হায়রে নিয়তি! হায়রে পরিণতি

0

গোলাম মাওলা রনি
মানুষের নিয়তি নিয়ে এ রকম গল্প আমি দ্বিতীয়টি কোথাও শুনিনি। ইতিহাসের জনক হিরোডোটাস তার অমর গ্রন্থ দ্য হিস্টিরিয়াতে কাহিনীটি যেভাবে বর্ণনা করেছেন তাতে বিশ্বরাজনীতি, ক্ষমতার পালাবদল এবং মানুষের নিয়তিসংক্রান্ত পরিণতির যে বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে তা মানব ইতিহাসের সর্বকালের সেরা মাস্টার পিস হিসেবে সর্বমহলে স্বীকৃত। প্রাচীন দুনিয়ার সবচেয়ে পরাক্রান্ত এবং সবচেয়ে বড় দু’টি সাম্রাজ্যের যুদ্ধ এবং সেই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া দু’জন মহান শাসকের নাটকীয় জয়-পরাজয়ের কাহিনীর মধ্যে হিরোডোটাস যে নির্মম বাস্তবতা ফুটিয়ে তুলেছেন, তর গুরুত্ব বর্তমানকালেও কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।
প্রাচীন দুনিয়ার যে দু’টি সাম্রাজ্যের কাহিনী আপনাদেরকে বলব তার একটির নাম ছিল লিডিয়া এবং অপরটির নাম মিডিয়া। লিডিয়া নতুন সাম্রাজ্য হলেও এর শাসক মহামতি সাইরাসের বিচক্ষণতা, বীরত্ব, ন্যায়বিচার এবং সর্বোপরি সাম্রাজ্যজুড়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠার কারণে চলমান দুনিয়ার সব নাগরিক লিডিয়ার বাসিন্দা হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন এবং নিজ নিজ অবস্থান থেকে লিডিয়ার জন্য প্রার্থনা করতেন। বর্তমান ইরানকে কেন্দ্র করে লিডিয়ার বিস্তৃতি ঘটেছিল। ইরানসহ পুরো মধ্য এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, আফগানিস্তান, চীন ও ভারতবর্ষের কিয়দংশ এবং ইউরোপের বিরাট অংশ নিয়ে লিডিয়া সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল। অন্য দিকে মিডিয়া ছিল ইউরোপের প্রধানতম শক্তিশালী সাম্রাজ্য যারা বংশপরম্পরায় প্রায় ২০০ বছর ধরে ইউরোপ শাসন করে আসছিল। আমি যে সময়ের কথা বলছি, তখন মিডিয়ার সম্রাট ছিলেন ক্রেসাস, যিনি তার ধার্মিকতা, ন্যায়পরায়ণতা, দক্ষতা-বিচক্ষণতা এবং সর্বোপরি ভালো মানুষীর জন্য পুরো ইউরোপে মশহুর ছিলেন। তার সাম্রাজ্যের প্রজারা অতিশয় সুখী ছিলেন এবং তার রাজকোষ তখন ছিল কানায় কানায় পরিপূর্ণ। সুন্দরী স্ত্রী, যোগ্যতম আত্মীয়স্বজন এবং বিশ্বস্ত রাজকর্মচারীদের পরামর্শ নিয়ে তিনি একটি সুখময় পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবন অতিবাহিত করছিলেন। ইউরোপজুড়ে তার সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি এবং সাম্রাজ্যের সর্বত্র সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত থাকার কারণে তার সাথে যুদ্ধবিগ্রহ করার মতো কোনো প্রতিপক্ষ তিনি খুঁজে পাচ্ছিলেন না। ঠিক এই সময়ে তিনি খবর পেলেন যে লিডিয়া নামের নতুন একটি সাম্রাজ্য আত্মপ্রকাশ করেছে এবং লিডিয়ার সম্রাট অতি দ্রুততার সাথে সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটাচ্ছেন। সম্রাট ক্রেসাসের কাছে যখন