শ্রীলংকা যখন ডুবছে বাংলাদেশের তখন কী ভাবা উচিত?

0

মাসুদা ভাট্টি॥ শ্রীলংকা ডুবছে। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক সকল সূচকে শ্রীলংকা এখন একটি ডুবে যাওয়া দেশ। একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র। আজকে দেশটির মন্ত্রীদের গরিষ্ঠ সংখ্যক পদত্যাগ করেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধানও দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। দেশের জনগণের ঘরে খাবার নেই, ওষুধপত্র নেই, বিদ্যুৎ নেই, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী নেই, নেই কাগজপত্র ফলে ইস্কুল-কলেজসহ সংবাদপত্র প্রকাশনা বন্ধ। জনগণ রাস্তায় নেমে এসেছে, দাবি জানাচ্ছে প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষে’র পদত্যাগের। কিন্তু প্রেসিডেন্ট তার অর্থমন্ত্রীকে (আরেক রাজাপক্ষ) বরখাস্ত করে ক্ষিপ্ত ও ক্ষুব্ধ জনগণকে থামানোর চেষ্টা করছেন, একই সঙ্গে দেশটির বিরোধী দলগুলোকে অনুরোধ জানিয়েছেন একটি সর্বদলীয় সরকারে যোগ দেয়ার জন্য। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ জনগণের মৌলিক অধিকার রদ করে দেশটিতে সান্ধ্য আইন জারিসহ জরুরি অবস্থা বিরাজ করছে।
চলমান মেগা প্রকল্পসমূহ অতি দ্রুত শেষ করে সেগুলোকে লাভজনক করে তুলে বাংলাদেশকে যতো দ্রুত ‘ঋণমুক্ত’ করা যায় সেদিকেও নজর দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু কথাতো সেখানেই, শ্রীলংকার মতো নেতিবাচক উদাহরণ যদি আমাদের সামনে থাকে এবং শ্রীলংকায় যা ঘটেছে, যেভাবে দেশটি আজকের অবস্থায় এসেছে সেসব ধর্তব্যে এনে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সেসব ঘটতে না দিলেই যে বিপদমুক্তি, সেটা বোঝার জন্যতো আর অর্থনীতির পণ্ডিত হওয়ার প্রয়োজন নেই, সাদা চোখেই এসব বোঝা যাওয়ার কথা। প্রশ্ন হলো, আমরা বুঝতে চাইছি কিনা। শ্রীলংকা একদিনে আজকের অবস্থায় আসেনি, সেটা বলাই বাহুল্য। এ বছরেরই জানুয়ারিতে বিবিসি’র একটি রিপোর্টের শিরোনাম ছিল- “Colombo Port City : A new Dubai or a Chinese Enclave?” খবরটি দাবি করছে যে, শ্রীলংকার বন্দর এলাকায় বিস্তৃত এলাকা জুড়ে মাটি ভরাট করে যে নতুন শ্রীলংকা জন্ম নিচ্ছে সেটি হতে যাচ্ছে দেশটির জন্য “খেলা বদলে দেওয়ার মত ঘটনা”, যে কারণে প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহ বিশেষ করে হংকং ও সিঙ্গাপুরের মতো আন্তর্জাতিক বন্দরশহরগুলোর কপালে ভাঁজ পড়ছে কারণ এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে শ্রীলংকার অবস্থাতো বদলাবেই সেই সঙ্গে অসুবিধায় পড়বে এসব বন্দরনগরীগুলোও।
