সালাহউদ্দিন বাবর
একসময় গ্রামীণ জনপদে ‘খনার বচন’, নানা সব ‘প্রবাদবাক্য’, আসর জমিয়ে পুঁথি পাঠ করে গভীর মনোযোগ দিয়ে মানুষ সেসব বচন, প্রবাদবাক্য শুনত, আর আমোদ আহ্লাদে মেতে উঠত। তা ছিল গ্রামীণ সংস্কৃতির এক অনুষঙ্গ। তবে এসব বচন, বাক্য নিয়ে শুধু আমোদই নয়, তাতে যে গভীর জীবনবোধ গূঢ় তথ্য-তত্ত¡ রয়েছে তা নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা ব্যাখ্যা করে নিজেদের জীবনাচরণে অনুশীলন করার মাধ্যমে তারা তাদের বোধ বিবেচনা আর অভিজ্ঞতাকে সুসজ্জিত সমৃদ্ধ করত। আজ হয়তো সেই চলন, চর্চা তেমন নেই। আমরা শহরে বসবাস করি; সে জন্য এসব নিয়ে তেমন ভাবি না। এ ক্ষেত্রে মনে হয়, কবি গগনচন্দ্র দাসের কবিতার কয়েকটি চরণ নিয়ে ভেবে দেখা দরকার এবং সেই সব বচন প্রবাদের মাঝে আজো অনেক কিছু শেখার আছে। স্মরণ করা যেতে পারে- ‘যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলে পাইতে পার অমূল্য রতন।’ আমাদের এসব নিয়ে তাচ্ছিল্য করা ঠিক নয়। এসব বচন প্রবাদে ঝিনুকে যেমন মুক্তা লুক্কায়িত থাকে, তেমনি এসবের মাঝে মুক্তা লুক্কায়িত আছে।
যাদের মন-মস্তিষ্ক থেকে এসব প্রসূত, তাদের অপূর্ব অভিজ্ঞান অভিজ্ঞতা জীবনকে উপলব্ধি করা নিয়ে পাণ্ডিত্যে স্ফুরণ রয়েছে। আজকেও আমাদের ব্যক্তি ও সমাজ এসব বচন প্রবাদ থেকে অনেক কিছুই অনুধাবন করে নিজেদের সমৃদ্ধ করতে পারা যায়। জীবনের কোনো ঘটনা ও বিষয় সম্পর্কে সিদ্ধান্তে পৌঁছার ক্ষেত্রে এসব স্মরণে নেয়া যায়। এসব বাক্যবচন ও প্রবাদের মাঝে সুদূর অতীতের ব্যক্তিদের প্রজ্ঞা-পাণ্ডিত্যের প্রসারতার কথা ভেবে তাদের প্রতি শ্রদ্ধায় মন বিনম্র বিগলিত হয়ে ওঠে। যাই হোক, আজ এই কলামের সূচনা করতে চাই সেই দু’টি প্রবাদবাক্য দিয়ে যার কিনা আজকের প্রেক্ষাপটের সাযুজ্য পাওয়া যেতে পারে। যেমন, ‘বৃক্ষ তোমার ফলে পরিচয়’, এবং ‘আমড়া কাঠের ঢেঁকি হয় না’। এই গূঢ় অর্থসমৃদ্ধ প্রবাদ দু’টির ব্যাখ্যা এমন হতে পারে, তেঁতুলগাছ বপনে কেউ সুমিষ্ট কোনো ফল পাওয়ার আশা করতে পারে না। দ্বিতীয় প্রবাদটির অন্তর্নিহিত অর্থ এমন- ধান ভানার জন্য নরম ভঙ্গুর ‘আমড়া’ কাঠের তৈরি ঢেঁকি নয়, এ জন্য কঠিন মজবুত ‘লোহা কাঠের’ প্রয়োজন হয়।আমাদের দেশে নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন নিয়ে তৎপরতা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। প্রবাদবাক্য দু’টির আলোকে যদি বলি সুষ্ঠু সর্বজনগ্রাহ্য ‘এফেক্টিটিভ’ তথা কার্যকর নির্বাচন কমিশন গঠন করতে ব্যর্থ হই, তবে আগের মতোই সে কমিশনের কাছ থেকে ভালো ফল আশা করা বাতুলতা মাত্র। ‘তেঁতুলগাছ থেকে মিষ্টি ফল পাওয়া যায় না’ বা ভঙ্গুর ‘আমড়া কাঠ’ দিয়ে ঢেঁকির চিন্তাও কেউ করবে না। তাতে ধান ভানা তো দূরের কথা। তেমনি মেরুদণ্ডহীন দুর্বল ‘থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়’ গোছের কমিশন গঠন করা হয় তবে সংবিধানের ১১৮(৪) ধারায় যে কথা বলা হয়েছে ‘নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন এবং কেবল এই সংবিধানের অধীন হইবেন’, সে ক্ষেত্রে সংবিধানের এই ক্ষমতা এক্সারসাইজ বা প্রয়োগ করার মতো শক্তিসামর্থ্য থাকে না, যেমনটা ছিল না ‘হুদা কমিশনের’। তেমনি ঠুঁটো জগন্নাথ গোছের একটি কমিশন হলে সে তো সর্বত্র কুর্নিশ করে পাঁচ বছরের মেয়াদটাই শেষ করবে। গত ৫০ বছরেও দেশ একটি কার্যকর বলিষ্ঠ, আস্থা রাখার মতো কমিশন গঠন করতে সমর্থ হয়নি। সেটি