লিডিয়ার সম্রাট সাইরাসের খবর পৌঁছাল তখন এই দুই সম্রাটের ক্ষমতার পরিধি, বিত্ত-বৈভব এবং সুনাম-সুখ্যাতির ব্যবধান ছিল অসম। বর্তমান জমানায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সাথে যদি তুলনা করেন তবে সেই প্রাচীন দুনিয়ায় সম্রাট ক্রেসাসের অবস্থা ছিল পুতিনের মতো এবং সাইরাসের অবস্থা অনেকটা জেলেনস্কির মতো। ঠিক এই অবস্থায় সম্রাট ক্রেসাস কোনো কারণ ছাড়াই লিডিয়ার সম্রাট সাইরাসের বিষয়ে ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে পড়লেন এবং সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি লিডিয়া আক্রমণ করবেন। আগেই বলেছি, সম্রাট ক্রেসাস অতিশয় ভালো মানুষ ছিলেন এবং যথেষ্ট ধর্ম-কর্ম করতেন। তৎকালীন জমানার প্রধান ধর্মীয় বিশ্বাস দ্বারা তিনি প্রভাবিত ছিলেন এবং ধর্মীয় বিধিমতে যেসব কর্ম পুণ্যকর্ম বলে বিবেচিত হতো তিনি তা সাধ্যমতো করার চেষ্টা করতেন। ফলে পৃথিবীর তাবৎকালের ধর্মানুরাগী মানুষের মতো তারও ছিল একটি সংবেদনশীল মন যেখানে ঈর্ষাপরায়ণতা, ক্রোধ এবং অহেতুক যুদ্ধের দামামা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল, যুদ্ধের জন্য সর্বকালেই কতগুলো নীতি নৈতিকতা, প্রয়োজন এবং অপরিহার্যতার কার্যকারণ অনুসরণ করা হতো। যারা এই নিয়মগুলো মানতেন না তারাই একটি অন্যায্য যুদ্ধের কবলে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতেন। কেউ কেউ হয়তো সাময়িকভাবে জয়ী হতেন, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তাকে অবশ্যই অন্যায্য যুদ্ধের পরিণতি ভোগ করতে হতো।
সম্রাট ক্রেসাস লিডিয়ার বিরুদ্ধে যে যুদ্ধের পরিকল্পনা করছিলেন সেটির ন্যায্যতা নিয়ে তার মনে একধরনের প্রশ্নের উদ্রেক হচ্ছিল। নিজের দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটানোর জন্য তিনি ধর্মীয় নেতাদের পরামর্শ গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন। তৎকালীন জমানায় গ্রিসের ডেলফির মন্দির অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং প্রভাবশালী উপাসনালয় ছিল। এ মন্দিরের পুরোহিতের ভবিষ্যৎবাণীর যথেষ্ট সুখ্যাতি ছিল। সুতরাং সম্রাট ক্রেসাস ডেলফির মন্দিরে বহুমূল্যবান উপহার পাঠালেন এবং মন্দিরের পুরোহিতের কাছে সম্ভাব্য যুদ্ধের পরিণতি সম্পর্কে জানতে চাইলেন। পুরোহিত সম্রাটের প্রশ্নের উত্তর দিলেন সাঙ্কেতিক ভাষায়। তিনি যুদ্ধের পরিণতি সম্পর্কে জানালেন যে, এই যুদ্ধের ফলে দুটো শক্তিশালী সাম্রাজ্যের মধ্যে একটি সাম্রাজ্য পরিপূর্ণভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। পুরোহিতের উত্তর লাভের পর সম্রাট ক্রেসাস কোনো রকম বাছবিচার না করেই ধরে নিলেন যে, দুটো শক্তিশালী সাম্রাজ্যের মধ্যে যেটির পতন ঘটবে সেটি হলো লিডিয়া। সুতরাং তিনি মহাসমারোহে যুদ্ধযাত্রার আয়োজন করলেন এবং প্রতিপক্ষকে আশ্চর্য করে দিয়ে ঝড়ের