সংযমের পরিচয়ই বটে!

0

শান্তা মারিয়া॥ এ বছর প্রথম দিনের রোজার প্রথম ইফতার করতে হলো পথের মাঝখানে। গুলশান দুই থেকে বাংলা মোটর। হালকা পাতলা জ্যাম থাকলেও আধঘন্টার পথ। সেই পথ এসেছি আড়াই ঘন্টায়। চারটার সময় অফিস থেকে বেরিয়ে জ্যামের মধ্যে হাবুডুবু খেতে খেতে সাড়ে ছয়টায় এসে বাড়িতে ঢুকলাম। ততোক্ষণে মাগরিবের আজান পড়ে গেছে। ঢাকার যানজট এবং সড়কে অব্যবস্থাপনা এখন আর সমস্যা নয়, এটি এখন ভয়াবহ দুর্যোগ। এই দুর্যোগের শুরুও নেই শেষও নেই। ঢাকার সড়ক এখন আর কোন মানুষের চলাচলের উপযুক্ত নেই। অনেক সড়কেরই অধিকাংশ অংশ দখল হয়ে গেছে। রাস্তার উপরে নির্মাণ সামগ্রীর স্তূপ। বাংলামোটরের রাস্তার অধিকাংশ এলাকা জুড়ে গাড়ি মেরামতের দোকান। রাস্তার উপরেই তাদের ওয়ার্কশপ। মেরামতের জন্য গাড়িগুলোও ওখানেই রাখা। যেন বাপদাদার তালুক। মাহে রমজান শুরু হলো। এটি সংযমের মাস। কিন্তু এই সংযমের মাসে চারপাশে যে দুর্ভোগ চলছে তাতে সাধারণ মানুষের ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উৎসবের সময় জিনিসপত্রের দাম কমানো হয়। সাধারণ মানুষ যেন উৎসবের আনন্দ উপভোগ করতে পারেন সেজন্য দামটা সহনীয় রাখা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে সবই উল্টো। এখানে উৎসবকে কেন্দ্র করে চলে লুটপাটের মহোৎসব। এখানে যত সংযম সব সাধারণ মানুষের বেলায়।
রোজার মাস। ইফতারির বাজার বসে গেছে রাস্তা আর গলিপথগুলো দখল করে। কারও কিছু বলার নেই। ইফতারির কথা যখন উঠলো তখন বলি, মানুষ খাবেটা কী? বাজারে আগুন জ্বলছে। হাত দেওয়ার উপায় নেই কোনকিছুতে। এখনও সরকারি ভাষ্যে শুনতে পাচ্ছি, দ্রব্যমূল্য নাকি সহনীয় অবস্থাতেই আছে। ‘সহনীয়’ তো বুঝলাম। কিন্তু কাদের জন্য সহনীয়? সরকারি বিসিএস ক্যাডারের জন্য নাকি বেসরকারি ছোট চাকরি করা মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য? চালের দাম বাড়লে রিকশাওয়ালা রিকশাভাড়া বাড়াতে পারে, সিএনজিচালক ভাড়া আকাশে তুলতে পারে, দোকানদার জিনিসের দাম বাড়িয়ে দিতে পারে কিন্তু যে সীমিত বেতনে ছোট চাকরি করে সেই মানুষটি কি করে? তার বেতন তো রাতারাতি বাড়েই না বরং এই মহামারিতে অনেকেই চাকরি হারিয়েছে। তারা বাঁচে কিভাবে? রোজার প্রথম দিনেই বেগুনের দাম সেঞ্চুরি করেছে। গরুর মাংসর কেজি সাতশ‘র ঘর ছুঁয়েছে। সয়াবিন তেল সব রেকর্ড কেবল ভঙ্গই করেনি, কোথাও কোথাও খোলা বাজার থেকে উধাও হয়েও গেছে। সবজি, তরকারি, ডিম কোনটাই আর হাতের নাগালে নেই। তেলেসমাতি দেখাচ্ছে তরমুজ, লেবু, শসা।
