চৌগাছা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ ঐতিহ্যের ধারক ঢেঁকি

0

মুকুরুল ইসলাম মিন্টু চৌগাছা (যশোর) ॥ ধান ভানার জন্য এক সময়ের অপরিহার্য যন্ত্র ছিল ঢেঁকি। যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে যেয়ে গ্রামবাংলার প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারক ধান ভানার ঢেঁকি এখন বিলুপ্তি প্রায়। দুইযুগ আগেও ঢেঁকি আমাদের কৃষিনির্ভর গ্রামীণ জনপদে খুব প্রয়োজনীয় একটি উপকরণ ছিল। আগেকার যুগে গ্রামের প্রত্যেক গৃহস্থ বাড়িতে ধান ভানা ও চালের গুড়া কিংবা চিড়া কোটার জন্য ঢেঁকির ব্যবহার করত। গ্রামীণ এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখা জরুরী বলে মনে করছেন সচেতন মহল।
সীমান্তবর্তী উপজেলা যশোরের চৌগাছার প্রতিটি গ্রামে বাড়িতে বাড়িতে এক সময় ব্যাপক ভাবে দেখা মিলত প্রাচীন এই ঐতিহ্য। গায়ের বধুরা একত্রিত হয়ে ঢেঁকিতে ধান ভানা, গুড়া ও চিড়া কুটা, শীত মৌসুমে কুমড়া বাড়ি কুটার কাজ করত দলবেধে। কে গরীব আর কে বড়লোক কোনই ভেদাভেদ ছিলনা। এক একটি মহল্লার সকল গৃহীনিরা পালাক্রমে ঢেঁকিতে এসব কুটার কাজ করতেন। এক সময় ধান ভানার জন্য ছিলনা কোন মেশিন, তখন ধান থেকে চাল করতে একমাত্র উপায় ছিল ঢেঁকি। নারীরা সারা রাত ঢেঁকিতে ধান ভানত তখন। ঢেঁকি যে বাড়িতে আছে সেই বাড়িই ছিল গ্রামের প্রভাবশালী বাড়ি এমনটি অনেকে মনে করতেন। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় কলের যন্ত্রের কাছে কাঠের এই ঢেঁকি আজ হার মেনেছে। গ্রামের পর গ্রাম খুজলেও সেভাবে আর ঢোঁকির দেখা মেলেনা।
গতকাল পৌর এলাকার ঐতিহ্যবাহি কুঠিপাড়া মহল্লায় যেয়ে প্রাচীন ঐতিহ্যের দেখা মেলে। চৌগাছা-মাশিলা সড়কের পাশে অত্যান্ত মনোরম পরিবেশ চারিদিকে বাঁশঝাড় আর মেহগনি বাগান, খোলা আকাশ মাঝে মাঝে সূর্যের আলো এসে পড়ছে মাটিতে অপরুপ এক সৌন্দর্য। সেই সৌন্দর্য স্থানে বসানো আছে কাঠের ঢেঁকি, যে ঢোঁকিতে স্থানীয় বধুরা গুড়া কুটার কাজে ব্যস্ত। গত কয়েক দিনের মেঘাচ্ছন্ন আকাশের কারনে তারা গুড়া কুটতে পারেনি। এখন সূর্যের দেখা মিলছে, তাই মহল্লার বধুরা এক সাথে গুড়া কুটতে বসেছেন। দুইজন ঢেঁকিতে পাড় দিচ্ছেন, একজন গৃহবধু গুড়া ঢেকির নিচে নাড়াচড়া করছে অপর একজন গুড়া টুকনি নিয়ে বাছায় কাজে ব্যস্ত আছেন। এসময় কথা হয় মহল্লার বধু শিল্পি খাতুনের (২৫) সাথে। তিনি বলেন, ছোটবেলাতে আমাদের গ্রামে বাড়িতে বাড়িতে ঢেঁকি ছিল। ধান ভানার কাজের পাশাপাশি বছরের কিছু গুরুত্বপূর্ন কাজ যেমন গুড়াকুটা, চিড়া বা কুমড়াবড়ি কুটা হত। এখন কারেন্টের কল হয়ে ঢেঁকে নিয়ে কারও তেমন ভাবনা নেই। সকলেই ওই কলের ঢেঁকিতে এসব কাজ করেন। তবে কলের ঢেঁকির যেয়ে কাঠের ঢেঁকিতে কুটা চিড়া, কুমড়াবড়ি ও গুড়ার স্বাদ বহুগুন বেশি।
মহল্লার অপর নারী আম্বিয়া বেগম (৫৫), মাজেদা বেগম (৫০) বলেন, ঢেঁকি হচ্ছে গ্রামের মানুষের কাছে ঐতিহ্যের ধারক। বহু আগে যে সব বাড়িতে ধান রাখা গোলা, গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ আর ঢেঁকি ছিল তারাই ছিল গ্রামের সেরা বড় লোক। এসব দেখে অনেকে ছেলে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। কিন্ত এখন আর সেই সব দেখা যায়না। ঢেঁকি খুবই সহজ একটি জিনিস, এটি রাখার জন্য তেমন কোন জায়গাও লাগেনা। তারপরও ঢেঁকি হারিয়ে গেছে। আগের মানুষ গুলো ঢেঁকিতে সারারাত ধান ভেনেছে, গুড়া, চিড়ে কুটেছে তাদের শরীরে কোন রোগ ছিলনা। এখনকার মেয়েরা ওই কাজের সাথে অভ্যস্তনা,তাই শরীরের বেঁধেছে হরেক রকমের রোগ।
বিশেষজ্ঞরা জানান, সাদা চালের চেয়ে ঢেঁকি ছাটা চাল পুষ্টি গুনের দিক থেকে উৎকৃষ্ট। সাদা চালের মত ঢেঁকি ছাটা চাল ( ব্রাউন রাইচ) বেশি পালিস হয়না। তাই দেখাতে লাল এই চালের উপকারিভাগে রাইস ব্রাউন বা ধানের তুষের কিছুটা অংশ থেকে যায়। এই ব্রাউন রাইস হজম হতে বেশি সময় লাগে বলে ধীরে ধীরে সারাদিন শরীরে প্রচুর শক্তি যোগান দেয়। অতীত ইতিহাস ঐতিহ্য যাতে পরবর্তী প্রজন্ম জানতে পারে সে জন্য প্রাচীন ঐতিহ্যের এসব উপকরণ সংক্ষন করা অতীব প্রয়োজন মনে করছেন সচেতন মহল।