এ পর্যন্ত সব সরকারের ব্যর্থতার পাশাপাশি সংবিধানের প্রতি সেসব সরকারের শ্রদ্ধা ভক্তি ও মান্য করার অপরিসীম অনীহাই সপ্রমাণ করেছে, আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় রাষ্ট্রের অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে বলা হয়েছে- গণতন্ত্র কায়েম, রাষ্ট্রের যে চার মূলনীতি তার একটি গণতন্ত্র। সংবিধানের ৮(২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই ভাগে বর্ণিত নীতিসমূহ বাংলাদেশ পরিচালনার মূল সূত্র হইবে’। সংবিধানে ১১ অনুচ্ছেদে সন্নিবেশিত রয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবতার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’ এখানে এতটুকু বলে রাখতে চাই, ৫০ বছরে কোথায় তেমন নির্বাচন? আর কোথায় সেই জনগণের প্রশাসনে সত্যিকার জনপ্রতিনিধিদের কার্যকর অংশগ্রহণ? সংবিধানে বলা আছে রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। কোথায় এসব মানা হচ্ছে?
সংবিধানকে উপেক্ষা করা, তা প্রকৃতপক্ষে সংবিধান লঙ্ঘনেরই শামিল। সংবিধানে ২১(১ ও ২) অনুচ্ছেদে এই মর্মে বর্ণিত রয়েছে ‘সংবিধান ও আইন মান্য করা, শৃঙ্খলা রক্ষা করা সকল নাগরিকের দায়িত্ব। সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মের নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।’ নির্বাচন অনুষ্ঠানকালে ভোট প্রদান নাগরিকের অবশ্য কর্তব্য। এখন জনগণের পক্ষে ভোট প্রদান করা কি সম্ভব হচ্ছে? সরকারি প্রশাসনের ভূমিকা কতটা জনবান্ধব ও সংবিধানের নির্দেশনার প্রতি তারা কতটা ‘কমিটেড’ বা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ? জনগণ যাতে শান্তিতে নিরাপদে ভোট দিতে পারে সে ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা কি দেখা যায়? এমন সব নির্বাচন কমিশন দেখে বটে, কমিশন এ-সংক্রান্ত বিষয়ে কতটা কী করছে? গণতন্ত্রের প্রাণ হচ্ছে নির্বাচন, সে নির্বাচন যদি প্রহসনে পরিণত হয় তবে তার দায় কমিশনকে পুরোপুরি নিতে হবে। ভোটাধিকার জনগণের সাংবিধানিক অধিকার; সেটি যদি ব্যাহত হয় তবে গণতন্ত্র তো ‘সপ্তম আকাশে উঠে যাবে’। দেশে নির্বাচনের কত ধরন সে সম্পর্কে নিকট অতীতে এই কলামে উল্লেখ করেছিলাম। এবার স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের যতগুলো নির্বাচন হয়েছে তাতে নতুন ‘ভ্যারিয়েন্ট’ বা ধরন লক্ষ করা গেছে। বোদ্ধা সমাজ এতটা শঙ্কিত, তারা তাতে গণতন্ত্র ধ্বংসের ‘বদবু’ তথা দুর্গন্ধ পাচ্ছেন! নির্বাচনের যে নতুন ভ্যারিয়েন্টটি সেটি হচ্ছে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া। এ দেশের মানুষ এক সময় নির্বাচনকে আনন্দ উৎসব হিসাবে জ্ঞান করত। তাহলে আজ মানুষ কেন নির্বাচন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে? প্রশ্ন হচ্ছে যারা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন তারা কি এতই যোগ্য ‘পূতপবিত্র’ আসমানের অধিবাসী যে, তাদের বিরুদ্ধে নির্বাচনে লড়লে নরক অবধারিত? এবার সেসব প্রহসনের ভোটে এত মানুষ কেন হতাহত হয়েছে? তা থেকে এটাই তো প্রমাণিত, সব দাঙ্গাবাজ ভোট ডাকাতরা ভোটে লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়েছে। সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ এমন পরিবেশে নির্বাচনে গিয়ে জীবন হারাতে যাবে কেন, তাদেরও তো জীবন একটাই। সে জীবনে নিজেকে পরিজনদের দুঃখের সাগরে ভাসাবে কেন?
