পঞ্চম ধাপের নির্বাচনেও যশোরে ভোটকেন্দ্রে হাঙ্গামা, সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে

0

স্টাফ রিপোর্টার॥ পঞ্চম ধাপের নির্বাচনেও যশোরে ভোটকেন্দ্রে হাঙ্গামা, সহিংসতাসহ নানা অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। বুধবার যশোর সদর উপজেলার ১৫ টি ও কেশবপুর উপজেলার ১১ ইউনিয়নে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় ভোট চলাকালে যশোর সদর উপজেলার কাশিমপুর ও রামনগর ইউনিয়নে পৃথক দুটি কেন্দ্রে সহিংস ঘটনা ও বোমাবাজির ঘটনা ঘটে। এসময় একজন পুলিশসহ আরও অন্তত ৫ জন জখম হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। সহিংস ঘটনার কারণে কেশবপুর সদর ইউনিয়নে একটি ভোটকেন্দ্র ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়। সহিংসতা ঘটনা ছাড়াও অধিকাংশ ভোটকেন্দ্রে পুলিশ ও সরকার দলের লোকজনদের নৌকার পক্ষে প্রভাব বিস্তার করতে দেখা যায়। এতে অনেক ভোটারই ভোট দিতে পারেননি। বেশকিছু এলাকায় বিশৃঙ্খলার পাশাপাশি জাল ভোট, কেন্দ্র দখলের চেষ্টার অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা বলেছেন, দু’একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া সর্বত্র শান্তিপ্রিয় অংশগ্রহণমূলক ভোট হয়েছে।

ভোট গ্রহণের শুরুতেই যশোর সদর উপজেলার কাশিমপুর ইউনিয়নের ডাকাতিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে সহিংস ঘটনার সূত্রপাত হয়। কেন্দ্রটিতে ভোট চলাকালে সকাল ৯ টার দিকে নৌকার প্রার্থী শরিফুল ইসলামের পক্ষে ১৫/২০ টি মোটর সাইকেলে আসা একদল বহিরাগত সন্ত্রাসী জোর করে কেন্দ্রে প্রবেশ করে প্রকাশ্যে ভোট কাটতে থাকে। এসময় কেন্দ্রে অবস্থিত স্বতন্ত্রপ্রার্থী আইয়ুব হোসেনের লোকজনকে কেন্দ্র থেকে মারপিট করে বের করে দেয় বহিরাগত সন্ত্রাসীরা। এসময় সেখানে উত্তেজনা ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এক পর্যায়ে সেখানে এসআই সেকেন্দার আবু জাফরের নেতৃত্বে একদল পুলিশ সেখানে গিয়ে নৌকার পক্ষে লোকজনের সাথে মিলে স্বতন্ত্রপ্রার্থী আইয়ূব হোসেনের পোলিং এজেন্ট ও ভোটারদেরকে বেদম মারপিট করেন। এসময় পুলিশের হামলায় স্বতন্ত্রপ্রার্থী আইয়ূব হোসেনের ছেলে তুহিন ও তার সমর্থক রাসেল, আশরাফুল ও কালাম গুরুতর আহত হন। পরে আহতাবস্থায় তাদেরকে পুলিশ গাড়ীতে তুলে নিয়ে যায়। আহত পুলিশ সদস্যকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।


কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার অনুপম কুমার দেবনাথ বলেন, সকাল সাড়ে ৯টার দিকে কেন্দ্রের ভেতরে বহিরাগতরা ভোট কাটতে শুরু করে। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। ওই সময় মৃদু লাঠিচার্জে পুলিশ সবাইকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ সময় চার জন আহত হন। পুলিশ চার জনকে আটক করে। এরা হলেন এরা স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থীর আইয়ুব হোসেনের সমর্থক বলে জানা গেছে। এ সময় ইটের আঘাতে ফারুক নামে এক পুলিশ সদস্য আহত হন। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে জানান কোতোয়ালি থানার ওসি মো. তাজুল ইসলাম। ঘটনার পর সকাল ১০টার দিকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মীর আলিফ রেজা ও বিজিবি সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।


প্রিজাইডিং অফিসার আরও জানান, কেন্দ্রে মোট ভোটারের সংখ্যা এক হাজার ৭৬১জন। প্রথম ঘণ্টায় কেন্দ্রে ১৫৭টি ভোটগ্রহণ করা হয়। এ ঘটনার পর স্বতন্ত্রপ্রার্থী আইয়ূব হোসেন বলেন, তার ইউনিয়নে নূরপুর স্কুল, কাশিমপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র, সরুইডাঙ্গা স্কুল কেন্দ্রসহ বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে পুলিশের সহায়তায় নৌকার কর্মীরা প্রকাশ্যে ভোটারদের ব্যালটে সিল মারতে বাধ্য করেন। সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে যশোর সদরের ১১নং রামনগর ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের নামেজ সরদার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভোট কেন্দ্রের বাইরে ২০০ গজ দুরে রাস্তার ওপরে অজ্ঞাত সন্ত্রাসীরা ২টি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পালিয়ে যায়। তবে কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।