আরেকটু পেছনে তাকাই। শ্রীলংকা দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষ অর্থনীতির একটি ছিল, শুরু করেছিল তৈরি পোশাক রফতানি দিয়ে, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে প্রথম পা রাখা শ্রীলংকা নির্ভরশীল ছিল পর্যটনে, শিক্ষিতের হার উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের তুলনায় ছিল অনেকটাই বেশি এবং সামাজিক সূচকে শ্রীলংকা ছিল সবার চেয়ে এগিয়ে। একটি ভয়ঙ্কর গৃহযুদ্ধের কবলে পড়ে শ্রীলংকা ক্রমশঃ পেছাতে শুরু করে, এমনকি আশির দশকে বাংলাদেশে যে তৈরি পোশাক শিল্পগুলো সরে আসে তা মূলতঃ গৃহযুদ্ধের কারণে ক্রেতারা দেশটিতে যেতে ভীতবোধ করার কারণেই, পরবর্তীতে চেষ্টা করেও শ্রীলংকা সেই যায়গায় ফিরে যেতে পারেনি। তবে অসংখ্য শ্রীলংকান বায়িং হাউস বাংলাদেশে এসে কাজ করে শুরু এবং বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে শ্রীলংকানদের অংশগ্রহণও উল্লেখযোগ্য বলতে হবে।
১৯৪৮ সালে স্বাধীন হওয়ার পরও শ্রীলংকা ব্রিটিশ ডমিনিয়ম স্ট্যাটাস ছাড়েনি। ইউরোপীয় বিশেষ করে ব্রিটিশরাই দেশটির বাণিজ্য ও বাজার নিয়ন্ত্রণ করেছে এই সত্তর দশক পর্যন্ত। প্রায় ৪০ হাজারেরও বেশি ইউরোপিয়ান ও শ’খানেক আমেরিকান নাগরিক শ্রীলংকার স্থায়ীভাবে বসবাস করেছে, এমনকি প্রশাসনেও শ্বেতাঙ্গদের যথেষ্ট প্রভাব ছিল সে সময়। কোনো কোনো শ্রীলংকার বিশ্লেষকের মতে, উমহাদেশ থেকে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা চলে গেলেও তৎপরবর্তীকালে ভারত নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করায় রাতারাতি একটি নতুন ভারতীয় অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজ তথা রাষ্ট্র-ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। কিন্তু শ্রীলংকায় ১৯৭২ সাল পর্যন্ত এই ইউরোপীয় তথা ব্রিটিশ ছায়া-রাজ থাকার ফলে দেশটি ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যেতে থাকে। এমনিতেই দেশটি একটি উৎপাদক দেশ হিসেবে বিখ্যাত নয়; চা, দারচিনি, নারকেল, মশলা, মূল্যবান রত্ন-পাথর, রাবার আর তৈরি পোশাক ছাড়া রফতানিযোগ্য পণ্য বিশেষ নেই। সবই এই দ্বীপরাষ্ট্রে আমদানি করতে হয়। দেশটির বিরাট সংখ্যক প্রবাসী বছরে ৩ থেকে ৪ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়ে থাকে আর পর্যটন খাত থেকে দেশটির আয় ৫-৬ বিলিয়ন ডলার। দুঃখজনক হলো, দেশটির সরকারগুলো কখনোই উৎপাদন খাত, সেবা খাতে বিনিয়োগ বা নজর কোনোটিই দেয়নি। তবে একথাও সত্য যে, এই বিনিয়োগ বা নজর না দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা দাতা গোষ্ঠীর পরামর্শ সব সময়ই শ্রীলংকার দুর্বল সরকারগুলো মেনে চলার চেষ্টা করেছে। ২০০৯ সালের পর থেকে অর্থনীতি একটু চাঙ্গা চলে শ্রীলংকায় বিদেশি বিনিয়োগ এবং অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিও ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। দেশটির মাথাপিছু আয় ৩ হাজার ৮১৯ ডলার হয়, যা আসলে দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ। এমনকি দেশটি উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু ‘কি থেকে কী হয়ে যায়’ পরের বছরই প্রবৃদ্ধি কম হওয়ায় বিশ্ব ব্যাংক দেশটিকে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশের তালিকা থেকে নিন্ম-মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় নামিয়ে দেয়। এই ওঠা-নামার কারণ এবং কী থেকে কী হয়ে যাওয়ার বিষয়টি মূলতঃ রাজনৈতিক এবং রাজনৈতিক।
