এভাবে ফিরতে পারবো ভাবিনি

0

বিশেষ সংবাদদাতা॥ দেশে এভাবে ফিরতে পারবো, ভাবতেও পারিনি। যা ছিল অকল্পনীয়। অনেক বড় বড় দেশের ক্রুরা আটকে আছেন, তাদের এখন পর্যন্ত উদ্ধার করা যায়নি। কথাগুলো বলছিলেন, ইউক্রেনে সমুদ্রবন্দরে আটকে পড়ে রকেট হামলার শিকার হওয়া ‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধি’ জাহাজের মাস্টার জি এম নূরে আলম। তিনি বলেন, আমরা সবাই আনন্দিত যে, সুস্থভাবে দেশে ফিরতে পেরেছি। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। একইসঙ্গে অত্যন্ত গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি-আমাদের সহকর্মী ও থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুরের মৃত্যুতে। তার মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা তার মরদেহ হিমঘরে রেখে এসেছি। আজ দুপুরে টার্কিস এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান ইউক্রেনের ওলভিয়া বন্দরে রুশ হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ? ‘বাংলার সমৃদ্ধি’ জাহাজের ২৮ নাবিক। পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ওই জাহাজের মাস্টার বলেন, সরকারি দিকনির্দেশনায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন এবং পোল্যান্ড, রোমানিয়া ও অস্ট্রিয়ার দূতাবাসের কঠোর পরিশ্রমের কারণে আমরা দ্রুত আসতে পেরেছি। এত দ্রুত দেশে ফিরতে পারবো এটা ছিল আমাদের জন্য অকল্পনীয়। নূরে আলম বলেন, যেদিন থেকে যুদ্ধ শুরু হয় সেদিন সকাল থেকেই ওলভিয়া বন্দরের চ্যানেল বন্ধ হয়ে যায়। কোনো চ্যানেল ব্যবহার করে সেখান থেকে বের হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। যেদিন জাহাজে গোলা নিক্ষেপ হয়, সেদিন আমাদের রুটিন ব্রিফিং ছিল। বিকাল বেলায় হামলা হয়। তখন আমাদের ব্রিজে আগুন লেগে যায়। আগুন নেভানোর জন্য আমরা ব্যস্ত ছিলাম। আগুন নেভানো হয়। এরপর টেলিভিশনে আপনারা বাকিটা দেখেছেন। দেশবাসী আমাদের জন্য অনেক দোয়া করেছেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর নৌ পরিবহনমন্ত্রী আমাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে বিভিন্ন পরামর্শ ও সাহস দিয়েছেন। এ ছাড়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীও ফোন করে আমাদের নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার পদক্ষেপ নেন।
জাহাজের মাস্টার জি এম নূরে আলম বলেন, ইউক্রেনে গিয়ে যুদ্ধের মধ্যে আটকে পড়া জাহাজটি গত ২রা মার্চ রকেট হামলার শিকার হয়। তাতে মারা যান থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমান। জাহাজের ব্রিজও দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরদিন বিকালে জাহাজ পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয় এবং বাকি ২৮ জনকে সরিয়ে নেয়া হয়। আমরা আতঙ্কিত ছিলাম। আমাদের সরকার যথেষ্ট পদক্ষেপ নিয়েছে। আমরা এখানে সুস্থভাবে আসতে পেরেছি, এটাই বড় কথা। তবে আমরা জার্নি করায় খুব ক্লান্ত। আমরা ফিরে আসলেও সহকর্মী হাদিসুর রহমানের লাশ ইউক্রেনেই রেখে আসতে হয়েছে। এ জন্য আমি গভীরভাবে মর্মাহত, নিহত হাদিসুরের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। সরকার ও করপোরেশনকে অনুরোধ করবো, তার পরিবারকে যেন উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। এবং তার মরদেশ দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। তিনি বলেন, আমাদের নিরাপদে রাখার জন্য তারা সব ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছেন। আমি দেখেছি, রিফিউজিরা (ইউক্রেনের বাসিন্দা) ৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত হেঁটেছেন। কিন্তু আমাদের হাঁটতে হয়নি।