এসময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ঘটনার সাথে জড়িত থাকা সন্দেহে দুজনকে আটক করেছে। পরে ওই কেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য সংখ্যা বাড়ানো হয়। এ বিদ্যালয়ে তিনটি কেন্দ্র রয়েছে। পূর্ব ভবন কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার মো. রাকিবুল ইসলাম জানান, বাইরে থেকে কেন্দ্রের পশ্চিম দিকে দু’টি বোমা ছুড়ে মারা হয়। বোমার বিকট শব্দে কিছু সময়ের জন্য আতংকিত ছিলেন ভোটাররা। তবে ভোট গ্রহণ বন্ধ হয়নি। অল্প সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে। কেন্দ্রে কর্তব্যরত পুলিশের উপ পরিদর্শক আব্দুর রাজ্জাক জানান, বোমা বিষ্ফোরণের সাথে সাথে কেন্দ্রের আশেপাশে থাকা সকলকে সরিয়ে দেয়া হয়। এসময় নায়েমুজ্জামান নামে এক যুবককে আটক করা হয়েছে।


ভোট চলাকালে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সদরের বসুন্দিয়া ইউনিয়নের পদ্মবিলা নামক স্থানে ভোট সংক্রান্ত ব্যাপারে আওয়ামী লীগ চেয়ারম্যান প্রার্থী রিয়াজুল ইসলাম ও জাতীয় পার্টির প্রার্থী তুহিন খানের কর্মী সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এসময় পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তবে কোন হতাহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা পরিস্থিতি শান্ত করেন । যশোর সদর ৯ নং আরবপুর ইউনিয়নের বালিয়া ভেকুটিয়া কেন্দ্রের অদুরে সরকার দলের প্রার্থীর পক্ষে ১৫/২০ জনের যুবক বালিয়া ভেকুটিয়া বাজারের রাস্তায় দাড়িয়ে হাতে লাঠিসোটা নিয়ে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আসতে বাধা দেয় বলে অভিযোগ করেন অনেক ভোটার।


দুপুরের দিকে ফতেপুর ইউনিয়নে গিয়ে দেখা যায় অধিকাংশ কেন্দ্র ভোটারশুন্য। এরমধ্যে বালিয়াডাঙ্গা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দুপুর দুইটার দিকে গিয়ে দেখা যায় একজন ভোটার নেই। অথচ বাইরে বিপুল সংখ্যক ভোটার দাঁড়িয়ে আছেন। ভোটাররা জানান, এই কেন্দ্রে সব ভোটাররা ঢুকতে পারছেন না। নৌকার ভোটাররা ছাড়া সেখানে প্রবেশ করতে বাধা দেয়া হচ্ছে। কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার নাসির উদ্দীন বলেন, দুপুর পর্যন্ত ১৪৫১ ভোটের মধ্যে ৮০০ ভোট কাস্ট হয়েছে। দুপুরে লাঞ্চের সময় হওয়ায় ভোটারদের উপস্থিতি কম বলে তিনি দাবি করেন।

একই পরিস্থিতি ছিলো ঝুমঝুমপুর প্রাইমারী স্কুল কেন্দ্রে। বিকেলের তিনটের কিছু পর সেখানে গিয়ে দেখা যায় ভোটকেন্দ্রে ভোট নেই, অথচ বাইরে কয়েকশো লোক জটলা করে দাঁড়িয়ে আছেন। কেন্দ্রের বাইরে অবস্থান করা কয়েকজন বলেন, এই কেন্দ্রে সকাল থেকে নৌকার হয়ে কিছু লোক প্রভাব বিস্তার করছে। তারা তাদের পছন্দের ভোটারদের কেন্দ্রে প্রবেশ করতে দিলেও স্বতন্ত্রপ্রার্থীদের ভোট কেন্দ্রে যেতে বাধা দিচ্ছে। যেকারণে অনেক ভোটাররই ভোটকেন্দ্রে যেতে পারেননি বলে তারা জানান। এর কিছু পরই সেখানে একদল পুলিশ গিয়ে কেন্দ্রের বাইরের লোকজনদের তাড়িয়ে দেয়। ওই ইউনিয়নের স্বতন্ত্রপ্রার্থী ফাতেমা আনোয়ার বলেন, ইউনিয়নের অধিকাংশ কেন্দ্রেই নৌকার লোকজন তার ভোটারদের ভোট দিতে বাধা দেয়। বিষয়টি তিনি প্রশাসনকে অবহিত করেছেন বলে তিনি জানান।


এদিকে ভোট চলাকালে ভোটার এলাকায় কোনো মোটরসাইকেল চলাচলের অনুমতি না থাকলেও অধিকাংশ ভোটকেন্দ্রের আশপাশে মোটরসাইকেল আরোহীদের আনাগোনা ব্যাপক হারে ছিলো। পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনে সরকার দলের তরূণ কর্মীরা মোটরসাইকেলে মহড়া দিয়ে বেড়ালেও তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে দেখা যায়নি। বিশেষ করে যশোরের দেয়াড়া ও আরবপুর ইউনিয়নে এ ধরণের পরিস্থিতি ছিলো চোখে পড়ার মতো। তবে জেলা সিনিয়র নির্বাচন অফিসার মো. হুমায়ুন কবীর বলেন, যশোরের ১৬ টি ইউনিয়নে দু;একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া সর্বাত্মক শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। তিনি বলেন, যেখানে নির্বাচনে বলপ্রয়োগের চেষ্টা করা হয়েছে সেখানেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর হস্তে দমন করা হয়েছে।