উক্রেন: একদিনে তৈরি হয়নি সঙ্কট

0

দেবাশিস চক্রবর্তী॥ ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান বিশ্বজুড়ে প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। এই অভিযান দুঃখজনক তো বটেই, কোনও রাজনৈতিক-সামরিক প্রশ্নের সমাধানও নয়। এই সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হলে বহু মানুষের প্রাণহানি হবে, ইতিমধ্যেই ৮ লক্ষের বেশি মানুষ নিজের বসবাসের এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন। অভ্যন্তরীণ এবং অন্য দেশে শরণার্থী হচ্ছেন। এই সংঘাতে ইতিমধ্যেই এক ভারতীয় ছাত্রের মৃত্যু হয়েছে। কয়েক হাজার ভারতীয় চরম অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছেন। এই সংঘাত ইউরোপে বৃহত্তর সংঘাতের চেহারা নিতে পারে। বিশ্বের অর্থনীতিতেও মারাত্মক প্রভাব পড়তে চলেছে। সঙ্কটে থাকা বিশ্ব অর্থনীতি টালমাটাল হতে থাকবে। যার জের এসে পড়বে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে। সাধারণভাবে মানুষ যুদ্ধের বিরুদ্ধে। এক্ষেত্রে রাশিয়ার তরফেই যেহেতু এই সামরিক অভিযান শুরু হয়েছে, অন্তত আপাতদৃশ্যে সেরকমই, তাই রাশিয়ার বিরুদ্ধে একটি মনোভাব কাজ করছে। যুদ্ধের বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিক্রিয়াকে একটি নির্দিষ্ট খাতে বইয়ে দেওয়ার জন্য পশ্চিমী সংবাদমাধ্যমের ঢালাও প্রচার শুরু হয়েছে। রুশ রাষ্ট্রপতির রাজনীতি ও শাসন নীতি আর যাই হোক প্রশংসাযোগ্য নয়। এখন চেষ্টা চলছে তাঁকে বিশ্ব মানবতার শত্রু হিসাবে খাড়া করার। সব সংঘাতের মতো এই ঘটনারও কিছু প্রেক্ষিত রয়েছে। ক্রেমলিনের ইচ্ছা হলো, তাই একদিন সেনারা পাশের দেশে ঢুকে পড়ল, এই ভাষ্য তত নির্মল নয়। এখন অপ্রিয় শুনতে হলেও কয়েকটি ঘটনা মনে রাখতেই হবে।
১.
ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণকে না বুঝে এই সংঘাতের কোনও ব্যাখ্যাই করা যাবে না। সোভিয়েত ইউনিয়ন থাকার সময়ে তাদের ও মিত্র দেশগুলির ওয়ারশ চুক্তি ছিল। সোভিয়েতের অবসানের পরে ওয়ারশ চুক্তিও ভেঙে যায়। কিন্তু ন্যাটোর অবসান হয়নি, বরং পূর্ব ইউরোপে তাকে ক্রমশ সম্প্রসারণ করা হতে থাকে। ন্যাটোকে ‘শান্তির কাঠামো’ বলে বর্ণনা করে একের পর এক দেশকে তার সদস্য করা হতে থাকে। পোল্যান্ড, চেক সাধারণতন্ত্র, হাঙ্গেরি, পুরানো যুগোস্লাভিয়া ভেঙে তৈরি হওয়া ক্রোয়েশিয়া, মন্টেনেগ্রো, স্লোভেনিয়া, স্লোভাকিয়া ছাড়াও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সাধারণতন্ত্র এস্টোনিয়া, লাতভিয়া, লিথুয়ানিয়াকে ন্যাটোর সদস্য করা হয়েছে। এই তিরিশ বছরে ন্যাটো পূর্বদিকে বেড়েছে ১২৮৭ কিলোমিটার। যে কেউ মানচিত্র খুললে দেখতে পাবেন কীভাবে উত্তর আটলান্টিককে নিয়ে আসা হয়েছে কৃষ্ণসাগর পর্যন্ত। রাশিয়ার দোরগোড়ায় নিয়ে আসা হয়েছে ন্যাটোকে। শুধু ন্যাটোর ভৌগোলিক প্রসারই ঘটেনি, ন্যাটোর নতুন সদস্যদের অস্ত্রসজ্জিত করা হয়েছে। পোল্যান্ডে যেখানে ক্ষেপণাস্ত্র বসনো আছে, সেখান থেকে রাশিয়ার দূরত্ব ১০০ কিলোমিটার। ইউক্রেনকে ন্যাটোর ঘাঁটি বানানো গেলে রাশিয়ার ভেতরে যে কোনও সময়ে মিসাইল ছোঁড়া সহজ হয়ে যাবে। তার যথেষ্ট প্রস্তুতি চলছিল। জার্মান সংবাদপত্র ‘ডের স্পিগেল’ একটি নথি প্রকাশ করে দেখিয়েছে, ১৯৯১ সালেই সোভিয়েত ইউনিয়নকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল ন্যাটো পূর্ব ইউরোপে যাবে না। দুই জার্মানির মিলনের সময়ে ১৯৯১-র মার্চে বনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, ব্রিটেনের ওই সভায় জানানো হয়েছিল জার্মানির এলবে নদীর পরে ন্যাটো আর প্রসারিত হবে না। পোল্যান্ডকেও ন্যাটোর সদস্য করা হবে না। ওয়ারশ চুক্তি বাতিল হয়ে যাবার পরে ন্যাটো পূর্ব ইউরোপে আর থাকবে না, এই মর্মেই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নকে। সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয়নি।
১৯৯৭সালেই বিদেশনীতি বিশেষজ্ঞ জর্জ এফ কেনানের সতর্কবাণী ছিল, শীতল যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মার্কিন নীতির সবচেয়ে মারাত্মক ভ্রান্তি হবে ন্যাটোর সম্প্রসারণ। কিন্তু তাতে কান দেওয়া হয়নি। সোভিয়েত ইউনিয়নে শেষ মার্কিন রাষ্ট্রদূত জ্যাক ম্যাটলক এখনকার সঙ্কট সম্পর্কে বলেছেন, শীতল যুদ্ধের পরে ন্যাটোর সম্প্রসারণ না ঘটলে এখনকার সঙ্কটের কোনও ভিত্তি থাকত না। রাশিয়াকে নিয়েই ইউরোপেই নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে তোলা উচিত ছিল, তা হয়নি। সেই সময়ে কূটনৈতিক মহলে বারংবার বলা হয়েছিল, ন্যাটোর সম্প্রসারণ ঘটলে রাশিয়ার সঙ্গে সংঘাত কোনও না কোনোদিন অনিবার্য হয়ে উঠবে। কিন্তু বিশেষ করে মার্কিন শিল্প-সামরিক জোট অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির ‘নতুন বাজার’ হিসাবে পূর্ব ইউরোপে লাফিয়ে পড়ে। যথেচ্ছ সামরিকীকরণ হতে থাকে। অনেকে এ কারণেই এবারের সংঘাতকে ‘একটি পূর্বঘোষিত যুদ্ধের আখ্যান’ বলে চিহ্নিত করছেন। মস্কো থেকে মার্কিন প্রশাসন এবং ন্যাটোকে পাঠানো ২০০৮-এ মার্কিন দূতাবাসের একটি বার্তা উইকিলিকস ফাঁস করে। সেখানে ন্যাটোর সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে রাশিয়ার নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ ছাড়াও একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ছিল। ইউক্রেনের মধ্যে ন্যাটোর সদস্য হওয়ার পক্ষে-বিপক্ষে আড়াআড়ি ভাগ রয়েছে। এমনই সেই বিভাজন যা দেশের মধ্যে গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে দিতে পারে। ঠিক তা-ই হয়েছে।
অনেকে প্রশ্ন করছেন, একটি স্বাধীন দেশ কার সঙ্গে চুক্তি করবে, তা সে-দেশের ব্যাপার। তা ঠিক। কিন্তু ন্যাটোর সদস্যপদ পাওয়া আর কোনও দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক চুক্তি করা এককথা নয়। ন্যাটো একটি যুদ্ধ জোট। ন্যাটো বিভিন্ন দেশের সার্বভৌমত্বের ওপরে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছে। ন্যাটোর হস্তক্ষেপে পূর্ব ইউরোপের ভূগোল বদলে গেছে। ন্যাটোর সদস্য না হওয়া