দুপুর ২টার দিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সিআইপি গেটে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পূর্ব ইউরোপ উইংয়ের মহাপরিচালক সিকদার বদিউজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, ইউক্রেনে আলভিয়া বন্দরে রকেট হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধি’র ২৮ নাবিককে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। তবে থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমানের মরদেহ এখনো ইউক্রেনে রয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব ইউক্রেন থেকে হাদিসুরের মরদেহ উদ্ধার করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে। মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে আন্তরিক। তিনি বলেন, হাদিসুরের মরদেহ কতো দিনের মধ্যে নিয়ে আসা সম্ভব হবে তা বলা মুশকিল। কারণ ইউক্রেনে যুদ্ধ চলছে। সেখানে কেউ প্রবেশ করতে পারছে না। তবে আমাদের আন্তরিকতা শতভাগ রয়েছে। সিকদার বদিউজ্জামান বলেন, আমরা অত্যন্ত আনন্দিত। কারণ ইউক্রেনে যে যুদ্ধাবস্থা, সেই পরিস্থিতি থেকে পোল্যান্ড, সোমালিয়া ও অস্ট্রিয়া বাংলাদেশের দূতাবাসসহ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় ২৮ জন (ক্রু মেম্বার) নাবিককে উদ্ধার করে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পেরেছি। শারীরিক পরীক্ষা ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা শেষে ২৮ জন তাদের পরিবারের কাছে ফিরে যাবেন। নিহত হাদিসুর রহমানের পরিবার ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়েছে, সে বিষয়ে আপনারা কি পদক্ষেপ নেবেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক জানান, প্রথমে সেখান থেকে উদ্ধারকাজ সম্পন্ন করতে হবে। তারপর ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবারের জন্য যা করণীয় তা করা হবে। নিহত হাদিসুরের মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনতে আমাদের তিনটি মিশন একসঙ্গে কাজ করছে।
গত শনিবার বাংলাদেশ সময় দুপুরে ইউক্রেনের ওলভিয়া বন্দর সংলগ্ন বাংকার (শেল্টার হাউস) থেকে বেরিয়ে মালদোভার পথে যাত্রা করেন ওই ২৮ নাবিক। সবশেষ গত রোববার বেলা ১১টার দিকে তারা ইউক্রেন সীমান্ত পেরিয়ে মালদোভা হয়ে দুপুরের পর রোমানিয়া পৌঁছান। সেখান থেকে আজ বাংলাদেশে ফিরেন তারা। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী দেশে ফেরা ২৮ নাবিক হলেন- জি এম নূর-ই-আলম, মো. মনসুরুল ইসলাম খান, সেলিম মিয়া, রামকৃষ্ণ বিশ্বাস, মো. রোকনুজ্জামান রাজীব, ফারিয়াতুল জান্নাত তুলি, ফয়সাল আহমেদ সেতু, মো. ওমর ফারুক, সৈয়দ আশিফুল ইসলাম, রাজীবুল আউয়াল, সালমান সরওয়ার সামি, ফারজানা ইসলাম মৌ, মো. শেখ সাদী, মো. মাসুদুর রহমান, মো. জামাল হোসাইন, মোহাম্মদ হানিফ, মো. আমিনুর ইসলাম, মো. মোহিন উদ্দিন, হোসাইন মোহাম্মদ রাকিব, সাজ্জাদ ইবনে আলম, নাজমুল উদ্দিন, মো. নজরুল ইসলাম, সারওয়ার হোসাইন, মো. মাসুম বিল্লাহ, মোহাম্মদ হোসাইন, মো. আতিকুর রহমান, মো. শফিকুর রহমান ও মোহাম্মদ সাইফ উদ্দিন।