সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুলের ভয়াবহ তথ্য বিরোধীদল দমনে সরকারের নয়া কৌশল

0

 

লোকসমাজ ডেস্ক॥ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি বেতার বার্তা ভাইরাল হয়েছে। বাংলাদেশ পুলিশের ঢাকাস্থ স্পেশাল ব্রাঞ্চ হেডকোয়াটার্সের বরাত দিয়ে রাঙ্গামাটি জেলার পুলিশ সুপার (SP – DSB) গত ২৫ সেপ্টেম্বর বেতার বার্তা নং ৩৯০৯ (রাজনৈতিক) মূলে জেলার সকল থানার ওসিদেরকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠনের রাঙ্গামাটি জেলার কমপক্ষে ৮ জন শীর্ষ ব্যক্তি, প্রতি উপজেলার শীর্ষ ৫ ব্যক্তি এবং রাঙ্গামাটি জেলার সকল পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের অধীন কমপক্ষে ৫ ব্যক্তি যারা বর্তমান সরকার বিরোধী চলমান গণআন্দোলনে “জনবল সংগঠক” বা অর্থায়ন করে কিংবা অন্য কোনভাবে সহযোগিতা করে এমন ব্যক্তিদের বিস্তারিত তথ্য যেমন ঠিকানা, মোবাইল নম্বর ও এনআইডি নং ইত্যাদি সংগ্রহ করে তার কাছে প্রথমে ইমেইল যোগে এবং পরে হার্ডকপি পাঠাতে নির্দেশ দিয়েছে। এই বার্তায় ঢাকা স্পেশাল ব্রাঞ্চের মেমো নং ৬১৪(৩৫) তারিখ ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২২ এর রেফারেন্স উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ পুলিশের বিশেষ শাখার HQ এর নির্দেশনা অনুযায়ীই এই বেতার বার্তা পাঠানো হয়েছে। বিএনপি বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছে যে ঢাকাস্থ স্পেশাল ব্রাঞ্চের নির্দেশনা অনুযায়ী সারা দেশের সকল জেলার পুলিশ সুপার নিজ নিজ এলাকার সকল থানার ওসিকে উপরোক্ত বেতার বার্তা অনুযায়ী তথ্য সংগ্রহের জন্য অনুরূপ নির্দেশনা জারি করেছেন যা অত্যন্ত ভয়ংকর, অপ্রত্যাশিত, অসাংবিধানিক, এখতিয়ার বহির্ভূত, গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী আচরণবিধি পরিপন্থী এবং রাজনৈতিক দল তথা গণমানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও আন্দোলন সমাবেশ করার মৌলিক অধিকার বিরোধী।

