চাকরিবিধি নিয়ে এখনও আতঙ্কে দুদকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা

0

॥ নুরুজ্জামান লাবু॥
চাকরি বিধির ৫৪(২) ধারা নিয়ে এখনও আতঙ্কে দিন পার করছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উপ-সহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিনকে আকস্মিক বহিষ্কার করায় তারা এখন আগের মতো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন না। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে চাকরি হারানোর ভয় পেয়ে বসেছে। তাদের ভাষ্য, দুদকের কাজের গতি শ্লথ হয়ে এসেছে। তবে দুদকের সচিব মাহবুব হোসেন জানান, দুদকের কার্যক্রমের গতি শ্লথ হয়নি। দুদকের কাজ থেমে যায়নি, স্বাভাবিক গতিতেই কার্যক্রম চলছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আশ্বস্ত করা হয়েছে, কারও ভয় পাওয়ার কিছু নেই। স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে না—এমন কোনও পরিস্থিতি এখানে তৈরি হয়নি। সবাই স্বাধীনভাবে কাজ করছে। নির্ভয়ে বিধি মোতাবেক কাজ করতে হবে। কমিশনও অন্যায়ভাবে বা বিধিবর্হিভূত কোনও কাজ করবে না। দুদকের এই কর্মকর্তা বলেন,‘গত ২৮ ফেব্রুয়ারি আমাদের মাসিক সমন্বয় সভা হয়েছে। বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও এই সভায় যুক্ত ছিলেন। সবাইকে নির্ভয়ে কাজ করতে বলা হয়েছে। ভয়ের কোনও কারণ নেই। চাকরি বিধিমালায় ৫৪/২ ধারা আগে থেকেই ছিল। নতুন করে এটা ইনসার্ট করা হয়নি। এটি আদালতেও অবতারণা হয়েছে। এটি নিয়ে এখনই কোনও মতামত দেওয়া সমীচীন হবে না।’
দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, দুদকে এখন একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। কেউ কোনও অনুসন্ধান বা তদন্ত করার আগে ১০ বার ভাবছে। দেশের জন্য কাজ করতে গিয়ে কেউ প্রভাবশালীদের রোষানলে পড়তে চাইছে না। এই অবস্থা চলতে থাকলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান বা কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কর্মকর্তাদের ভাষ্য, সাধারণ মানুষ দুর্নীতি করে কম। দুর্নীতি করে প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই। তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত বা অনুসন্ধান করতে গিয়ে যদি আকস্মিক চাকরি হারাতে হয়, তাহলে সবাই তা পাশ কাটিয়ে যাবে। তদন্ত বা অনুসন্ধান করতে গিয়ে কেউ যদি বিধি লঙ্ঘন করে বা আর্থিকভাবে লাভবান হয়, এগুলো প্রমাণ সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। আর যদি শুধু অভিযোগের প্রেক্ষিতেই কারও বিরুদ্ধে চূড়ান্ত শাস্তি দেওয়া হয়, তাহলে তো কর্মপরিবেশ স্বাভাবিক থাকতে পারে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপ-পরিচালক পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা জানান, সাম্প্রতিক ঘটনা নিয়ে দুদকে এক ধরনের অস্থিরতা চলছে। সবাই ভয় আর আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। নোটিশ জারি বা জিজ্ঞাসাবাদের সবকিছুই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুমোদন নিয়ে করা হয়। কিন্তু অভিযোগ ওঠার পর শুধু তদন্ত বা অনুসন্ধান কর্মকর্তাকে শাস্তি দেওয়া হয়।’
দুদকের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘দুদকে তদন্ত বা অনুসন্ধানের মূল কাজগুলো করেন উপ-সহকারী পরিচালক, সহকারী পরিচালক বা উপ-পরিচালক পর্যায়ের কর্মকর্তারা। এরা সবাই দুদকের স্থায়ী নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা। আর ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে বেশিরভাগই বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে আসেন। তারাও নানারকম প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেন। অনেক সময় অবৈধ আদেশ না শুনলেও চাকরিতে নানা সমস্য তৈরি হয়। এভাবে তো কাজের পরিবেশ ঠিক রাখা সম্ভব না।’
এদিকে মঙ্গলবার দুদক সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মশিউর রহমান স্বাক্ষরিত পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতেও সাম্প্রতিক ঘটনায় দুদকে কর্মপরিবেশ বিনষ্ট হয়েছে এবং হচ্ছে বলে মন্তব্য করা হয়েছে। ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গত ২০ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)এ সুষ্ঠু অনুসন্ধান এবং তদন্তের কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা এবং চাকরি বিধিমালার বিতর্কিত ৫৪(২) বিধির বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টেও আপিল বিভাগে পেন্ডিং আবেদন কমিশন কর্তৃক প্রত্যাহারের বিষয়ে দুদকের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীর পক্ষ হতে কমিশনের চেয়ারম্যান বরাবর কমিশনের সচিবের মাধ্যমে আবেদন করা হয়। এরপর দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও কমিশনের পক্ষ থেকে কোনও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোনোরূপ আশ্বস্তও করা হয়নি। সম্প্রতি এমন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে (যেমন:বিভাগীয় মামলা দায়ের, শোকজ ইত্যাদি) যা প্রতিষ্ঠানের দাফতরিক কর্মপরিবেশকে নষ্ট করছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, কোনও ধরনের নোটিশ ব্যতীত আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে শুধু তিন মাসের বেতন দিয়ে রাজস্ব খাতভুক্ত সরকারি কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করা হলে ওই কর্মচারী দ্বারা স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব নয়। অতি সম্প্রতি দুদক চাকরি বিধিমালার বিতর্কিত বিধি ৫৪(২) এর প্রয়োগ এবং সব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষে দাখিলকৃত আবেদনের প্রেক্ষিতে কমিশন হতে কোনও সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা না পাওয়ায় দুদকের সর্বস্তরের কর্মচারীদের মধ্যে চাকরির নিরাপত্তাহীনতা, হতাশা ও আস্থাহীনতার পরিবেশ বিরাজ করছে। দুদক একটি স্বাধীন ও স্বশাসিত সংস্থা, যার কর্মচারীরা প্রভাবমুক্ত ও স্বাধীনভাবে অনুসন্ধান/তদন্ত করবেন। কিন্তু চাকরি বিধিমালার বিতর্কিত বিধি ৫৪(২) এর প্রয়োগের ফলে স্বাধীনভাবে কাজ করার কর্মপরিবেশ থাকছে না। এমন পরিস্থিতিতে দুদক সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে দুদক সচিবের কাছে বর্ণিত পরিস্থিতির অবসানে কমিশনের নিয়মিত সভায় আবেদিত বিষয়সমূহ আলোচনা-পূর্বক কমিশনের পক্ষ হতে সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনা এবং সিদ্ধান্ত দুদকের কর্মচারীদেও লিখিতভাবে জানানোর জন্য অনুরোধ করা হয়। এ বিষয়ে কমিশনের সদয় সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে দুদকের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।