আমেরিকা কী ইউক্রেনকে বাঁচাতে পারবে?

0

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেরগেই ল্যাভরভ সর্বশেষ যে কথা বলেছেন, এতে পরিষ্কার যে, আপাতত রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করছে না। তার কথা হল. ‘রাশিয়া যুদ্ধ চায় না, তবে তার স্বার্থে যেকোন ব্যবস্থা নিতে তৈরি।’ কিন্তু যুদ্ধ যদি সত্যি লেগেও যায়, তবে আমেরিকা কী ইউক্রেনকে বাঁচাতে পারবে? পশ্চিমা বিশ্লেষকরা বলছেন, আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন তথা ন্যাটো কতটা পারবে সেটা বোঝা গেছে জর্জিয়া আর ক্রিমিয়ায় পুতিনের একশনের সময়ই। কিছুই করতে পারেনি। সুবিধাজনক অবস্থায় আছে রাশিয়াই। জর্জিয়া এবং ক্রিমিয়ার অভিজ্ঞতা, আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনীর ব্যর্থতা রাশিয়ার সাথে যুদ্ধ অথবা পূর্ব ইউরোপে রাশিয়ার কোন আগ্রাসন বাইডেনের জন্য সহজ কোন হিসেব নয় বলেই সবাই বলছে।
সম্প্রতি ইউক্রেনের পূর্ব সীমান্তে বিপুলসংখ্যক রুশ সেনা মোতায়েন নিয়ে মস্কোর সঙ্গে ইউক্রেন ও পশ্চিমা দেশগুলোর উত্তেজনা চলছে। কিয়েভ ও পশ্চিমা দেশগুলোর আশঙ্কা, ইউক্রেনে সামরিক হস্তক্ষেপের পরিকল্পনা করছে মস্কো। তবে মস্কো এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। চলমান এই উত্তেজনার মধ্যেই ইউক্রেন সংকট নিয়ে আলোচনার জন্য আগামী সোমবার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে একটি উন্মুক্ত বৈঠক ডেকেছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট বাইডেন ৮৫০০ সৈন্য প্রস্তুত রেখেছে দ্রুততার সাথে ইউরোপে মোতায়েনের জন্য। এরা ন্যাটোর বহুজাতিক ৪০,০০০ সৈন্যের যে ইউনিট আছে তার মার্কিনী অংশ, যারা সদস্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যেকোন আগ্রাসন ঠেকাতে সবসময় প্রস্তুত। এ ছাড়া পোল্যান্ডে রাখা বিমান বাহিনীর বিমান, এবং এয়ারবোর্ন ডিভিশনের আরও ৩০০০ সেনা আছে পাঠানোর মত। কিন্তু এগুলো সব একত্রিত করেও রাশিয়ার সামনে দাঁড়ানো সহজ হবে না বলেই ধারণা করছে খোদ পেন্টাগন বিশেষজ্ঞরা। কারণ এরা কেউই সমপর্যায়ের কোন শক্তির সাথে আধুনিক লড়াই করার মতো প্রশিক্ষিত নয়। ‘যুদ্ধের মাঠে সেনা পাঠানো, সমরাস্ত্রের সমাবেশ ঘটনো সহজ, যুদ্ধ করা কঠিন,’ বলছেন মার্কিন মেরিন মেরিনের সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা স্কট রিটার। জো বাইডেন সামরিক শক্তি দেখাতে চান। কিন্তু গত ২০ বছরে আমেরিকার কমব্যাট রেডিনেসের দুর্দশা সবারই জানা।
২০০৮ সালে রাশিয়া- জর্জিয়া যুদ্ধে এবং ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া সংকটের সময় ইউরোপে ৫০,০০০ সেনা ছিল আমেরিকার। কিন্তু স্থল যুদ্ধে রাশিয়াকে মোকাবেলা করার মতো ঝুঁকি নেয়নি। স্কট রিটারের ভাষায়, ‘আমেরিকা এখন এক ব্যর্থ সুপার পাওয়ার, আর ন্যাটো এক লক্ষ্যহীন সংস্থা।’ গত তিন দশকে অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে। ১৯৯০ সালে ইউরোপে আমেরিকার ২১৩,০০০ সৈন্যের দুটি ব্রিগেডে মোতায়েন ছিল যাদের বলা হতো কমব্যাট রেডি। প্রতিটি ব্রিগেডে একটি করে ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন, একটি আর্মার্ড ডিভিশন এবং একটি আর্মার্ড ক্যাভালরি রেজিম্যান্ট ছিল। এ ছাড়া ১০ দিনের মধ্যে তিনটি ম্যাকানাইজ্ড ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন, দুটি আর্মার্ড ব্রিগেডসহ আরও আরও সেনা ও সমরাস্ত্র মোতায়েনের সক্ষমতা ছিল। সব মিলিয়ে ৫৫০,০০০ মার্কিন সেনা ছিল পশ্চিম ইউরোপে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আমেরিকা এবং ন্যাটো সদস্যরা সামরিক ব্যয় কমাতে উদ্যোগী হয়। ২০০৮ থেকে সক্ষমতার বিচারে ইউরোপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপ ব্রিগেডকে আর উপযুক্ত মনে করা হচ্ছে না। অন্যদের অবস্থাও তেমন। আজ জার্মানি একটিও আর্মার্ড ব্রিগেড তার ব্যারাক থেকে বাইরে আনার মত প্রস্তুত নয়। একইভাবে ন্যাটোতে এক সময় বৃটিশ আর্মির সদস্য সংখ্যা ছিল ৫৫,০০০। এখন মেইন র্যান্ড ইউরোপে কোন বৃটিশ সেনা নেই। বৃটিশরা এখন দুটি আর্মার্ড ব্রিগেড মোতায়েন করতে পারবে, যার একটি কেবল শর্ট নোটিশে ইউরোপের মাটিতে অর্থপূর্ণ পাওয়ার প্রজেকশনে সক্ষম। প্রতিটি ন্যাটো সদস্য দেশের এই অবস্থা। আকার কমানোর সাথে সাথে কমেছে প্রশিক্ষণ। এখন যে ধরনের ব্যাটালিয়ন এবং ব্রিগেড ন্যাটোতে আছে সেগুলো মূলত ছোটখাট সংঘাত মোকাবেলার মত। যুদ্ধ করার মতো নয়। তবে রাশিয়াও এমন অবস্থার ভেতর দিয়ে গিয়েছে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পর রাশিয়ার সামরিক বাহিনীও বড় সঙ্কটের ভেতর দিয়ে গেছে। ১৯৮৮ সালে রাশিয়ার একক সৈন্য সংখ্যা ছিল ৫৫ লাখ। এক দশক পর ১৯৯৮ সালে তা নেমে আসে ১৫ লাখে। ন্যাটোর সাথে সংঘাতের কোন শক্তিই ছিল না রাশিয়ার। এমনকি চেচেন বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধেও রাশিয়ার শক্তিহীন অবস্থা দেখা গেছে। ২০০০ সাল থেকে অবস্থা পাল্টাতে থাকে। প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন পুরো রাশিয়ার সামরিক শক্তিকে ঢেলে সাজাতে থাকেন। পুতিনের মাথায় আবার জেগে উঠে সেই পুরোনো দর্শন – ‘রাশিয়া একটি দেশ শুধু নয়, রাশিয়া এক সাম্রাজ্য, তার সামরিক বাহিনীকে দুর্বল করে রাখা যাবে না।’ এবং এই মন্ত্রের বলেই দ্বিতীয় যুদ্ধে খুব স্বল্প সময়ে চেচেন বিদ্রোহীদের পরাজিত করে, যেটা আমেরিকা বা ন্যাটো ২০ বছরেও পারেনি আফগানিস্তানে। একইভাবে ২০০৮ সালে জর্জিয়ার সাথে যুদ্ধে এবং ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল করে পুতিনের সেনারা বুঝিয়ে দেয় তাদের ক্ষিপ্রতা ও সক্ষমতা। ন্যাটো পূর্ব ইউরোপে সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়ায় পুতিন স্নায়ু যুদ্ধের সময়কার দুটি মিলিটারি ফর্মেশনে বড় পরিবর্তন আনে। এর একটি হলো ফার্স্ট গার্ড ট্যাংক আর্মি, আরেকটি হলো ২০তম কমবাইন্ড আর্মস আর্মি যারা দ্রুততার সাথে বড় অপারেশন চালাতে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত। বাস্তবতা হলো আমেরিকা আর ন্যাটো সেই যুদ্ধই ভুলে গেছে। ইউক্রেনের সীমান্তে সমাবেশের পাশাপাশি রাশিয়া বেলারুশে ডেপ্লয়মেন্ট বাড়িয়েছে। এবং পুরোটাই করছে সামরিক সক্ষমতা প্রদর্শন করতে। ন্যাটোও পূর্ব ইউরোপে সম্প্রসারিত হয়েছে। একটি পুরোপুরি যুদ্ধের কথা কেউ বলছে না, তবে বাস্তবতা হলো সুবিধাজনক অবস্থায় আছে রাশিয়াই। জর্জিয়া এবং ক্রিমিয়ার অভিজ্ঞতা, আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনীর ব্যর্থতা রাশিয়ার সাথে যুদ্ধ অথবা পূর্ব ইউরোপে রাশিয়ার কোন আগ্রাসন বাইডেনের জন্য সহজ কোন হিসেব নয় বলেই সবাই বলছে।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।