উল্লিখিত বেতার বার্তার বিষয়বস্তু থেকে এটি প্রমাণিত হয় যে বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থসমূহ বর্তমান ফ্যাসিবাদী সরকারের নির্দেশে একটি নীল নকসার অধীনে চলমান গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে গুঁড়িয়ে দমন করার জন্য একযোগে কাজ করছে। অথচ বর্তমান গণআন্দোলন চলছে মানুষের ভোটাধিকার পুনরুদ্ধার করা, মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ করা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে এবং এরিমধ্যে গত জুলাই থেকে আমাদের দলের ৫ জন নেতা নিহত হয়েছে (ভোলায় ২ জন, নারায়ণগঞ্জে ১ জন, মুন্সিগঞ্জে ১ জন এবং খুলনায় ১ জন) এবং অসংখ্য নেতাকর্মী আহত হয়েছে। দিনে দিনে আন্দোলনের গতি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পুলিশ বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহের নেতাকর্মীদের যে তথ্য সংগ্রহ করছে তা আমাদের সংবিধান, কিংবা দেশের অন্য কোন প্রচলিত আইন বা বিধি বিধানের আওতায় তারা করতে পারেনা। পুলিশ সুপার তার আওতাধীন ওসিদের নিকট বেতার বার্তা বা অন্য কোন ব্যবস্থায় যে সব তথ্য চেয়েছে তা যে কোন মানদণ্ডে বে-আইনি (illegal), স্বেচ্ছাচারি (arbitrary) এবং অননুমোদিত (unauthorized) পদক্ষেপ। এটি দিবালোকের মত পুষ্ট যে বর্তমান সরকার আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করে চলমান গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে দমন করার জন্য রাজনৈতিক দমন-পীড়ন, অত্যাচার-নির্যাতনের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর আর্থিক মেরুদন্ডও ভেঙ্গে দেয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো গণআন্দোলন দমনের হীন উদ্দেশ্যে (with mala fide intention) মানুষ হত্যার জন্য শান্তিপূর্ণ আইনসিদ্ধ গণতান্ত্রিক মিছিলে বিনাউস্কানিতে গুলিবর্ষণ করে নেতাকর্মীদের হত্যা করছে। আমাদের দেশের সংবিধান (অনুচ্ছেদ ২৭, ৩২, ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪১, ৪৪), প্রচলিত আইন এবং আন্তর্জাতিক আইনেও দেশের প্রতিটি মানুষের স্বাধীনভাবে রাজনীতি করা এবং মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা স্বীকৃত রয়েছে। অসৎ রাজনৈতিক উদেশ্য নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই ধরনের বেতার বার্তা বা অন্য প্রকারে তথ্য সংগ্রহ আইনের দৃষ্টিতে অকার্যকর, বেআইনি এবং অসাংবিধানিক। এই উপমহাদেশে Indian Supreme Court-এর অনেক প্রখ্যাত মামলায় (reported in AIR 1980 SC 319) সিদ্ধান্ত রয়েছে যে,

A mala fide exercise of discretionary power is bad as it amounts to abuse of discretion.”

 

আমাদের বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টও অনেক প্রসিদ্ধ মামলায় প্রায় অনুরূপ সিদ্ধান্ত আছে।

অতএব, বর্তমান রাজনৈতিক পটভূমি, আইনের মীমাংসিত নীতি এবং mala fide intention” এর এই সব সংজ্ঞা অনুযায়ী রাঙ্গামাটির SP–DSB, Special Branch HQ এবং সারাদেশের SP–DSB কর্তৃক ওসিদের উদ্দেশ্যে ইস্যুকৃত অনুরূপ বেতার বার্তা কিংবা অনুরূপ নির্দেশনা সর্বতোভাবে একটি “mala fide direction” যা চলমান গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং গণতন্ত্রের পক্ষ শক্তিকে দমন করার হীন উদ্দেশ্যে জারি করা হয়েছে যা অসাংবিধানিক ও আইনগত এখতিয়ার বহির্ভূত।

বেতার বার্তাটি আমাদের কষ্টার্জিত সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে আঘাত করেছে যা রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক চরিত্র, আইনের শাসন, আইনানুগ সংস্থা ও সমাবেশের নিশ্চয়তা, জনগণের বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং আইন অনুযায়ী সমানভাবে আচরণ করার অধিকার এর পরিপন্থী। উল্লিখিত বেতার বার্তা দেশের রাজনৈতিক কর্মীদের সরকারপন্থী এবং সরকারবিরোধী কর্মী হিসেবে বিভাজিত করে চরম বৈষম্য সৃষ্টি করবে। বিরোধী রাজনৈতিক মতবাদের লোকদের আলাদা করে চিহ্নিত করা, দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে ধ্বংস করা এবং সমাজে ভীতি ও ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করাই এই বেতার বার্তার উদ্দেশ্য।