নির্বাচন কমিশনে ব্যর্থতার দায় ক্ষমতাসীনদের কেউ নিতে হবে। দেশে যেকোনো সময়ে শান্তি-শৃঙ্খলা ব্যাহত হলে, মানুষের জানমাল বিপদগ্রস্ত হলে ক্ষমতাসীনদের নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন, তাদের জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হবেই। তবে কোন কারণে প্রশাসন এমন নির্লিপ্ত ছিল? রাষ্ট্রযন্ত্র নাগরিকদের বিপদে পাশে না থাকে যদি, আইনের শাসন ও সুশাসন কায়েম নিয়ে প্রশাসনের দক্ষতা যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তো উঠবেই। তা ছাড়া কেউ যদি এমন অভিযোগ তোলে যে, রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের কারণেই প্রশাসন ‘কুরুক্ষেত্রে’ এক পক্ষের পাশে ছিল। প্রশাসন নিশ্চয়ই জানেন, তাদের নিরপেক্ষতা ভঙ্গ করা ‘হারাম’, নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার শামিল, প্রজাতন্ত্রে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কেবল এবং কেবলই রাষ্ট্রের প্রতি অখণ্ড আনুগত্য দেখাতে হবে। কোনো ব্যক্তি, দলের প্রতি তাদের কোনো অনুরাগ অনুকম্পা দেখানো চলবে না। প্রশাসনের দায়িত্ব পালন নিয়ে এমন নির্লিপ্ততা দেখা গেলেই তাদের দায়িত্ব পালনের বিষয়টি তাহলে ‘কেতাবে’ই শুধু শোভা পাবে। তারা যেন ‘কর্তার ইচ্ছায় কীর্তন’ গাইছেন। আমরা উন্নতির বলি, সে ক্ষেত্রে এ কথা মনে রাখতে হবে, সেই লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য অনেক ‘বদ খাসলত’ ঝেড়ে ফেলতে হবে। কেননা ‘ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ডেমোক্র্যাসি’ পরস্পর হাত ধরাধরি করে এগোয়। নির্বাচন সম্পর্কে যেসব বলে এসেছি তার অনেকটাই নেতিবাচক। তা বস্তুত বিদ্বেষপ্রসূত নয়, নিরেট বাস্তবতা। বঙ্গবন্ধু প্রজাতন্ত্রের জন্য যে সংবিধান জাতিকে উপহার দিয়ে গেছেন সেখানে দেশের মানুষের অভিপ্রায় অভিব্যক্তির অপূর্ব প্রকাশ ঘটেছে। সদ্য স্বাধীন দেশের এত অল্প সময়ে সংবিধান রচনা, প্রবর্তন ও তার আলোকে বিলম্ব না ঘটিয়ে নির্বাচিত সরকার গঠন গণতন্ত্রের প্রতি তার অপরিসীম শ্রদ্ধারই বহিঃপ্রকাশ। সর্বোপরি, এ কথা বলা না হলে মনে খেদ থেকে যাবে। তিনি সংবিধানে ‘সংসদীয় শাসন’ ব্যবস্থাকে দেশে প্রবর্তন করেছেন। রাষ্ট্রপতির শাসনব্যবস্থা এবং সংসদীয় ব্যবস্থার বহু দিক থেকে মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অভিমত হচ্ছে, সংসদীয় শাসনব্যবস্থা অধিকতর গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক, আজ দেশে সংসদীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত রয়েছে বটে; কিন্তু এই শাসনব্যবস্থা যে মৌলিক চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য তার আর অস্তিত্ব নেই। তার প্রধান কারণ নির্বাচনী ব্যবস্থার ভঙ্গুর দশা। নির্বাচন কমিশনের এখন যে অবস্থা তার কিছু বর্ণনা এই নিবন্ধের সূচনায় সামান্য আলোচনা করেছি। সম্মুখে আরো কিছু বলব, কেননা এখন বিশেষ করে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতি সংলাপ করেছেন। নির্বাচনের জন্য আইন প্রণয়ন নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, সংবিধান প্রণয়নের সময়ই সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশন সংক্রান্ত বিধানাবলি রচনার কথা রয়েছে। কিন্তু গত ৫০ বছরে সেই বিধান কোনো সরকারই প্রণয়ন করেনি। এটা আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধু যদি সময় পেতেন তবে অবশ্য নির্বাচন কমিশনার গঠন করা নিয়ে সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠে একটি বিধান রচনা করে যেতেন। তবে আজ আর বিতর্ক বাগি¦তণ্ডার অবকাশ থাকত না।
