ঢাকায় মৌসুমি ভিক্ষুকের হাট

0

বিশেষ সংবাদদাতা॥ শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টা। আজিমপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে শুরু করে কবরস্থান পর্যন্ত। এ ছাড়া তার আশেপাশের অলিগলি। সব ক’টি রাস্তার দুই পাশে বিভিন্ন বয়সের অন্তত হাজারখানেক ভিক্ষুক। কেউ বিকলাঙ্গ। কেউ শারীরিক প্রতিবন্ধী। সুস্থ-সবল ভিক্ষুকের পাশাপাশি বিভিন্ন বয়সের শিশু ভিক্ষুকরা রয়েছে। একই পরিবারের অনেক সদস্যকে ভিক্ষা করতে দেখা গেছে। ভিক্ষুকরা গান গাইছেন আর মানুষের কাছে হাত পাতছেন। বিকলাঙ্গ ও প্রতিবন্ধী ভিক্ষুকরা সড়কের পাশে চট বিছিয়ে শুয়ে আছেন। প্রতি ভিক্ষুকই সর্বনিম্ন ৩ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করেছেন। শুধু আজিমপুর কবরস্থানই নয়। পবিত্র শবেবরাত উপলক্ষে রাজধানী ঢাকায় ভিক্ষুকদের ঢল নেমেছিল। শহরের প্রতিটি মসজিদ থেকে শুরু করে ছোট বড় কবরস্থান ও বিভিন্ন মাজারে নিয়মিত ভিক্ষুকদের পাশাপাশি মওসুমি ভিক্ষুকদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি ছিল। মসজিদ ও কবরস্থানের সামনে এবং যাওয়া আসার রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে ও বসে ভিক্ষুকরা অবস্থান নিয়েছিলেন। রাতভর মসজিদে নামাজ পড়তে আসা এবং কবর জিয়ারতে আসা মুসল্লিদের অনেকেই ভিক্ষুকদের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ ছিল।আজিমপুর কবরস্থান এলাকায় কথা হয় আজিজুল ইসলাম (৫৫) নামের এক প্রতিবন্ধী ভিক্ষুকের সঙ্গে। তিনি বলেন, নেত্রকোনা থেকে শুক্রবার সকালে এসেছি। আমার স্ত্রী ও দুই সন্তানও এখানে আছে। সবাই মিলে ভিক্ষা করছি। প্রতি বছরই শবেবরাতের রাতে আসি। সবাই মিলে অন্তত ১৫ হাজার টাকা আয় করতে পারি। এই আয় দিয়ে পুরো রমজান মাসের খরচ হয়ে যাবে। ঈদের আগে আবার আসবো। আরও কয়েদিন ভিক্ষা করলে ঈদের খরচ হয়ে যাবে। তিনি বলেন, আমার শারীরিক অবস্থা ভালো না। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলাম আমি। আগে আমি বাসের চালক ছিলাম। একটি দুর্ঘটনায় সব শেষ হয়ে গেছে। দুটি সন্তানের বয়স একেবারে কম। মানুষের সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে চলি। ফাতেমা নামের আরেক ভিক্ষুক বলেন, আমার চার বছর বয়সী ছেলেটাকে নিয়ে কুমিল্লা থেকে এসেছি। সন্তান জন্মের পর পরই স্বামী আমাকে ছেড়ে অন্যত্র বিয়ে করেছে। এখন মানুষের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাই। আর ঈদ ও শবেবরাতের আগে ঢাকা এসে ভিক্ষা করি। যা আয় হয় সেটা দিয়ে কিছুদিন চলতে পারি।