গতিতে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হলেন। যুদ্ধ শুরু হলো এবং ইতিহাসের নিদারুণ এক পরিণতি ঘটিয়ে সে দিনের যুদ্ধে ক্রেসাস শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলেন। বিজয়ী সম্রাট সাইরাসের কাছে গ্রেফতার ক্রেসাসকে হাজির করা হলো এবং তিনি কোনো বিলম্ব না করে তৎক্ষণাৎ পরাজিত সম্রাটকে জ্বলন্ত চিতার মধ্যে ফেলে হত্যার নির্দেশ দিলেন। শিকলবন্দী সম্রাট ক্রেসাসকে চিতার কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। তিনি অবনত মস্তকে ধীরলয়ে চিতার দিকে এগোতে থাকলেন। তিনি তৎকালীন প্রথা অনুযায়ী বিজয়ী সম্রাটের কাছে প্রাণভিক্ষা চাইলেন না অথবা নিজের বীরত্ব ও সাহস প্রদর্শনের জন্য মৃত্যুর আগে প্রতিপক্ষকে লক্ষ করে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল দিলেন না। সম্রাট ক্রেসাসের এই অবস্থা দেখে বিজয়ী সম্রাট সাইরাসের মনে দয়ার উদ্রেক হলো। তিনি ক্রেসাসকে ক্ষমা করে দিলেন এবং তার সামনে হাজির করার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু ততক্ষণে পুরো পরিস্থিতি মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল। অর্থাৎ বিজয়ী রাজার নির্দেশে আগুন জ্বালানোর পর তা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। কিন্তু রাজা যখন সেই আগুন থেকে আবার সম্রাট ক্রেসাসকে ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দিলেন এখন রাজার লোকেরা শত চেষ্টা করেও আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিল না।
উল্লিখিত অবস্থায় বন্দী ক্রেসাস তার হাত দুটোকে আসমানের দিকে তুলে ধরলেন এবং বললেন ওহে মহাপ্রভু: সারাটি জীবন তোমার ইবাদত করেছি; কিন্তু বিনিময় তোমার কাছে কিছুই চাইনি। আজকের এই ভয়াল দিনে তোমার কাছে নিবেদন- যদি দয়া হয় তবে আগুনটি নিভিয়ে দাও। কারণ অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে রাজা আমায় ক্ষমা করেছেন; কিন্তু তার লোকেরা চেষ্টা করেও আগুন নেভাতে পারছে না। সম্রাট ক্রেসাসের প্রার্থনার পর সেখানে এক অলৌকিক ঘটনা ঘটল। হঠাৎ কোথা থেকে একরাশ কালো মেঘ এসে এমন প্রবল বর্ষণ ঘটাল যে মুহূর্তের মধ্যে সব আগুন নিভে গেল। সম্রাট ক্রেসাসকে বিজয়ী সম্রাট সাইরাসের সামনে আনা হলো। এবারো তিনি নিশ্চুপ রইলেন। সাইরাস প্রশ্ন করলেন- মহাত্মন! চিতার সামনে দাঁড়িয়ে আপনি বিড় বিড় করে কী বলছিলেন! ক্রেসাস বললেন- মহাত্মন! আমি বলছিলাম। হায়রে নিয়তি! এটাও কি সম্ভব! সাইরাস এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে ক্রেসাস নিম্নোক্ত কাহিনীটি বলেন-এই যুদ্ধের কয়েক মাস আগের ঘটনা। আমি তখন যশ-খ্যাতি, বিত্ত-বৈভবের চূড়ান্ত পর্যায়ে অবস্থান করছিলাম। তখন আমার মনে এমন ধারণা জন্ম নিলো যে, আমিই দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী ব্যক্তি। তো এমন সময় আমার জনৈক মন্ত্রী এসে আমাকে জানালেন যে, বিশ্ববিখ্যাত পর্যটক