হঠাৎ কালবৈশাখী ঝড়ে যশোরসহ আশপাশের জেলার কয়েকটি এলাকা লণ্ডভণ্ড, ঝিনাইদহে একজনের মৃত্যু

0

 

 

আকরামুজ্জামান ॥ হঠাৎ কালবৈশাখী ঝড়ে যশোরের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বেশকিছু এলাকাসহ আশপাশের জেলার কয়েকটি এলাকা ল-ভ- হয়ে গেছে। ঝড়ে ঝিনাইদহের শৈলকুপায় একজনের মৃত্যু হয়েছে। দুটি মহিষসহ বেশ কয়েক জায়গায় গবাদিপশুর মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। উড়ে গেছে শ শ টিনের চালা। ভেঙে পড়ে অনেক কাঁচা ও আধা পাকা ঘর। উপড়ে পড়ে গাছ-গাছালি। ঝড়ে আক্রান্ত এলাকাগুলোর আম-কাঁঠাল, লিচুসহ সবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলেও খবর পাওয়া গেছে। গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টির কবলে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত বোরো আবাদেরও ঝড়ের কারণে তৃতীয় দফা ক্ষতির কবলে পড়েছে বলে কৃষি বিভাগের সূত্রে জানা গেছে। অধিকাংশ এলাকাতে বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে পড়ায় বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।
যশোর বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান বিমান ঘাঁটি নিয়ন্ত্রিত আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, শনিবার ভোরে ৬টা ১০ মিনিটের সময় হঠাৎ আকাশে তীব্র মেঘের সৃষ্টি হয়। এর কিছুক্ষণ পরেই তীব্র বজ্রপাতের শব্দের মধ্যে দিয়ে বৃষ্টি ও ঝড় শুরু হয়েছে। এ সময়ে এ অঞ্চলে ঝড়ের গতিবেগ সর্বোচ্চ ৩২ নটস রেকর্ড করা হয়। আবহাওয়া অফিসের একজন কর্মকর্তা বলেন, ঝড়ের তীব্রতা মাত্র পনেরো মিনিট সময় স্থায়িত্ব ছিলো। তবে বৃষ্টিপাত চলে সাড়ে সাতটা পর্যন্ত। এ সময়ে যশোরে ১০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয় বলে আবহাওয়া অফিসের ওই কর্মকর্তা জানান।
এদিকে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, মাত্র পনেরো মিনিটের এ ঘূর্ণিঝড়ে যশোরের বেশ কয়েকটি এলাকায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে জেলার সদর উপজেলার হৈবতপুর ও লেবুতলা ইউনিয়নে। এসব এলাকায় বাড়িঘর, গাছ-গাছালি ছাড়াও বিস্তীর্ণ মাঠের সবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়। বিশেষ করে সদরের হৈবতপুর ইউনিয়নের ভাগলপুর, মিরা লাউখালী, রসুলপুর, নাটুয়াপাড়া, বারীনগরবাজার, জোড়াদাহ, হৈবতপুর, মথুরাপুর এলাকাসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রাম ল-ভ- করে দেয় ঘূর্ণিঝড়ে। এর বাইরেও পাশেই বারোবাজারের কাউদিয়া, মাহিদিয়া, মশিহাটি, কাশিমপুর ইউনিয়নের ডহেরপাড়া, দৌলতদিহি, মিরপুর এলাকায় ঝড়ে ফসলসহ ঘরবাড়ির ব্যাপক ক্ষতি হয়। এসব এলাকায় বৈদুতিক খুঁটি উপড়ে পড়ে পুরো এলাকা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। প্রতিটি গ্রামেই অসংখ্য টিনের চালা ঘর উড়ে যায় ঝড়ে। রাস্তার ওপর গাছপালা পড়ে সড় যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে বলে এলাকাবাসী জানান।
হৈবতপুর ইউনিয়নের ভাগলপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মকছেদ আলী বলেন, হঠাৎ ঝড়ের কারণে মানুষ কোনো কিছুই বুঝতে পারেনি। বাতাসের গতি এতোই তীব্র ছিলো যে নিকট-অতীত এমন ঝড় এ এলাকায় এর আগে হয়নি বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। তিনি বলেন, চোখের সামনে ঘর-বাড়ি উড়ে নিয়ে গেলো আল্লাহর রহমতে কোনো মানুষের প্রানহাণির ঘটনা ঘটেনি।
হৈবতপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবু সিদ্দিক বলেন, আমার ইউনিয়নের ১০/১২টি গ্রাম ঝড়ে ল-ভ- হয়ে গেছে। বিশেষ করে বিস্তীর্ণ মাঠের করোলা, লাউ, পেঁপে, আম, লিচু, কাঁঠালের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে পড়ে। এ অবস্থায় ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে এসে সহযোগিতার জন্য সরকারেরর সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।