এখন নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে আরো কথা বলার আগে বলা দরকার অতীত থেকে আজ পর্যন্ত অধিকাংশ কমিশনের অক্ষমতা, অদৃঢ় ভূমিকার কারণে নির্বাচন নিয়ে দেশে ও বিদেশে আমাদের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। দেশের মানুষের নির্বাচন নিয়ে এখন যে হতাশা ক্ষোভ আর আগ্রহহীনতা সৃষ্টি হয়েছে, তা নিয়ে কিছু কথা উপরে বলেছি। এই অবস্থা যদি বজায় থাকে বা বৃদ্ধি পায়, তবে সমূহ সম্ভাবনা আছে-দেশে স্বৈরতান্ত্রিক বা অসাংবিধানিক শাসনব্যবস্থা কায়েম হতে পারে। অথচ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এটাই স্বতঃসিদ্ধ, জনগণের পছন্দসই রাজনৈতিক দল সংসদে পজিশনে এবং অপজিশনে বসে আলোচনা পর্যালোচনা তর্ক-বিতর্ক করে দেশ পরিচালনায় শুদ্ধ পথটি অনুসন্ধান করবে। দেশের মানুষের কাক্সিক্ষত সুখ-সমৃদ্ধি আর অগ্রগতির পথটা এভাবেই রচিত হবে। মানুষের আস্থা নিয়ে কোন সরকার কত দিন রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে, তা নিয়ে বিতর্কের জন্ম হবে না। স্মরণ করা যেতে পারে, সাবেক ব্রিটিশ প্রধনামন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার দীর্ঘ ১১ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। তেমনি সদ্য বিদায়ী জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল ১৬ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। আমাদের নির্বাচন যদি বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকে, তবে এখানেও কোনো নেতা-নেত্রী কত দিন ক্ষমতা থাকবেন তা আদৌ কোনো বিষয় নয়। কিন্তু তেমন নির্বাচন দেখার সৌভাগ্য কি আমাদের হবে? যেসব আন্তর্জাতিক সংস্থা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নির্বাচন মনিটর করে থাকে তাদের পর্যবেক্ষণের আওতায় থাকে ভোট পরিচালনার সাথে যুক্ত নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্মকর্তা, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলের প্রার্থীরা, তাদের কর্মী-সমর্থকরা কী ভূমিকা রাখে। এসব পর্যবেক্ষণের পর তার ভিত্তিতেই প্রতিবেদন তৈরি ও প্রকাশ করে থাকে। তাদের এমন প্রতিবেদনে উঠে আসে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের কী শোচনীয় হাল। বাইরের সেসব প্রতিবেদনের কথা না হয় থাক, আমরা তো আমাদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে চিত্র স্বচক্ষে দেখি, সেটা তো নিছক একটা প্রহসন আর অক্ষম নির্বাচন কমিশনে যত অদক্ষতা, সত্য লুকানোর জন্য যত কৌশল আর পক্ষপাতিত্ব। আসলে নির্বাচন কমিশন গঠনের রসায়নের কারণে বস্তুত যত ভোজবাজি। বর্তমান ‘হুদা’ কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ১৪ ফেব্রæয়ারি। নতুন কমিশন তথা ত্রয়োদশ নির্বাচন কমিশন গঠনের নানা কার্যক্রম এবং আলোচনা, পর্যালোচনা, নানান স্পেকুলেশন এখন চলছে। এখানে একটা কথা উল্লেখ করা যেতে পারে, আগামী ত্রয়োদশ নির্বাচন কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন; ঢাকা-চট্টগ্রামসহ কয়েকটি সিটি করপোরেশনে নির্বাচনসহ অনেকগুলো পৌরসভার নির্বাচনও। এসব নির্বাচন বস্তুত কোন মানে হবে ত্রয়োদশ কমিশনের ভূমিকার ওপর তা নির্ভর করবে। ‘বৃক্ষ তোমার ফলে পরিচয়’, ত্রয়োদশ কমিশনের গঠনপ্রক্রিয়া তথা কোন রসায়নে সেটি তৈরি হবে তা জাতির ভবিতব্য। আসলে নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। গাড়ির ঘোড়া জোড়ার কাজ চলছে। নির্বাচন কমিশন গঠন সংক্রান্ত বিধান তৈরি করার কাজ ইতোমধ্যে অনেক দূর এগিয়েছে। এ লেখা যখন প্রকাশ পাবে, তখন সেটা চূড়ান্ত হয়ে যেতে পারে। এই বিধির একটি খসড়া তৈরি হয়ে গেছে। অবশ্য একটু অবাকই