এবং বহুমুখী প্রতিভাধর মহাজ্ঞানী সোলন আমার রাজধানীতে বেড়াতে এসেছেন। আমি কি তার সাথে সাক্ষাতে আগ্রহী। আমি সোলনকে সেই রাতে আমার সাথে নৈশভোজে অংশগ্রহণের নিমন্ত্রণ জানালাম। আমার ইঙ্গিতে আমার লোকজন খাবার টেবিলে উপস্থিত করানোর আগে মহাজ্ঞানী সোলনকে আমার রাজকোষ, অন্দরমহল, হাতিশালা-ঘোড়াশালাসহ আমার সাম্রাজ্যের সহায় সম্পত্তির কৌশলগত স্থাপনাসহ দেখাল। খাবার টেবিলে বসে আমি সোলনের দিকে তাকিয়ে কোনো রকম ভূমিকা না করেই বললাম- আচ্ছা জনাব! আপনি তো দুনিয়ার অনেক দেশ শহর বন্দর ভ্রমণ করেছেন। আপনার দৃষ্টিতে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষটি কে! আমার আশা ছিল, সোলন সুখী মানুষের তালিকায় আমার নামটি সবার আগে বলবেন; কিন্তু তিনি সেটি না করে সুখী মানুষ হিসেবে একজন অখ্যাত ব্যক্তির নাম বললেন। আমি খুব কষ্ট পেলাম এবং মনের ক্ষোভ গোপন রেখে বললাম, তাহলে দ্বিতীয় সুখী ব্যক্তিটি কে! এবারও তিনি অন্য আরেকজনের নাম বললেন। আমি তৃতীয় সুখী ব্যক্তির নাম জিজ্ঞাসা করলে তিনি অকপটে তৃতীয় ব্যক্তির নাম বললে, আমি রাগে অভিমানে নিজের প্রতি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। আমি সোলনকে ভর্ৎসনা আরম্ভ করি। তাকে বলি, আপনি তো দেখছি বেজায় হিংসুটি প্রকৃতির মানুষ! আপনাকে সম্মান জানিয়ে নৈশভোজ নিমন্ত্রণ করেছি এবং এখানে আসার আগে আপনাকে আমার সুখ-সম্পদের প্রধানতম উপকরণগুলো দেখানো হয়েছে। এগুলো দেখার পর আপনার কি মনে হচ্ছে, আমি একজন অসুখী মানুষ! আমার কথা শুনে সোলন হাসলেন; জবাবে বললেন, মহামতি সম্রাট, আমি যে তিনজন সুখী মানুষের নাম বললাম- তারা সবাই মৃত ব্যক্তি! আমার দৃষ্টিতে কোনো জীবিত মানুষকে চূড়ান্ত সুখী বা চূড়ান্ত দুঃখী মানুষ আখ্যা দেয়া যায় না। কারণ জীবন সায়াহ্নে এমন একটি ঘটনা ঘটতে পারে যা একজন মানুষের সারা জীবনের সুখকে অসুখে পরিণত করতে পারে। অথবা জীবনের শেষপ্রান্তে এমন ঘটনাও ঘটে, যার ফলে যে লোকটি নিজেকে সারা জীবন অসুখী ভাবত সেই মৃত্যুর আগে নিজেকে সুখী মানুষ হিসেবে ধ্যান-জ্ঞান করে ইহলীলা সাঙ্গ করে। সোলনের জবাব আমার মনঃপূত হলো না। বরং আমার ক্রোধ বহুগুণে বাড়িয়ে দিলো। আমি বললাম, আমি আপনাকে যতটা খারাপ মনে করেছিলাম, এখন তো দেখছি আপনি তার চেয়েও খারাপ। আমি আপনাকে সম্মান জানিয়ে এত কিছু করলাম অথচ আপনি আশঙ্কা করছেন যে জীবন সায়াহ্নে আমার জীবনে এমন কিছু ঘটবে যা আমার সারা জীবনের সুখ শান্তি নষ্ট করে দেবে। আমি সোলনকে আরো কিছু মন্দ কথা শোনালাম এবং অপমান করে রাজধানী থেকে তাড়িয়ে দিলাম। আজকের এই যুদ্ধের ময়দান, এই ময়দানের পরাজয় এবং জ্বলন্ত চিতার সামনে শিকলবন্দী হয়ে যখন মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম তখন বারবার কেবল সোলনের কথা মনে হচ্ছিল এবং আপন মনে বিড় বিড় করে বলছিলাম, হায়রে নিয়তি! হায়রে পরিণতি!
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য