সত্ত্বেও ইউক্রেনে প্রচুর পরিমাণ অস্ত্র সরবরাহ করা হচ্ছে। ন্যাটো-রাশিয়া ফাউন্ডিং অ্যাক্ট অন মিউচুয়্যাল রিলেশনসে-এর মূল বক্তব্যই ছিল ন্যাটো পূর্ব ইউরোপে কমব্যাট বাহিনী মোতায়েন করবে না। সেই চুক্তি লঙ্ঘন করেই রাশিয়াকে ঘিরতে একের পর এক দেশে সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভোলোদোমির জেলেনেস্কি মিউনিখের নিরাপত্তা সম্মেলন থেকে ফিরেই ঘোষণা করলেন, ১৯৯৪-এর বুদাপেস্ট চুক্তি ছিঁড়ে ফেলে ইউক্রেনকে পরমাণু অস্ত্রসজ্জিত করা এখনই প্রয়োজন। পুতিন নয়, পরমাণু অস্ত্রের প্রসঙ্গ প্রথম তুলেছেন জেলেনেস্কি। বা, তাঁকে দিয়ে তোলানো হয়েছে।
২.
ইউক্রেনে দু’দশক ধরে তৎপরতা চালিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। প্রথমে হয়েছিল ‘কমলা বিপ্লব’। ২০১৪ সালে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করা হয়। রাষ্ট্রপতি ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। এই অভ্যুত্থান তৈরি করা হয়েছিল মার্কিন মদতে। এই অভ্যুত্থানের পিছনে মার্কিনী অন্যতম মস্তিষ্ক ছিলেন ভিক্টোরিয়া নুলান্ড। যিনি এখন মার্কিন রাজনৈতিক বিষয়ের আন্ডার সেক্রেটারি। ইউক্রেনে সরকার পালটে কাদের বসানো হবে তা-ও তিনি ঠিক করেছিলেন। ‘মাইদান’ অভ্যুত্থানে অতি দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদীদের মার্কিন ঋণ দেবার ব্যবস্থাও করেছিলেন তিনি। সিআইএ এই অভ্যুত্থানকে সাজিয়েছিল। একটি ছোট তথ্য এই যে তদানীন্তন মার্কিন উপ রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনকেই ইউক্রেনে অপারেশনের মূল মাথা বলে চিহ্নিত করা হয়! এই অভ্যুত্থানের পরেই ইউক্রেনে রুশ ভাষাভাষীরা আক্রান্ত হতে থাকেন। নতুন সরকারের প্রথম সিদ্ধান্তই ছিলো রুশ আর সরকারী ভাষার মর্যাদা পাবে না। ইউক্রেনের এক তৃতীয়াংশ মানুষ রুশ ভাষাভাষী। ক্রিমিয়াগামী বাসে, ওডেশায় আক্রমণে রুশভাষীদের হত্যা করা হয়। এই অভ্যুত্থানের প্রত্যক্ষ ফলাফল ছিল ক্রিমিয়া বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। সেখানে এবং পূর্ব ইউক্রেনের দোনেৎস্ক, লুগানস্কে বিচ্ছিন্নতাকামীদের তৎপরতা বাড়ে। ক্রিমিয়ায় গণভোটে বিপুল গরিষ্ঠতায় মানুষ রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হবার রায় দেন। দোনেৎস্ক, লুগানস্কে ইউক্রেনের সেনাদের সঙ্গে গত আট বছর ধরে সংঘর্ষে ১৫ হাজার মানুষ মারা গিয়েছেন। এই দুই অঞ্চল নিজেদের স্বাধীন সাধারণতন্ত্র বলে ঘোষণা করলেও রাশিয়ার স্বীকৃতি এতদিন মেলেনি। ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর আগের দিন রাশিয়া স্বীকৃতি দেয়। ২০১৪-১৫-তে মিনস্কে ইউক্রেনের সরকার এবং বিচ্ছিন্নতাকামীদের মধ্যে সংঘর্ষবিরতির মধ্যস্থতায় বসে ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া। সেখানে বলা হয়েছিল ইউক্রেন এই দুই অঞ্চলকে স্বায়ত্তশাসন দেবে। কিন্তু ইউক্রেন সে-পথে হাঁটেনি। বরং দেশের সংবিধানকে এমনভাবে পরিবর্তন করা হয় যাতে সেই স্বায়ত্তশাসন অসম্ভব হয়।
৩.