হৈবতপুর ছাড়াও জেলার সদর উপজেলার ইছালী ও লেবুতলা এলাকায়ও বেশ ক্ষতি হয়েছে। খাজুরা, নোঙরপুর, তীরের হাট, রাজাপুর এলাকার বিস্তীর্ণ মাঠে করোলা ক্ষেতের মাচা ঝড়ে মাটিতে ন্যূয়ে পড়ে। এসব এলাকার আম, লিচু ও কাঁঠালের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ঝড়ে যশোর মাগুরা সড়কের বেশ কয়েক জায়গায় গাছ উপড়ে পড়ায় কিছু সময় সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিলো। পরে স্থানীয়রা তা সরিয়ে দিলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
যশোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) দীপঙ্কর দাশ বলেন, ঝড়ের কারণে যশোরের সবজি জোন এলাকায় প্রায় ১০০ হেক্টর জমির সবজি ক্ষেত ক্ষতির কবলে পড়েছে। এরমধ্যে অধিকাংশ করোলা, কাকরোল ও লাউ ক্ষেত রয়েছে। এসব ফসলের মাচা ঝড়ে পড়ে যাওয়ায় ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর বাইরে বোরো ধান, আম, লিচু ও কাঁঠালসহ বিভিন্ন গাছের ক্ষতি হয়েছে বলে তিনি জানান।
খাজুরা (যশোর) সংবাদদাতা জানান, কালবৈশাখী ঝড়ে যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলায় শতাধিক বসতবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া বোরো ধান, মৌসুমী ফল আম, লিচু, কাঁঠালসহ ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অসংখ্য গাছপালা ভেঙে ও উপড়ে বিদ্যুতের তারের ওপর পড়েছে। এতে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বাঘারপাড়ার বন্দবিলা ও জহুরপুর ইউনিয়নের অর্ধশতাধিক গ্রাম। ঝড়ে গাছের ডাল ভেঙে মাথায় আঘাত পেয়ে এক গৃহবধূ গুরুতর আহত হয়েছেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, ঝড়ে বন্দবিলা ইউনিয়নের পার্বতীপুর, ঘোপদুর্গাপুর, ধর্মগাতী, চন্ডিপুর, পান্তাপাড়া, মথুরাপুর কাজীপাড়া ও মির্জাপুর এবং জহুরপুরের যাদবপুর স্কুলপাড়া এলাকায় সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অধিকাংশ মানুষ খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছে। ঝড়ে আম গাছের ডাল ভেঙে মাথায় পড়লে মথুরাপুর কাজীপাড়া এলাকায় তাসলিমা বেগম (৫২) নামে এক গৃহবধূ গুরুতর আহত হন।
জহুরপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান মিন্টু জানান, ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ঘুরে তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য খাদ্যসামগ্রী, টিন ও আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে।
বাঘারপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রুহুল আমিন জানান, বোরো ধান কাটা প্রায় শেষের দিকে। ঝড়ো বাতাসের কারণে পাট ও তিল ক্ষেতের সামান্য ক্ষতি হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণের কাজ চলছে।
পল্লী বিদ্যুৎ খাজুরা সাব জোনাল অফিসের সহকারী জেনারেল ম্যানেজার আজাদুল ইসলাম জানান, ঝড়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে বৈদ্যুতিক খুঁটি উপড়ে পড়া ছাড়াও গাছের ডাল ভেঙে পড়েছে তারের ওপর। গাছপালা অপসারণসহ বিদ্যুতের খুঁটি মেরামতের কাজ চলছে। পর্যায়ক্রমে সব এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হবে বলে জানান তিনি।
স্টাফ রিপোর্টার, ঝিনাইদহ জানান, ঝিনাইদহে কালবৈশাখী ঝড়ে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অনেক এলাকা জড়ে ল-ভ- হয়ে গেছে। কালীগঞ্জ উপজেলাসহ কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বজ্রবৃষ্টিপাতে মাঠে কাজ করা অবস্থায় রুপসি বেগম নামে শৈলকুপায় এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। কালীগঞ্জে বজ্রপাতে ধানের ক্ষেত পুড়ে গেছে। গাছপালার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সদর উপজেলার ডেফলবাড়ি গ্রামের কৃষক আশরাফুল ইসলামের ৬ লাখ টাকা দামের দুটি মহিষের মৃত্যু হয়েছে বজ্রপাতে। এছাড়া কালীগঞ্জ ও হরিণাকুন্ডু এলাকায় ঝড়ে গাছপালা, ঘরবাড়ি ও উঠতি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। গতকাল শনিবার সকাল ছয়টার দিকে এসব ঘটনা ঘটে। সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় জেলার কালীগঞ্জ ও সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা।