এই সরকার প্রায় দেড় দশক সময়কাল ধরে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলিকে অত্যন্ত বেআইনি ও স্বেচ্ছাচারী পদ্ধতিতে ব্যবহার করে আসছে শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। তারা একটি নীল নকসার অধীনে সামগ্রিকভাবে নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে। কেবল অন্যায়ভাবে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য তারা পুলিশ ও র‌্যাবকে ব্যবহার করে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডসহ অনেক মানুষ খুন ও গুম করেছে। যার ফলশ্রুতিতে এখন দেশে-বিদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা বিশেষ করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব), পুলিশ, গোয়েন্দা শাখা (ডিবি), বিশেষ শাখা (এসবি), অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই) দেশের নাগরিকদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে জড়িত। ইতিমধ্যে র‌্যাবের ডিজি, আইজিপি এবং সাবেক সেনাপ্রধানকে বলপূর্বক গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং অন্যান্য গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে জড়িত থাকার জন্য মার্কিন সরকার কর্তৃক “Sanction”বা নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হয়েছে। বিএনপি মনে করে যে এই সমস্ত নৃশংসতার পেছনে বর্তমান ফ্যাসিবাদী শাসকই মাস্টার মাইন্ড হিসেবে কাজ করছে। এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী উদ্দেশ্যমূলক ভাবে উল্টো বিরোধী নেতাকর্মীদের তথ্য সংগ্রহ করে এক ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টিতে লিপ্ত হয়েছে। এই সমস্ত কাজ শুধু আইনি অধিকারই লঙ্ঘন করে না, নাগরিকদের মৌলিক অধিকারও লঙ্ঘন করেছে।

কোন রাজনৈতিক মতাদর্শ অনুসরণ বা কোন বিশেষ রাজনৈতিক দল করা একজন নাগরিকের মৌলিক অধিকার যা দেশের সংবিধান কর্তৃক সমর্থিত। নিজ নিজ মতাদর্শের রাজনৈতিক দলকে সমর্থন, ইহার সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ এবং বিভিন্ন প্রকারে দলের পক্ষে কাজ করা প্রত্যেক নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নাগরিকের এই মৌলিক অধিকার চর্চায় বাধা প্রদান কিংবা অন্য কোনভাবে হস্তক্ষেপ বা  interfere করতে পারেনা। বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মসূচী বাস্তবায়নে যারা অংশগ্রহণ করে বা অন্যান্যভাবে সাহায্য সহযোগিতা করে তারা আইনানুগভাবেই তা করে থাকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের নাম ঠিকানা, মোবাইল নাম্বার এমনকি এনআইডি নাম্বার আনুষ্ঠানিক অর্থাৎ অফিশিয়ালভাবে সংগ্রহ করার উদ্দেশ্য কি? এটা অস্বাভাবিক। পুলিশ একটি রাষ্ট্রীয় বাহিনী, কোন দলীয় বাহিনী নয়। সরকারীভাবে এসব তথ্য পুলিশের সংগ্রহ করার কথা নয়। এসব তথ্য নিয়ে পরবর্তীতে এসকল ব্যক্তির বিরুদ্ধে হামলা-মামলা দায়ের কিংবা অন্য কোনভাবে হয়রানী করাই এদের উদ্দেশ্য বলে আমরা মনে করি। তাদের এই “mala fide intention” এর কারণে তাদের এহেন কর্মকাণ্ড রাষ্ট্রীয় পুলিশ বাহিনীর কর্মকাণ্ড নয় বরঞ্চ আওয়ামী রাজনৈতিক দলীয় বাহিনীর কর্মকা- বলেই প্রতিভাত হয়। যাহা অনাকাংখিত। যে সকল অতিউৎসাহী দলবাজ কর্মকর্তা এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে সরকারি পদবীর অপব্যবহার করে অত্যন্ত হীন ও নগ্নভাবে এসকল অবৈধ কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত দেশের সচেতন নাগরিকরা তাদের অবশ্যই চিহ্নিত করে রাখবে।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি পুলিশের বিশেষ শাখার  HQ এবং রাঙ্গামাটিসহ সকল জেলার পুলিশ সুপার প্রদত্ত এই ধরনের বেতার বার্তাকে অবৈধ, স্বেচ্ছাচারী এখতিয়ারবহির্ভূত সিদ্ধান্ত বলে মনে করে।
বিএনপি এই ধরনের অবৈধ কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানায় এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহকে এই ধরনের অবৈধ কর্মকাণ্ড বন্ধ করা এবং ভবিষ্যতে নিজদেরকে এই ধরনের আইন ও এখতিয়ারবহির্ভূত স্বেচ্ছাচারী কাজ থেকে নিজদের বিরত থাকার আহবান জানাচ্ছে।