ইউক্রেন নয়া নাৎসি এবং শ্বেতাঙ্গ জাতিবিদ্বেষীদের ঘাঁটি হয়ে উঠেছে। অ্যাজভ বাহিনীর নাম এখন সংবাদে এসেছে। নয়া নাৎসি এবং শ্বেত আধিপত্যের মতাদর্শে বেড়ে ওঠা উগ্র জাতীয়তাবাদী সংগঠনের মধ্যে থেকে এই বাহিনী গড়ে তোলা হয়েছে। দুই জাতিবিদ্বেষী সংগঠন প্যাট্রিয়ট অফ ইউক্রেন এবং সোশাল ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির মধ্যে থেকে অ্যাজভ বাহিনী গড়ে ওঠে। দীর্ঘ সময় ধরেই এই দুই সংগঠন অভিবাসী, সংখ্যালঘু এবং রোমা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাচ্ছিল। ২০১৪ সালে ইউক্রেনে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে উৎখাত করার জন্য যে বিক্ষোভ তৈরি করা হয়েছিল, সেখানে অন্যতম অংশগ্রহণকারী ছিল এই দুই সংগঠন। ২০১৪-র নভেম্বরেই এই দুই সংগঠনের মিলিত অ্যাজভ বাহিনীকে সরাসরি দেশের সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তারা নয়া নাৎসি জেনেও এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়। তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি পেট্রো পোরোশেঙ্কো বলেছিলেন, ‘এরাই আমাদের সেরা যোদ্ধা, সেরা স্বেচ্ছাসেবক’। ইউক্রেনই বিশ্বের একমাত্র দেশ যেখানে নাৎসিদের সরকারি সেনাবাহিনীতে নেওয়া হয়েছে। প্যাট্রিয়ট অব ইউক্রেন এবং সোশাল ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি দুই সংগঠনেরই নেতা ছিলেন আন্দ্রেই বিলেৎস্কি। তাঁর অনুগামীরা তাঁকে ডাকেন ‘শ্বেত শাসক’ বলে। ২০১০-এই বিলেৎস্কি ঘোষণা করেন, ‘ইউক্রেনের জাতীয় লক্ষ্য হলো নিম্নশ্রেণির জাতির বিরুদ্ধে চূড়ান্ত যুদ্ধে বিশ্বের শ্বেতাঙ্গদের নেতৃত্ব দেওয়া’। ২০১৬-তে রাষ্ট্রসঙ্ঘের রিপোর্টে অ্যাজভ বাহিনীকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অজস্র অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। দোনবাসে গণহত্যা ও ধর্ষণের অভিযান চালানোর জন্যও তাদের চিহ্নিত করা হয়। ২০১৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করেছিল তাদের সেনারা অ্যাজভ বাহিনীর সঙ্গে কোনও মহড়া বা প্রশিক্ষণে অংশ নেবে না। পরের বছরেই পেন্টাগনের চাপে এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহৃত হয়। মার্কিন কংগ্রেসেও দাবি উঠেছিল এই বাহিনীকে ‘বিদেশি সন্ত্রাসবাদী শক্তি’ হিসাবে চিহ্নিত করার। ইউক্রেনের সরকারের মদতে অ্যাজভ গোটা ইউরোপের নয়া নাৎসিদের সামরিক প্রশিক্ষণের কাঠামো হয়ে উঠেছে। নানা দেশ থেকে অতি দক্ষিণপন্থী এবং নয়া নাৎসিরা এসে তাদের কাছে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে যাচ্ছে।
৪.