হতে হচ্ছে, কিছুদিন আগে পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন গঠন সংক্রান্ত আইন তৈরি এবং তা সংসদে নেয়া এবং পাস করানো নিয়ে আইনমন্ত্রী সময়ের সঙ্কীর্ণতার প্রশ্ন তুলে ছিলেন। এখন হঠাৎ করে সব কিছু হতে চলেছে কোন মন্ত্রবলে জানি না। সে যাই হোক, ‘শুভস্য শীঘ্রম’ বলে কথা। ভালো কাজ আগে আগেই হওয়া উচিত বলে তা নিয়ে কোনো কথা যেন না ওঠে। যেকোনো আইন তৈরির দাবি নৈর্ব্যক্তিকতা, সব সঙ্কীর্ণতার উপরে উঠে ব্যক্তি, সমাজ রাষ্ট্রের বৃহত্তর কল্যাণেই তা রচিত হয়ে থাকে। এখন বিশেষ দল গোষ্ঠীর স্বার্থের প্রতি লক্ষ্য রেখে কোনো বিধি বিধান হলে, কাল বা তার পর যাদের দিকে তাকিয়ে আইন প্রণীত হলো, এমন তো হতে পারে সেই প্রণয়নকারীরা নাও থাকতে পারেন। তখন যারা আসবেন তাদের গোষ্ঠীগত স্বার্থে প্রয়োগ হলে, তা দেশ ও দশের কোনো উপকারে আসবে না।
পৃথিবী কারো জন্য স্থায়ী আবাস নয় যে, অনন্তকাল এখানে ক্ষমতা কর্তৃত্ব প্রতিপত্তি করার সুযোগ হবে। অথচ জনকল্যাণে কিছু করা হলে তা হবে কালোত্তীর্ণ। ৫০ বছরে একটি অতি প্রয়োজনীয় আইন হতে যাচ্ছে, তা গণতন্ত্রের ভিত্তিমূলকে সুদৃঢ় করাই উচিত যা দ্বারা নির্বাচিত হতে পারে দেশের মানুষের পছন্দের যোগ্য দক্ষ ব্যক্তিরা যারা এই জনপদের সুশাসন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টাই করবে। এমন সর্বাঙ্গীণ সুন্দর খুঁতহীন আইন যারা প্রণয়ন করবেন ইতিহাস তাদের যুগে যুগে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে। গণতন্ত্রটা যদি আমরা ঠিক মতো মেরামত করতে পারি তবে দেশের অনেক সমস্যা কেটে যাবে। রাজনীতি নিয়ে রাজপথের লম্ফঝম্ফ অদৃশ্য হয়ে যাবে, সংসদ তখন রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে; সেই সাথে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনার সিদ্ধান্ত সেখানেই হতে পারবে। নির্ভেজাল স্বচ্ছ নির্বাচন হলে জনগণ যাদের সমর্থন দেবে আর যাদের রিজেক্ট করবে, সেই ক্ষেত্রে কারোই কিছু বলা কওয়ার কিছু থাকবে না। গণতন্ত্রের সব নির্যাস হচ্ছে নির্বাচন, সে সন্দেহ প্রশ্নের সুরাহা দেবে একটা নির্ভেজাল ভোটব্যবস্থা, তার সৌধ নির্মাণ করবে নির্বাচন কমিশন। কথায় আছে, যার শেষ ভালো তার সব ভালো। ত্রয়োদশ কমিশন কতটা ভালো হবে দেখার জন্য অনেক সময়ই অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু এখনো তো দেখা যাচ্ছে, সরকার নির্বাচন সংক্রান্ত খসড়া বিধান তৈরি করে ইতোমধ্যে সংসদে উপস্থাপন করেছেন। প্রথমেই দেখা যাচ্ছে নির্বাচন সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞগণ, বোদ্ধাসমাজ, বিগত নির্বাচন কমিশনের সাথে সংশ্লিষ্ট সদস্যগণ সেই খসড়া বিধানের ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরে সমালোচনা করছেন এবং তারা মনে করছেন সেই খসড়ার আলোকে যদি আইন হয়ে যায় আর সেই আইন মোতাবেক যদি নির্বাচন কমিশন গঠিত হয় তবে কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে সরকারে প্রভাব অতীতের মতো পুরো থেকে যাবে। ফলে ভবিষ্যতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে কোনো গুণগত পার্থক্য পরিলক্ষিত হবে না। তা ছাড়া আগামী নির্বাচন কমিশনের সম্মুখে যে বড় কাজটি করতে হবে, তা আর সম্ভব হবে না। সেই কাজটি হলো নির্বাচনের ব্যাপারে জনগণের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনা। মনে রাখতে হবে, আস্থা কেবল একটি ভোটের নয়, নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নাগরিকগণ প্রজাতন্ত্রে তার অংশীদারিত্ব জানান দেয় এবং প্রজাতন্ত্রের প্রতি মালিকানা বোধ সৃষ্টি হয়। বোধের এই বন্ধন আগামীতে জাতিকে পথ দেখাবে।