ঢাকার বায়তুল মোকাররকম মসজিদের গেট ও তার আশেপাশের সড়কে শুক্রবার রাতে ভিড় করেছেন অন্তত পাঁচ শতাধিক ভিক্ষুক। অধিকাংশ ভিক্ষুকের হাত, পা ছিল না। প্রতিবন্ধী ও বিকলাঙ্গ ভিক্ষুকও ছিলেন। নরসিংদী থেকে আসা ভিক্ষুক মরিয়ম বলেন, গত ১০ বছর ধরে আমি আমার দুই প্রতিবন্ধী শিশুকে নিয়ে শবেবরাতের রাতে ভিক্ষা করতে আসি। চটে ঘুম পাড়িয়ে আমি মানুষের কাছে টাকা চাই। কেউ দেয়, কেউ দেয় না। তবে সারা রাত ভিক্ষা করলে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা হয়। পবিত্র রাতে মুসল্লিদের অনেকেই ১০০/৫০০ টাকাও ভিক্ষা দেন। কিন্তু ভিক্ষুকের সংখ্যা বেশি হওয়াতে অনেকে বেশি টাকা দেন না। কারণ সবাইকেই বুঝ দিতে হয়। আজগর আলী নামের ৬০ বছর বয়সী এক ভিক্ষুক বলেন, আমি আর আমার স্ত্রী ভালুকা থেকে এসেছি। প্রতি বছর শবেবরাতের আগে আসি। আর ঈদের আগের দিন বাড়ি যাই। পুরো দেড় মাস রাতদিন ভিক্ষা করি। বাড়ি যাওয়ার সময় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা নিতে পারি। বাড়িতে আমার এক ছেলে ও এক মেয়ে আছে। শুধু আমি না আমাদের ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা এলাকায় কয়েকশ’ মানুষ এই সময়টা ভিক্ষা করার উদ্দেশে ঢাকা আসে।
প্রতি বছরের মতো এবারও হাইকোর্ট মাজার এলাকায় নিয়মিত ও মওসুমি ভিক্ষুকদের ভিড় ছিল। পবিত্র এই রাতে ভিক্ষা করার উদ্দেশে অনেকেই দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এসেছিলেন। পারুল নামের ১৩ বছর বয়সের এক কিশোরী বলেন, আমার বাবা ছোট এক ভাইকে নিয়ে আজিমপুর কবরস্থান এলাকায় গেছেন। ঘরে মা অসুস্থ। তাই আমি হাইকোর্ট এলাকায় আসছি। এখন পর্যন্ত ১২০ টাকা পেয়েছি। আরও কিছুক্ষণ থেকে বস্তিতে চলে যাবো। এদিকে শুক্রবার রাতে, আজিমপুর কবরস্থান এলাকা থেকে শুরু করে হাইকোর্ট মাজার, বায়তুল মোকাররম মসজিদ, মিরপুর শাহআলী মাজার, বনানী কবরস্থান, শাহজানপুর কবরস্থান, তিলপাপাড়া মসজিদসহ আরও বেশকিছু এলাকা ঘুরে দেখা গেছে বিকলাঙ্গ ও প্রতিবন্ধী শিশুদেরকে সামনে রেখেই ভিক্ষা করা হচ্ছে। কিছু কিছু এলাকায় শিশুদেরকে দিয়েই ভিক্ষা করানো হচ্ছে। বায়তুল মোকাররম এলাকায় রিমা নামের এক শিশুর মা আলেয়া বলেন, চাইলেই ভিক্ষা করার সুযোগ নেই। সব স্থানেই সরদাররা নিয়ন্ত্রণ করে। আমার মেয়ে রিমা ভিক্ষা করছে। কারণ শিশুদেরকে মানুষ বেশি ভিক্ষা দেয়। কিন্তু যা আয় হবে তার একটি অংশ সরদারকে দিতে হবে। আমি নিজেও ভিক্ষা করছি। পুরাতন ভিক্ষুকদের কারণে এখানে ঠিকে থাকাই কষ্ট। বায়তুল মোকাররম মসজিদে নামাজ পড়তে আসা খিলগাঁও এলাকার ফার্মেসি ব্যবসায়ী আলিম উদ্দিন বলেন, প্রতি বছরই শবেবরাতের রাতে আমি এই মসজিদে নামাজ পড়তে আসি। কিন্তু অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর ভিক্ষুকের উপদ্রব বেশি। গাড়ি থেকে নামার পরপরই ভিক্ষুকরা টাকা চাওয়া শুরু করেছেন। নামাজ পড়ে বের হওয়ার পরও একই অবস্থা। এত ভিক্ষুককে টাকা দেয়ার সামর্থ্য থাকতে হবে তো। একজনকে দিতে গেলে আরও ১০ জন এসে ধরে। অনেক ছোট ছোট ভিক্ষুক কাপড় ধরে টানাটানি করে। আজিমপুর কবরস্থান এলাকায় সোহেল চৌধুরী নামের এক মুসল্লি বলেন, ভিক্ষুকদের সংখ্যা এতটাই বেড়েছে যে, আজিমপুর এলাকা পুরোটাই শুক্রবার রাতে ভিক্ষুকদের দখলে ছিল। হ্যান্ডমাইক নিয়ে অনেকে ক্যাসেট বাজাচ্ছিলেন। অন্তত ১ হাজার ভিক্ষুক। আসা-যাওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ান ভিক্ষুকরা।