মূলতঃ এসময়ই বিশাল অঙ্কের ঋণের “অফার” নিয়ে হাজির হয় চীন। বলা হয়ে থাকে যে, চীন দুর্বল অর্থনীতির খোঁজ করে সেখানে বিনিয়োগের নামে ‘ঋণের বোঝা’ চাপিয়ে দেশগুলোকে উদ্ধারের বদলে আরও ডুবিয়ে দেয়। শ্রীলংকার ক্ষেত্রেও পশ্চিমা ও চীন-বিরোধী গণমাধ্যম একই অভিযোগ তুলে চলেছে, যদিও শ্রীলংকার নেয়া মোট ঋণের মাত্র ১০ ভাগ চীনের কাছ থেকে নেয়া, ফলে আজকের শ্রীলংকার দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার মূল কারণ চীনের ঋণ নয়, অনেকগুলো কারণের একটি হলো চীন। কিন্তু পাশে ভারতকে রেখে শ্রীলংকা কেনো চীনের দিকে ঝুঁকেছিল সে প্রশ্ন এখন অনেকের মুখে মুখে, ভারতের থেকে দূরে গিয়ে চীনের হাত ধরাকে ভারত ভালো চোখে দেখেনি, বলাই বাহুল্য। বলা হয়ে থাকে যে, ভারতের চারপাশে প্রতিবেশি দেশগুলি যে মুক্তোর মালা রচনা করেছে তার থেকে একেকটি মুক্ত খসে চীনের থলেতে গিয়ে পড়ায় এ অঞ্চলে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি ভারসাম্য দুলতে শুরু করে। এর সত্যমিথ্যা আরো বিস্তারিত অর্থনীতির গবেষকগণ নির্ণয় করবেন। এখানে শুধু শ্রীলংকার বর্তমান শাসক পরিবারকে নিয়ে কিছু কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন।
রাজাপক্ষ পরিবার শ্রীলংকার রাজনীতিতে এই মুহূর্তে অভিশপ্ত নাম হলেও তারা ভোটের মাধ্যমেই ক্ষমতায় এসেছে এবং বলতে গেলে গোটা শাসন ব্যবস্থার একেবারে তৃণমূল থেকে প্রেসিডেন্ট থেকে পর্যন্ত একেকজন ‘রাজাপক্ষ’ বসে থেকে দেশটি একটি রিপাবলিক হলেও সত্যিকার অর্থে হয়ে গিয়েছিল একটি ‘রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র’। রাজাপক্ষ’র হুকুম এবং ইশারা না থাকলে শ্রীলংকার কোনো ‘হাকিম’ নড়েনি। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষ এবং প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষ আসলে এই রাজতন্ত্রের রাজা এবং প্রধান উজির, এরপর আছেন অর্থমন্ত্রী, কোতোয়াল, সবাই আসলে রাজাপক্ষ। এই রাজাপক্ষ’দের একক সিদ্ধান্তেই বলতে গেলে শ্রীলংকা ঋণের ফাঁদে পড়েছে। জিডপি’র ১১৯ শতাংশ যে দেশটির ঋণ, যার থেকে এ বছর ফেরত দেওয়ার কথা ছিল ৫০০ কোটি ডলার, কিন্তু দেশটির হাতে আছে মাত্র ২৩১ কোটি ডলার যা দিয়ে মাত্র মাস খানেকের আমদানী ব্যয় মেটানো সম্ভব। ফলে খাবার নেই, ওষুধ নেই, তেল আমদানী করে বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানোর উপায় নেই- নেই নেই নেই, শ্রীলংকায় কিছুই নেই, হাহাকার ছাড়া। এই রাজাপক্ষ পরিবারের রাজতান্ত্রিক শাসনের সঙ্গে যদি যোগ করা যায় ২০১৯ সালের বোমা বিস্ফোরণের ফলে ২৫৩ জনরে মৃত্যুর ঘটনা, যার কারণে দেশটিতে পর্যটন শিল্পে ধ্বস নামে এবং আরেকটি হলো কোভিড। গোটা বিশ্বেই ধনী দেশ ছাড়া গরীব দেশগুলিকে যে কোভিড কতোটা ক্ষতি করেছে তা শ্রীলংকার পরে আরো অনেক দেশের নামই শোনা যাবে বলে অর্থনীতিবিদগণ ভবিষ্যদ্বাণী করে রেখেছেন।