খসড়া আইন সংসদে ওঠার পর এখন সমালোচনা শুরু হয়েছে। ক্ষমতাসীনরা গোপনীয়তার মধ্যেই নির্বাচন কমিশন আইনের খসড়া তৈরি করেছেন বলে অভিযোগ। রাজনৈতিক অঙ্গনে সরকারের এমন সমালোচনা হচ্ছে যে, এতদিন সরকার আইন তৈরির ব্যাপারে বলেছেন, আইন রচনার মতো পর্যাপ্ত সময় নেই। কিন্তু এখন হঠাৎ আইনটি তৈরি করে সংসদে পর্যন্ত পেশ করে ফেলেছেন। নির্বাচন কমিশন গঠন করার ক্ষেত্রে এই দ্রুততার পেছনে সরকারের প্রতিপক্ষ এবং বিজ্ঞজনরা মনে করছেন, নিজেদের ‘সুবিধামতো’ কমিশন গঠন করতে দ্রুততার সাথে আইনটি পাস করিয়ে নিতে চাচ্ছে। সে যাই হোক, এই আইনে প্রধান নির্বাচন কমিশন ও অন্যান্য নিয়োগের প্রক্রিয়া এবং তাদের যোগ্যতা অযোগ্যতার বিষয়টি নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, সিইসি ও অন্যান্য কমিশনারের জন্য রাষ্ট্রপতি ছয় সদস্যের একটি সার্চ কমিটি গঠন করবেন। ইসিতে নিয়োগের জন্য এই কমিটি আইনে বর্ণিত যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি খুঁজে বের করবেন। এ ক্ষেত্রে তারা রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী সংগঠনগুলোর কাছেও নামও আহ্বান করতে পারবে। অনুসন্ধান কমিটি প্রতি শূন্য পদের বিপরীতে দু’জন করে ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করবে এর মধ্য থেকে রাষ্ট্রপতি সিইসি ও নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দেবেন। সার্চ কমিটি কেমন হবে, তা খসড়া বিলে উল্লেখ রয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও কমিশনার হিসেবে নিয়োগের জন্য যে কমিটি রাষ্ট্রপতি গঠন করবেন তার সভাপতি হবেন প্রধান বিচারপতির মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি, সদস্য হিসেবে থাকবেন প্রধান বিচারপতির মনোনীত হাইকোর্টের একজন বিচারপতি, মহাহিসাব রক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান এবং রাষ্ট্রপতির মনোনীত দু’জন বিশিষ্ট নাগরিক। আইনের খসড়ায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য তিনটি যোগ্যতার কথা বলা হয়েছে। যেগুলো হলো বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে, ন্যূনতম বয়স ৫০ বছর হতে হবে এবং গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, আধা সরকারি, বেসরকারি বা বিচার বিভাগীয় পদে কমপক্ষে ২০ বছর কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। ওই দিকে নয়া আইন নিয়ে কথা বলা হচ্ছে। সাবেক সিইসি ড. এ টি এম শামসুল হুদা বলেছেন, খসড়া আইনে অনেক অপূর্ণতা রয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় এটি শুধু সার্চ কমিটি গঠনের জন্য। তাড়াহুড়া করে আইন প্রণয়ন কারো জন্যই কল্যাণকর হবে না। তিনি আরো বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য কমিশনার নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতা অযোগ্যতার সুস্পষ্ট রূপরেখা থাকতে হবে। জনাব হুদা বলেন, সত্যিকারার্থে বর্তমান সংসদে জনপ্রতিনিধিত্ব নেই, তাই প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে এই প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করতে হবে। তার মতে, গণতন্ত্র ও সুশাসনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন খুবই জরুরি। প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা সক্ষমতা বৃদ্ধিতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে সুশাসন ব্যাহত হবে। ঢাকার একটি দৈনিকে তিনি তার মতামত দিয়েছেন। সেই দৈনিকেই ইসি গঠনে প্রস্তাবিত আইনের খসড়া সম্পর্কে বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, আইনের খসড়া পড়ে যতটুকু বুঝেছি- সার্চ কমিটিতে