এদিন সকাল ছয়টার দিকে হঠাৎ আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তীব্র ঝড়, বৃষ্টি ও বজ্রপাত শুরু হয়। ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার কুলচারা গ্রামের মাঠে ক্ষেতে বেগুন তুলছিল রুপসী বেগম ও তার স্বামী গোলাম নবী। হঠাৎ ঝড় বৃষ্টি শুরু হলে বজ্রপাতে স্বামী-স্ত্রী আহত হন। খবর পেয়ে ঝিনাইদহ দমকল বাহিনীর সদস্যরা তাদেরকে উদ্ধার করে ঝিনাইদহ জেনারেল হাসপাতালে আনলে কর্তব্যরত চিকিৎসক রুপসী বেগমকে মৃত ঘোষণা করেন। গুরুতর আহত স্বামী গোলাম নবীকে জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি রাখা হয়েছে। এদিকে তীব্র ঝড়ে ঝিনাইদহ সদরের গোয়ালপাড়া, ক্যাডেট কলেজ সংলগ্ন সড়ক, কালীগঞ্জে বারোবাজার, রঘুনাথপুর, কোটচাঁদপুরের এলাঙ্গীসহ বিভিন্ন স্থানে রাস্তায় ও রাস্তার পাশে ভেঙে পড়ে ছোটবড় শতাধিক গাছ। এতে সকাল ৬টা থেকে বন্ধ হয়ে যায় ঝিনাইদহ-যশোর সড়কে যানবাহন চলাচল। এ সময় ঝড়ের কবলে পড়ে আহত হয় আরও ৪ জন। খবর পেয়ে ঝিনাইদহ, কালীগঞ্জ ও কোটচাঁদপুর ফায়ার সার্ভিসের ৪টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে প্রায় ৪ ঘন্টা চেষ্টা করে গাছ কেটে অপসারণ করে। প্রায় ৪ ঘন্টা পর সকাল ১০টা থেকে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। ঝড়ের সময় বজ্রপাতের আগুনে কালীগঞ্জ উপজেলার কাঠালিয়া মাঠে এক কৃষকের কেটে রাখা ধান পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ঝড়ের সময় জেলা সদর ও কালীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বৈদ্যুতিক খুঁটি ভেঙে ও তার ছিঁড়ে বন্ধ হয়ে যায় বিদ্যুৎ সরবরাহ। উদ্ধারে অংশ নেওয়া কালীগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার শেখ মামুনুর রশিদ জানান, ‘ঝড়ের পরপরই বিভিন্ন স্থান থেকে সড়কে গাছ ভেঙে পড়ার খবর আসে। সেসময় ঘটনাস্থলে গিয়ে গাছ কেটে রাস্তার পাশে সরিয়ে রাখি। প্রায় চার ঘন্টা কাজ শেষে সম্পূর্ণরুপে সড়কে ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ভেঙে পড়া গাছ অপসারণ করতে সক্ষম হই। এরপরই সকল মহাসড়ক ও আঞ্চলিক গুরুত্বপূর্ণ সড়কে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়।’
কালীগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার রথীন্দ্রনাথ বসাক বলেন, ঝড়ে ৩৩টি বিদ্যুতের পোল ভেঙ্গেছে। তাছাড়া ৩৩ কেভি লাইনের ওপর গাছ পড়েছে এবং তার ছিঁড়ে গেছে। সকল স্থানেই মেরামতের কাজ চলছে।
ঝিনাইদহ ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির নির্বাহী প্রকৌশলী ইঞ্জিনিয়ার রাশিদুল ইসলাম চৌধুরী জানান, ঝড়ে কিছু স্থানে গাছ পড়ে বিদ্যুৎ লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মীরা কাজ করে দ্রুত লাইন চালু করেরে। তবে কিছু কিছু এলাকায় বিকেল পর্যন্ত লাইন চালু করতে পারেনি।
এদিকে ঝড়ের পর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার তালিকা প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে। ঝিনাইদহের জেলা প্রশাসক মনিরা বেগম বলেন, ‘আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করছি। তালিকা শেষ হলে তারা যাতে সহযোগিতা পান সে ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হবে।’
শালিখা (মাগুরা) সংবাদদাতা জানান, শালিখায় কালবৈশাখী ঝড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গেছে অনেক স্থানের সড়ক যোগাযোগ ও বিদ্যুৎ সংযোগ । শনিবার ভোরে কালবৈশাখীর ঝড়ে এ ঘটনা ঘটে। উপজেলার আড়পাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় গাছপালা উপড়ে পড়েছে। ঘরবাড়ির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ঝড়ের কারণে বিদ্যুতের ১১ টি খুটি সম্পূর্ণ উপড়ে পড়ায় পুরো এলাকা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।