ওমিক্রন দিয়েই শেষ হবে করোনা মহামারি?

0

বিশেষ সংবাদদাতা॥ করোনা মহামারি কবে শেষ হবে বা আমরা আবার কবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবো? গত দুবছরে এই প্রশ্ন করেননি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে এক্ষেত্রে আশার বাণী শুনিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে খুব শিগগির। বিজ্ঞানীদের অনেকেই মনে করেন করোনাভাইরাসের ভ্যারিয়েন্টের ওপর প্রচণ্ড চাপ তৈরি হয়েছে এবং এর ফলে এটি দিনে দিনে দুর্বল হয়ে পড়ছে। এছাড়াও সারাবিশ্বে লোকজনকে টিকা দেওয়ার কারণে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে মানবদেহের রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা। এসব থেকে ধরে নেওয়া যায় যে মহামারির সময় হয়তো ফুরিয়ে আসতে শুরু করেছে। তারা বলছেন, ইতোমধ্যেই করোনা মহামারি শেষ হতে শুরু করেছে। এটা যে এখন শেষ পর্যায়ে তার লক্ষণ স্পষ্ট। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, মহামারির পরে কী হবে? জীবন কি আগের অবস্থায় ফিরে যাবে নাকি তৈরি হবে নতুন কোনো পরিস্থিতি? প্রাণঘাতী এই ভাইরাস কী পৃথিবী থেকে একেবারেই উধাও হয়ে যাবে? বিজ্ঞানীরা বলছেন, কোনো সন্দেহ নেই যে করোনা ভাইরাস থাকবে, কিন্তু সেটা আর মহামারি হিসেবে না থেকে স্থানীয় পর্যায়ের কোনো রোগে পরিণত হবে। অর্থাৎ আমাদের সামনে কোভিড-পরবর্তী নতুন এক বিশ্ব আসন্ন যেখানে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মহামারির মতো এতো মানুষের মৃত্যু না হলেও, এই অসুখ আর দশটি সাধারণ রোগের মতোই থেকে যাবে।
মহামারি শেষ হওয়ার পথে?
যুক্তরাজ্যে লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জুলিয়ান হিসকক্স বিবিসির স্বাস্থ্য ও বিজ্ঞান বিষয়ক সংবাদদাতা জেমস গ্যালাহারকে বলেন, আমরা এমন পরিস্থিতিতে প্রায় পৌঁছে গেছি বলা যায়। বলতে পারেন মহামারি শেষ হতে শুরু করেছে। অন্ততপক্ষে যুক্তরাজ্যে। আমার মনে হয় ২০২২ সালে আমাদের জীবন মহামারির আগের অবস্থায় ফিরে যাবে। করোনাভাইরাসের দুর্বল ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রনই তার অন্যতম লক্ষণ। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, এই ভ্যারিয়েন্ট যত বেশি ছড়াবে ভাইরাসটি ততোই দুর্বল হয়ে পড়বে এবং এর মধ্য দিয়েই অবসান ঘটবে এই শতাব্দীর সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্য সংকটের।
মহামারি শেষ হওয়ার কারণ
এর পেছনে মূলত দুটি কারণ। একদিকে ভাইরাসের দুর্বল হয়ে পড়া এবং অন্যদিকে ভাইরাসের হোস্ট অর্থাৎ মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, গত দুবছরে পৃথিবীর ৩২ কোটিরও বেশি মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে এবং এর হাত থেকে রক্ষা পেতে বহু মানুষ টিকা নিয়েছেন। ফলে তাদের দেহে ভাইরাসটি প্রতিরোধ করার জন্য এন্টিবডি তৈরি হয়েছে। এই ভাইরাস প্রতিরোধের জ্ঞানও তৈরি হয়েছে মানুষের দেহে। চীনের উহান শহরে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে যখন নতুন এই ভাইরাসের উৎপত্তি হয় তখন দেহের রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থার কাছে এটি ছিল একেবারেই অচেনা অজানা, ছিল সম্পূর্ণ নতুন একটি ভাইরাস এবং এর সাথে কিভাবে লড়াই করতে হবে সেই জ্ঞানও কারও ছিল না। একইসঙ্গে এর কোনো ওষুধ ছিল না, ছিল না কোনো টিকাও। কিন্তু এর মধ্যে মানুষের দেহে কোভিড মোকাবিলার ক্ষমতা তৈরি হয়েছে। আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থা এখন ভাইরাসটি সম্পর্কে আগের চেয়ে অনেক বেশি জানে। একে পরাস্ত করার অভিজ্ঞতাও তাদের হয়েছে। প্রতি মুহূর্তের এই লড়াইয়ের ফলে ভাইরাসটি রূপান্তরিত হতে হতে এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি দুর্বল হয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের কথাই উল্লেখ করা যেতে পারে। এটি আগের যেকোনো ভ্যারিয়েন্টের তুলনায় অনেক বেশি সংক্রামক হলেও, রোগীকে আগের মতো কাবু করতে পারছে না। এই ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি কিংবা মৃত্যুর হারও অনেক কম। কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারে যে, সারা বিশ্বেই কি প্রতিরোধের এই চিত্রটা একই রকমের? পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় দরিদ্র দেশগুলোতে খুব কম সংখ্যক মানুষই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। এসব দেশে টিকা দেওয়ার হারও অনেক কম। ফলে দরিদ্র দেশগুলোতেও মহামারি এখন শেষ পর্যায়ে বলা যায়? মনে রাখতে হবে এসব দেশে মৃত্যুর সংখ্যা কম হলেও মানুষের দেহে ভাইরাসের প্রতিরোধের ক্ষমতা কিন্তু এখনও সেভাবে তৈরি হয়নি। টিকা সরবরাহের ক্ষেত্রে এখনও বৈষম্য রয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে যে পরিমাণ টিকা দেওয়া হয়েছে এশিয়ায় সেই সংখ্যা কম, আফ্রিকায় আরো কম।একসঙ্গে সবাইকে টিকা দেওয়া গেলে হয়তো ভাইরাস প্রতিরোধ করা যাবে।
মহামারির পরে কী?