চারজন সাংবিধানিক পদধারী ব্যক্তি থাকবেন। যারা এসব পদে রয়েছেন তারা এই সরকারেই বর্তমান বা বিগত মেয়াদে নিয়োগপ্রাপ্ত। ফলে স্বাভাবিক কারণেই তারা সরকারের প্রতি অনুগত কিংবা সহানুভূতিশীল, যে কারণে সরকারের প্রতি অনুগত বা সহানুভূতিশীল নন, এমন কেউ তো নিশ্চয়ই এসব পদে নিয়োগ পাননি। সুতরাং এই সার্চ কমিটির কাছ থেকে কী ধরনের সুপারিশ আসতে পারে- সেটি আগে থেকেই আন্দাজ করা যায়। তিনি আরো বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনার হিসেবে সার্চ কমিটি যাদের নাম সুপারিশ করবে রাষ্ট্রপতির নিয়োগের আগে তাদের তালিকা জনসম্মুখে প্রকাশের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি আইনের খসড়ায় যার কারণে, সার্চ কমিটি কাদের নাম এবং কিসের ভিত্তিতে সুপারিশ করল, তাদের রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা কতটুক- সেটি জনগণের জানার কোনো সুযোগ নেই। শাহদীন মালিক আরো বলেন, পুরো প্রক্রিয়াটি অস্বচ্ছ। আগে যেভাবে ইসি গঠিত হয়েছিল, এখনো মূলত সেভাবেই হবে।’
এ দিকে ‘সুজন’-এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার একটি জাতীয় দৈনিকে একটি নিবন্ধ লিখেছেন রাষ্ট্রপতির সংলাপ নিয়ে। তিনি সেখানে বলেছেন, রাষ্ট্রপতির এই মতবিনিময় আমাদের সংবিধানের সাথে কতটুকু সঙ্গতিপূর্ণ, সে বিষয়েও সন্দেহ আছে। সংবিধানে ‘আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে’ নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেয়ার সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া আছে। বস্তুত রাষ্ট্রপতির মতবিনিময়ের মূল এজেন্ডা হতে পারত নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ সংক্রান্ত আইন। আমাদের সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘এই সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাঁহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন।’ তাই নির্বাচন কমিশনের নিয়োগ দানের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী যে পরামর্শ দেবেন, তার বাইরে একচুল পরিমাণ ব্যত্যয় ঘটানোর ক্ষমতাও রাষ্ট্রপতির নেই। অর্থাৎ অতীতের মতো পরবর্তী নির্বাচন কমিশনও গঠিত হবে প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায় অনুযায়ীই। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে রাষ্ট্রপতি এ মতবিনিময়ের আয়োজন নিষ্ফল হতে বাধ্য। ড. মজুমদার অপর এক দৈনিকে লিখেছেন, বহুল প্রতীক্ষিত ইসি নিয়োগের আইন প্রণয়নের উদ্যোগ অবশ্যই আশাব্যঞ্জক; কিন্তু সব অংশীজনের মতামত গ্রহণ ছাড়া এরকম জনগুরুত্বপূর্ণ একটি আইন পাসের যে উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা কোনোভাবে কাম্য নয়। তাই হঠাৎ করে এভাবে আইনের অনুমোদনকে মূল উদ্দেশ্য থেকে সরে গিয়ে ৫০ বছরে প্রথম আইনের ঘাটতি পূরণ করার বিষয়টি রাজনৈতিক প্রচারের স্বার্থে ব্যবহার করা হতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। নির্বাচনের মতো একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল প্রক্রিয়া তদারকির দায়িত্ব সংবিধান এই প্রতিষ্ঠানের ওপর ন্যস্ত করেছে। তাই কমিশন সৎ যোগ্য ও সাহসী ব্যক্তিদের নিয়োগ দেয়ার আইনি কাঠামো তৈরিই নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইনের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত, যাতে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা যেকোনো পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে অটল থাকেন।