বয়স আমার কম হয়নি। এতগুলো রোজা পার করলাম। ছোটবেলা থেকেই তরুমুজ খাই। কিন্তু তরমুজও যে কেজি দরে বিক্রি হতে পারে তা টের পেলাম গত কয়েক বছরে। তরমুজের মতো একটি ভারি ফল কিভাবে কেজি দরে বিক্রি হয়? ঠিক আছে কেজি দরে বিক্রিই সই, তাহলে দশটাকা কেজি দর হোক। তা তো হবে না। এতো যে দাম সব খাদ্যবস্তুর, তা কৃষক কি ন্যায্য দাম পায়? মোটেই না। লাভের গুড় সবটাই যায় মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের পেটে। সিন্ডিকেট আর সিন্ডিকেট। প্রশ্ন হলো সরকার কেন সিন্ডিকেটকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। বাজারের উপর সরকারের তাহলে কিসের নিয়ন্ত্রণ? ঈদের বাজার শুরু হয়েছে। ঈদের বাজার নয়। দেখেশুনে মনে হচ্ছে রেসের মাঠ। যার কাছ থেকে যেমন নেওয়া যায়। যে শাড়িটির দাম গতকালও ছিল পাঁচশ আজ তা পাঁচ হাজারের এক চুল নিচে নয়। ক্রেতা কিছু বলতে গেলেই বিক্রেতা শুনিয়ে দিচ্ছে ‘গত দুই বছর ব্যবসা করতে পারিনি। এবার ব্যবসা করতে হবে।’ তারচেয়ে সোজাসুজি বললেই হয়, গত দুই বছর ব্যবসা করতে পারিনি এবার কোপাবো। ঢাকায় এখন শুধু মানুষ আর মানুষ। পথে ঘাটে তৃতীয় লিঙ্গের ভিক্ষুক বেড়েছে মাত্রাতিরিক্তভাবে। এরা সকলেই তৃতীয় লিঙ্গের নাকি তাদের ছদ্মবেশে পুরুষরাই একাজে নেমেছে সেটা কে বলবে। তাদের অত্যাচারে যেটুকু সহানুভূতি ও তাদের মানবাধিকারের প্রতি সচেতনতা ছিল তা উবে যেতে বসেছে। এরা অকাতরে অশ্লীল কথা বলে ইচ্ছামতো হয়রানি করছে সাধারণ মানুষকে। বাবা-মা, ছেলে, মেয়ের সামনে অকথ্য অশালীন কথা বলে তারা টাকা আদায় করছে যা রীতিমতো হয়রানি ও নির্যাতনের পর্যায়ে চলে গেছে।
মাহে রমজান শুরু হলো। এটি সংযমের মাস। কিন্তু এই সংযমের মাসে চারপাশে যে দুর্ভোগ চলছে তাতে সাধারণ মানুষের ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উৎসবের সময় জিনিসপত্রের দাম কমানো হয়। সাধারণ মানুষ যেন উৎসবের আনন্দ উপভোগ করতে পারেন সেজন্য দামটা সহনীয় রাখা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে সবই উল্টো। এখানে উৎসবকে কেন্দ্র করে চলে লুটপাটের মহোৎসব। এখানে যত সংযম সব সাধারণ মানুষের বেলায়। মানুষ সহ্য করছে। কিন্তু সকল সহ্যেরই সীমা আছে। দেয়ালে যখন পিঠ ঠেকে যায় তখন প্রতিবাদ করবেই লোকে। বিশেষ করে চালের দাম যখন হাতের নাগাল ছাড়ায় তখন আর উন্নয়নের গল্প শুনে সাধারণ মানুষের পেট ভরে না। রোজার মাসে, ঈদের আগেই নিত্যপণ্যের দাম কমবে এটা প্রাণপণে আশা করি। কারণ আশা নিয়েই বাঙালি বাঁচে।
লেখক : কবি, সাংবাদিক।