বিজ্ঞানীরা বলছেন, পৃথিবীর সামনে দুটো সম্ভাবনা। হয় কোভিড পুরোপুরি নির্মূল হয়ে যাবে যেমনটা পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোতে ইবোলো ভাইরাসের বেলায় হয়েছে। অথবা এটি ক্রমশ দুর্বল হয়ে আমাদের মধ্যে দীর্ঘসময় ধরে সাধারণ সর্দি কাশি, এইচআইভি, হাম, ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মার মতো থেকে যাবে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন কোভিডের বেলায়ও ঠিক তেমনটাই ঘটতে যাচ্ছে। ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের ভাইরোলজিস্ট ড. এলিজাবেটা গ্রোপেলি বিবিসিকে বলেন, আমি খুব আশাবাদী যে, আমরা খুব শীঘ্রই এমন এক পরিস্থিতিতে পৌঁছাবো যেখানে ভাইরাসটি ছড়াতে থাকবে এবং ঝুঁকিপূর্ণ লোকজনকে রক্ষায় আমাদের কিছু ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু সাধারণ লোকজনের খুব একটা অসুবিধা হবে না। মহামারি বিশেষজ্ঞরা একটি রোগকে তখনই স্থানীয় রোগ হিসেবে বিবেচনা করেন যখন সেই রোগের মাত্রা স্থিতিশীল থাকে এবং বোঝা যায় এরপর কী পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। কিন্তু যখন কোনো একটি রোগ হঠাৎ আবির্ভূত হয়ে অতি দ্রুত বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে তাকে বিবেচনা করা হয় মহামারি হিসেবে। ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের মহামারি বিশেষজ্ঞ প্রফেসর আজরা গানি বলেন, আমরা খুব দ্রুত মহামারি শেষের পর্যায়ে চলে যাব। মনে হচ্ছে অনেক সময় লাগছে কিন্তু মনে রাখতে হবে যে মাত্র এক বছর আগে লোকজনকে টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে। আর টিকার কারণে আমরা আগের তুলনায় অনেক বেশি স্বাধীন জীবন যাপন করতে পারছি। তবে এই পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে যদি এমন কোনো নতুন ভ্যারিয়েন্টের আবির্ভাব ঘটে যা মানুষকে গুরুতর অসুস্থ করে দিতে পারে। অনেক রোগই স্থানীয় পর্যায়ে গুরুতর হয়ে থেকেই যায়। স্মলপক্স কয়েক হাজার বছর ধরে স্থানীয় রোগ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এতে বহু মানুষের মৃত্যুও হয়েছে। এক হিসেবে দেখা গেছে, যত মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয় তার এক তৃতীয়াংশেরই পরিণতি মৃত্যু। ম্যালেরিয়াও স্থানীয় রোগ যাতে আক্রান্ত হয়ে সারা বিশ্বে বছরে প্রায় ছয় লাখ মানুষ মারা যায়।
নতুন জীবন
অধ্যাপক জুলিয়ান হিসকক্স মনে করেন পরিস্থিতি আবারও খুব বেশি খারাপ হওয়ার আশঙ্কা নেই। তিনি বলেন, নতুন ভ্যারিয়েন্ট বা পুরোনো ভ্যারিয়েন্ট যা কিছুই আসুক না কেন, বেশিরভাগ মানুষই যখন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবে তাদের সামান্য একটু সর্দি-কাশি হবে, সামান্য মাথাব্যথা করবে এবং তারপরেই আমরা ঠিক হয়ে যাব। তবে কিছু লোক থাকবে, বিশেষ করে বৃদ্ধ এবং যাদের বড় রকমের শারীরিক অসুস্থতা রয়েছে, তারা নাজুক অবস্থায় থাকবে এবং স্থানীয় পর্যায়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে তাদের কারো কারো মৃত্যুও হবে। সে কারণে এই ভাইরাস নিয়ে আমরা কীভাবে বসবাস করব সে বিষয়ে নতুন কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তিনি বলেন, শীতকালে ফ্লুর কারণে সারা বিশ্বে বহু মানুষের মৃত্যু হয় এবং সে সময় কেউ মাস্ক পরে না অথবা সামাজিক দূরত্বও বজায় রাখে না। তিনি মনে করেন, আগামীতে লকডাউন জারির সম্ভাবনা কম এবং সমাবেশের ওপরেও বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে না। কোভিড টেস্টও হয়তো এ বছরই উঠে যেতে পারে।