এই উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের নির্বাচন কমিশন গঠন করা নিয়ে কিঞ্চিৎ বলা হলে খুব অপ্রাসঙ্গিক হবে বলে মনে করি না। ভারতের নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছিল ১৯৫০ সালে। ভারতের সংবিধানের ৩২৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচনপ্রক্রিয়া পরিচালনা করার জন্য ভারতের নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন সংবিধান-স্বীকৃত কর্তৃপক্ষ। ভারতের রাষ্ট্রপতি মুখ্য নির্বাচন কমিশনারকে নিযুক্ত করেন। তার সাথে দু’জন অতিরিক্ত নির্বাচন কমিশনার নিযুক্ত করা হয়। ১৯৫১ সালে ভারতে প্রথম নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পান সুকুমার সেন। ভারতের কমিশনের দায়িত্ব পালন নিয়ে তেমন কোনো বিরূপ আলোচনা হয়নি। ভারতের প্রতিটি কমিশন সে দেশের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার জন্য, এ পর্যন্ত প্রতিটি নির্বাচনকে প্রশ্নমুক্ত রাখার জন্য যারপরনাই চেষ্টা করে যাচ্ছে। সে কারণেই ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পাকিস্তানি নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছিল ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ এবং সে দেশের ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও সংস্কার করা হয়েছে। পাকিস্তানের সংবিধানের ২১৩ এবং ২১৬ অনুচ্ছেদের অধীনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং দেশের সংশ্লিষ্ট চারটি প্রদেশের উচ্চ আদালতের চারজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, যাকে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সংবিধানের ২১৩-এর অনুচ্ছেদের (২এ) এবং (২বি) প্রদত্ত ক্ষমতাবলে কমিশন গঠিত হয়। পাকিস্তানে নির্বাচন কমিশনের একটি পাঁচ সদস্যের প্যানেল রয়েছে, যার মাধ্যমে প্রধান নির্বাচন কমিশনের নেতৃত্বে চারটি প্রদেশের প্রতিটি হতে একজন করে চারজন সদস্য রয়েছে। ২০১৭ সালের ২ অক্টোবর, জাতীয় সংসদে পাস হওয়া নির্বাচন আইন-২০১৭ এখন কার্যকর রয়েছে এবং ২০১৮ সালে সাধারণ নির্বাচন সেই আইনের অধীনে সফলভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। নেপালে সরকারি দল, সংসদে বিরোধী দল, অন্যান্য দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে সেখানে কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিল রয়েছে। সেই কাউন্সিল বসে একটা খসড়া তালিকা প্রকাশ করে। প্রকাশিত তালিকার ব্যাপারে কারো কোনো অভিযোগ থাকলে তা জানাতে পারে। সেখানকার আইনে গণশুনানির বিধান রয়েছে। এর পর তালিকা যায় সংসদে। সংসদ তালিকা চূড়ান্ত করলে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেন। আমাদের শেষ কথা, এই আইনটি এমন একটি আইন হওয়া উচিত সেটি গ্রহণযোগ্য হতে হবে সবার কাছে। শুধু একদলের গ্রহণযোগ্য হলে তো সেটি সার্বজনীন হতে পারে না। দেশের মানুষের নির্বাচন নিয়ে এখন যে দুঃস্বপ্ন, সেটি যাতে কেটে গিয়ে আবার মানুষ আগের মতো নির্বাচনকে উৎসব আনন্দের মাঝে নির্ভয়ে ভোট দিতে পারে। সংবিধানে বলা আছে ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র’, তা যাতে সার্থক হয় সেটি যেন সেই আইনের মূল উদ্দেশ্য হয়। আমরা সেই প্রভাতের অপেক্ষা করছি, যে প্রভাতে গণতন্ত্রের আকাশে নতুন সূর্যোদয়ের আলোয় উদ্ভাসিত হবে ৫৫ হাজার বর্গমাইলের এই জনপদ। সেই বলটা কিন্তু এখন সরকারি দলের কোটে, যদি এই যাত্রায় দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া না হয় তবে নির্বাচন কমিশনটা হবে তথৈবচ যার ফল কারো জন্য কল্যাণকর হবে না। সরকার কী চাইবে, সূর্যোদয় না অমানিশা? ইসি আইন পাস হয়ে গেল লেখা ছাপার দু’দিন আগে। তাই আইন সম্পর্কে বলা গেল না।