আগে প্রতিদিন ১৫০০ কেজি চাল দেয়া হতো। বর্তমানে চাহিদার তুলনায় চাল বরাদ্দ অপ্রতুল। তাই অনেকেই ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও চাল পাননা। এ ব্যাপারে উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা ফাতেমা সুলতানা বলেন, ওএমএস’র চাল বিক্রি করার জন্য আমাদের চার জন ডিলার রয়েছে। আগে প্রতিদিন ডিলার প্রতি ১৫০০ কেজি চাল দেয়া হতো। বর্তমানে দেয়া হয় ৭৫০ কেজি করে। বাজারে চালের দাম বেশি হওয়ায় ওএমএস এর চালের দোকানে সাধারণ মানুষের ভিড় বাড়ছে।