রাজাপক্ষ পরিবারের একটি ‘রাজতান্ত্রিক’ সিদ্ধান্ত ও তার ফলাফল বিষয়ে উল্লেখ করে এ লেখার ইতি টানতে চাই। দেশটিতে হঠাৎই “অর্গানিক” বা জৈবসারের লবিস্ট গ্রুপ এই পরিবারের একজন সদস্যকে ম্যানেজ করে দেশটির সার আমদানী বন্ধ করে দেয় এবং কৃষিতে তার ব্যাপক প্রভাব পড়ে, কোভিডকালে যেসব দেশ কৃষিতে ভালো করেছিল তারা মোটামুটি বেঁচে গেছে, কিন্তু শ্রীলংকায় বিগত দুই বছরে ফসল উৎপাদন অর্ধেকেরও কম হয়েছে বলে সংবাদ মাধ্যমেই তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে, ব্যাপক খাদ্য ঘাটতির কবলে পড়েছে দেশটি, ওদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে টাকা নেই, ঘটের দায়ে মনসা বিক্রির দশা। টাকা ছাপিয়ে কেবল মুদ্রাস্ফীতিই বেড়েছে, কাজের কাজ কিছুই হয়নি। চীনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে করা সমুদ্র বন্দর, বিমানবন্দর কোভিডের কারণে লাভের মুখ দেখেনি। অথচ ঋণতো বসে থাকেনি, বেড়েইছে। এশিয় উন্নয়ন ব্যাংক ও জাপানের কাছে থাকা শ্রীলংকার ঋণ চীনের চেয়ে বেশি কিন্তু প্রচারমুখে চীনের নামই বেশি শোনা যাচ্ছে। যদিও একথা কেউ বলে না যে, ৭০-এর দশকে যে আইএমএফ বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল শ্রীলংকায় ঋণ কর্মসূচি নিয়ে ঢুকেছিল সে ঋণ শুধু বেড়েইছে, কমেনি। রাজাপক্ষ পরিবার সে ঋণের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকেছে মাত্র। শ্রীলংকা বাংলাদেশ থেকে খুব বেশি দূরের দেশ নয়। উপমহাদেশের কোনো একটি দেশে কোনো নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটলে তার প্রভাব ও ছায়া দু’টোই বাকি দেশগুলিতে পড়ে থাকে। বাংলাদেশ নিয়েও সতর্ক হওয়ার কথা বলছেন অর্থনীতিবিদ তথা বিশেষজ্ঞগণ। যদিও নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশের বড় কোনো বিপদের সম্ভাবনা নেই সে কথাও বলছেন মূলতঃ বাংলাদেশের রিজার্ভ, ঋণের পরিমাণ এবং আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ‘শক্ত’ বলে সার্টিফিকেট দেওয়ার কারণে। একই সঙ্গে চলমান মেগা প্রকল্পসমূহ অতি দ্রুত শেষ করে সেগুলোকে লাভজনক করে তুলে বাংলাদেশকে যতো দ্রুত ‘ঋণমুক্ত’ করা যায় সেদিকেও নজর দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু কথাতো সেখানেই, শ্রীলংকার মতো নেতিবাচক উদাহরণ যদি আমাদের সামনে থাকে এবং শ্রীলংকায় যা ঘটেছে, যেভাবে দেশটি আজকের অবস্থায় এসেছে সেসব ধর্তব্যে এনে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সেসব ঘটতে না দিলেই যে বিপদমুক্তি, সেটা বোঝার জন্যতো আর অর্থনীতির পণ্ডিত হওয়ার প্রয়োজন নেই, সাদা চোখেই এসব বোঝা যাওয়ার কথা। প্রশ্ন হলো, আমরা বুঝতে চাইছি কিনা।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট।