টিপু হত্যা: মূলহোতাকে শনাক্ত করতে শামীম ও মুসাকে খুঁজছে পুলিশ

0

নুরুজ্জামান লাবু॥ রাজধানীর মতিঝিলের আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপুসহ জোড়া খুনের আট দিন পেরিয়ে যাচ্ছে। আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডে শুটার মাসুম ওরফে আকাশকে গ্রেফতার করা হলেও এখনও মূলহোতাকে শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবি, তারা শামীম ওরফে মোল্লা শামীম ও সুমন শিকদার ওরফে মুসাকে খুঁজছেন। দুই জনকে পেলে এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য মদদদাতাকে শনাক্ত করা যাবে। ইতোমধ্যে শামীম ও মুসার কয়েকজন সহযোগীকে আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি ইউনিট, টিপু হত্যার মূলহোতা হিসেবে মতিঝিল এলাকার একজন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতাকে নজদরারির মধ্যে রেখেছে। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্র ও মোটরসাইকেল উদ্ধার করতে পারলে ওই আওয়ামী লীগ নেতাকে গ্রেফতার করা হবে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তারা তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রথাগত সোর্স ব্যবহার করে দ্রুততম সময়ে শুটার মাসুম ওরফে আকাশকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু এরপরই তার অন্যতম সহযোগী শামীম ওরফে মোল্লা শামীম আত্মগোপনে চলে গেছে। তাকে গ্রেফতার করতে পারলে অনেক রহস্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব হবে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে টিপু হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটনে নেতৃত্ব দেওয়া ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (খিলগাঁও জোনাল টিম) শাহিদুর রহমান রিপন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ঘটনাটিকে আমরা সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে নিবিড়ভাবে তদন্ত করছি। শুটার মাসুমকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য মদদদাতাদের দ্রুতই শনাক্ত করা হবে।’
সূত্র জানায়, টিপু হত্যাকাণ্ডের কারণ হিসেবে এখন পর্যন্ত কয়েক বছর আগে মতিঝিলের বোবা বাবু খুনকে কেন্দ্র করে স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি পক্ষের সঙ্গে বিরোধকেই প্রাধান্য দিচ্ছে গোয়েন্দারা। এছাড়া ক্রীড়া পরিষদসহ মতিঝিল এলাকার বিভিন্ন সরকারি দফতরের দরপত্র বাণিজ্য ও এলাকার আধিপত্যকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের ওই পক্ষটি শীর্ষ সন্ত্রাসী মানিকের মাধ্যমে এই হত্যা ঘটিয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা গোয়েন্দাদের।
জানা গেছে, পল্টন-মতিঝিলসহ খিলগাঁও-শাজাহানপুর এলাকা একসময় নিয়ন্ত্রণ করতো যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের বহিষ্কৃত সভাপতি সম্রাট ও খালেদ। ক্যাসিনো-কাণ্ডে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তারা গ্রেফতার হওয়ার পর এসব এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে শীর্ষ সন্ত্রাসী মানিকের অনুসারীরা। কিন্তু মানিকের একচ্ছত্র আধিপত্যে বাধা হয়ে দাঁড়ান জাহিদুল ইসলাম টিপু। এ কারণেই তাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তার দাবি, মাসখানেক আগেই টিপুকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। মানিকের অন্যতম প্রধান সহযোগী সুমন শিকদার ওরফে মুসা ও মোল্লা শামীমকে এই হত্যাকাণ্ডের দায়িত্ব দেওয়া হয়। শামীমের মাধ্যমেই টিপুকে হত্যার জন্য মাসুমকে ভাড়া করা হয়। হত্যাকাণ্ডের সময় মাসুমের সঙ্গে মোটরসাইকেলে শামীম ঘটনাস্থলে ছিলেন। সূত্র জানায়, হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে ঘটনার একদিন আগেই সুমন শিকদার ওরফে মুসা পালিয়ে দুবাই চলে গেছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। আর ঘটনার দিন বিকালে শামীম তার নিজের মোটরসাইকেল নিয়ে মাসুমকে সঙ্গে নিয়ে রূপগঞ্জ এলাকায় যায়। সেখানে গিয়ে তারা মাদকসেবনসহ ফুর্তি করে মোটরসাইকেল নিয়ে রাত ৮টার দিকে গোড়ান এলাকায় ফিরে আসে। এরপর রাত ৯টার দিকে খিলগাঁও এলাকায় যায় শামীম। সেখানে গিয়ে সে মোবাইল ফোন বন্ধ করে পুরো কিলিং মিশন শেষ করে রাত সাড়ে ১১টায় মোবাইল ফোন চালু করে। ওই রাতে মতিঝিলের টয়েনবি সার্কুলার রোডের একটি বাসায় রাতযাপন করে শামীম। পরদিন সে আবারও মোহাম্মদপুর এলাকায় যায়। মাসুমকে গ্রেফতারের পরপরই মোবাইল ফোন বন্ধ করে আত্মগোপনে চলে যায় সে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, মোল্লা শামীম দক্ষিণ কমলাপুরের তার দুলাভাইয়ের বাসায় থাকতো। তার বাবার নাম আব্দুল মজিদ, মায়ের নাম রোকেয়া বেগম। এলাকায় ছাত্রলীগকর্মী হিসেবে পরিচয় দিলেও তার কোনও পদ-পদবি ছিল না। মুসা ও মাসুমের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। ঘটনার আগে ও পরে শামীম তার ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি গোড়ান এলাকার ফরহাদ শাহীন নামে এক বন্ধুর বাসায় রেখেছিল। ফরহাদের নিজের হেলমেট এই হত্যাকাণ্ডে ব্যবহার করে শুটার মাসুম। আত্মগোপনে যাওয়ার আগে সে এক ছোট ভাইকে পাঠিয়ে ফরহাদের বাসা থেকে ওই মোটরসাইকেল সরিয়ে ফেলে। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, তারা এখন শামীমকে গ্রেফতারের চেষ্টা চালাচ্ছেন। তাকে ধরতে পারলে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্র ও মোটরসাইকেলটি উদ্ধার করা যাবে।
যেভাবে দ্রুত শনাক্ত হয় শুটার মাসুম: আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই শুটার মাসুমকে গ্রেফতার করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের খিলগাঁও জোনাল টিম। দলটির একজন কর্মকর্তা জানান, ঘটনার পরপরই তারা ঘটনাস্থলের পাশাপাশি নিহত জাহিদুল ইসলাম টিপু যেখান থেকে গাড়িতে ওঠেন সেই মতিঝিলের এজিবি কলোনি এলাকা পরিদর্শন করেন। পুরো এলাকার সিসিটিভি বিশ্লেষণ করে সন্দেহভাজন হিসেবে একটি মোটরসাইকেলের দুই জন আরোহীকে শনাক্ত করা হয়। কিন্তু তাদের মাথায় হেলমেট থাকায় চেনা যাচ্ছে না। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, টিপু হত্যার শুটারকে শনাক্ত করতে প্রথাগত সোর্স ও প্রযুক্তির সহায়তায় মতিঝিল-খিলগাঁও এলাকার পাঁচ জন সন্দেহভাজন শুটারের একটি তালিকা করা হয়। তাদের অবস্থান জানার জন্য আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুদের ওপর নজরদারি শুরু করে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। একপর্যায়ে পাঁচ শুটারের মধ্যে দুই জন ঢাকার বাইরে চলে যাচ্ছে বলে তথ্য আসে। তাদের একজন উত্তরবঙ্গে আর আরেকজন খুলনায় যাচ্ছে বলে তথ্য পায় গোয়েন্দারা। পরবর্তী সময়ে গোয়েন্দা মতিঝিল বিভাগের চারটি পৃথক টিমের ৬০ জন সদস্য একযোগে শুটারদের অনুসরণ করতে থাকে। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় মাসুমের অবস্থান শনাক্তের পর বগুড়া জেলা পুলিশের সহায়তায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের খিলগাঁও জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার শাহিদুর রহমান রিপন বলেন, ‘ঘটনার পরপরই আমরা ডিসি স্যারের (ডিসি-মতিঝিল) নেতৃত্বে কাজ শুরু করি। ঘটনাস্থল ও আশেপাশের এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করি। একপর্যায়ে সন্দেহভাজন হিসেবে কয়েকজন শুটারকে টার্গেট করা হয়। তাদের অবস্থান জানার জন্য দিনরাত ২৪ ঘণ্টা টানা নির্ঘুম কাটাতে হয়েছে আমাদের। একপর্যায়ে মাসুমের অবস্থান জানার পর তাকে গ্রেফতার করা হয়।’
আরফানের অস্ত্র পরীক্ষা করা হচ্ছে: এদিকে বৃহস্পতিবার (৩১ মার্চ) কমলাপুর এলাকা থেকে আরফান উল্লাহ ওরফে দামাল নামে এক যুবলীগ নেতাকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করেছে পুলিশ। আরফান উল্লাহ ওরফে দামাল হলেন আবৃত্তিকার ও আওয়ামী লীগ নেতা আহকামউল্লাহ’র ভাই। আরফানের অস্ত্র জাহিদুল ইসলাম টিপু হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত হয়েছিল কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে আরও জানান, আরফানকে একদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। একইসঙ্গে ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা গুলির খোসা ও অন্যান্য উপকরণ আরফানের অস্ত্রটির সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হচ্ছে।