পূর্বাপর ঘটনাক্রম ইঙ্গিত করছে ইউক্রেনকে দিয়ে রাশিয়ার সীমান্তে ন্যাটোকে এনে ফেলার ছক তৈরিই ছিল। বস্তুত, এখানেই থেমে থাকার ব্যাপার নয়। রাশিয়াকে কবজা করা, পূর্ব দিকে আরও এগনো, প্রশান্ত মহাসাগর ও ভারত মহাসাগরে মার্কিনী আধিপত্য ও উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলে চীন পর্যন্ত পৌঁছানোর নকশা মার্কিনী সামরিক নথিপত্রেই যথেষ্ট পরিমাণে রয়েছে। এখন ‘বিশ্বযুদ্ধের’ কথা বলা হচ্ছে, তার আগাম পরিকল্পনা কারা করছে? আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহলে একটি পরিচিত কথা আছে: আমেরিকার বন্ধু হওয়ার থেকে শত্রু হওয়া ভালো। শত্রু হলে আমেরিকা কেনার চেষ্টা করতে পারে, বন্ধু হলে বিক্রি করে দেবে। ইউক্রেনকে এখন আমেরিকা বিক্রি করছে তাদের বিশ্ব রণনীতির সম্প্রসারণের লক্ষ্যে। যা ক্ষয়ক্ষতি হবার তা ইউক্রেনের হবে, ফয়দা লুটবে আমেরিকা ও তার মিত্ররা। ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক আক্রমণ নিয়ে বিশ্বে যে প্রতিকূল প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তার অর্থ বোঝা যায়। কিন্তু আমেরিকার কান্না কি কুমিরের নয়? ১৯৪৫ থেকে শতাধিক দেশে মার্কিন সেনারা আক্রমণ করেছে। এখনও ১৩০ দেশে আমেরিকার ৭৫০ সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। আমেরিকাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বৃহত্তম ‘সাম্রাজ্য’ গড়ে তুলেছে। ভিয়েতনাম থেকে ইরাক, সিরিয়া থেকে সোমালিয়া— কোথায় নেই আমেরিকা? আমেরিকার মদতে ইজরায়েল প্যালেস্তাইনের ওপরে কয়েক দশক ধরে হামলা চালাচ্ছে, সেই মার্কিন রাষ্ট্রপতির মুখে ‘স্বাধীনতার’ কথা মানায় নাকি? পশ্চিম সাহারায় মরক্কোর দখলদারি চলছে মার্কিন মদতে। সুদানকে ভেঙে দক্ষিণ সুদান বানিয়ে স্থায়ী যুদ্ধ বাধিয়ে রেখেছে আমেরিকা।
৫.
আজকের রাশিয়া সোভিয়েত ইউনিয়ন নয়। রাশিয়ার অভ্যন্তরে সমাজতন্ত্রের সময়কার সুফল ধীরে ধীরে ধ্বংস করা হয়েছে। এমনকি ইউক্রেনের বিরুদ্ধে অভিযান ঘোষণার ভাষণেও ভ্লাদিমির পুতিন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার সূচনালগ্নের নেতাদের দায়ী করেছেন ইউক্রেনের পৃথক অস্তিত্বের জন্য। কিন্তু রাশিয়ার নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগ ন্যায়সঙ্গত। রাশিয়ার দীর্ঘ সময়ের দাবি, ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য করা চলবে না। ইউক্রেনের ন্যাটো-নিরপেক্ষতার ঘোষণায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে পশ্চিমী শক্তিগুলি। রাশিয়ার নিরাপত্তার প্রশ্ন সহ ইউরোপের নিরাপত্তা কাঠামোর জন্য পূর্ণাঙ্গ আলোচনা এখনই জরুরি। এতদ্‌সত্ত্বেও সম্প্রসারণবাদের উত্তর সামরিক অভিযান নয়। রাশিয়ার সামরিক অভিযান তাই সমর্থনযোগ্য নয়। বরং দ্রুত শান্তি আলোচনা, সংঘর্ষবিরতি, ইতিমধ্যেই স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলিকে মান্য করার কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করা দরকার।
সূত্র:-গণশক্তি