বাগেরহাটে পরিবেশ কর্মকর্তার খাম খেয়ালিপনায় ঝুলে আছে পরিবেশ পদকপ্রাপ্ত নারী উদ্যোক্তার ছাড়পত্র

0

বাগেরহাট সংবাদদাতা॥ পরিবেশ কর্মকর্তার খামখেয়ালিপনায় প্রায় দুই বছর ধরে ঝুলে আছে পরিবেশ পদকপ্রাপ্ত নারী উদ্যোক্তা সালমা বেগমের ফ্যাক্টরীর পরিবেশগত ছাড়পত্র। ছাড়পত্র না পাওয়ায় সঠিকভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছেন না তিনি। জেলা পরিবেশ কর্মকর্তার চাহিদা অনুযায়ী অনৈতিক সুবিধা প্রদান না করায় ছাড়পত্র দিচ্ছেন না বলে জানান ভুক্তভোগী নারী। ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে আবেদন করে কোন প্রতিকার পায়নি তারা। ব্যবসায়িক ক্ষতির স্বীকার থেকে বাঁচতে সরকারের উর্দ্ধোতন কর্তৃপক্ষের কাছে অতিদ্রুত ছাড়পত্র দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন নারী উদ্যোক্তা সালমা বেগম। তবে অনৈতিক সুবিধা দাবির বিষয়টি অস্বীকার করেছেন পরিবেশ অধিদপ্তর, বাগেরহাটের উপ-পরিচালক আরেফিন বাদল।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৩ সালে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিয়ে সরকারি সকল নিয়ম মেনে দশানী মৌজায় ২ হাজার বর্গফুট জমির উপর অব্যবহৃত পুরাতন প্লাস্টিক দিয়ে সুতো (প্লাস্টিকের সুতো বা পাতা সুতো বা কাকড়া পাতা) তৈরির কারখানা স্থাপন করেন সালমা বেগম নামের এক নারী। মেসার্স সালমা প্লাস্টিক কারখানা নামের প্রতিষ্ঠানটিতে বেশ সুনামের সাথে ব্যবসা করছিলেন তিনি। সালমার স্বামী আরমান শরীফের সাথে বিরোধের জেরে প্রতিপক্ষের লোকেরা ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে সালমা প্লাস্টিক কারখানার বিরুদ্ধে বাগেরহাট পরিবেশ অধিদপ্তরে দূষনের অভিযোগ করেন। সেই অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিভিন্নভাবে নারী উদ্যোক্তা সালমাকে হয়রানি শুরু করেন পরিবেশ অধিদপ্তর, বাগেরহাটের উপ-পরিচালক আরেফিন বাদল। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানাযায়, অভিযোগের প্রেক্ষিতে তৎকালীন বাগেরহাট সদর উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) এবং পরিবেশ অধিদপ্তর, বাগেরহাট কার্যালয়ের বায়োকেমিস্ট নিখিল চন্দ্র ঢালি ২০২০ সালের ৭ জানুয়ারি সালমা প্লাস্টিক কারখানা পরিদর্শণ করেন। একই মাসের ১৩ তারিখে সালমার প্রতিষ্ঠান দিয়ে কোন দূষণ হয়না মর্মে প্রতিবেদন দেন বায়োকেমিস্ট নিখিল চন্দ্র ঢালি। কিন্ত ১৫ জানুয়ারি কারখানা ভবনটি ঝুকিপূর্ণ উল্লেখ করে প্রতিষ্ঠান বন্ধ অথবা স্থানান্তরের আদেশ দেন পরিবেশ অধিদপ্তর, বাগেরহাটের উপ-পরিচালক আরেফিন বাদল। ওইদিন সালমার স্বামী আরমান শরীফ উপ-পরিচালক আরেফিন বাদলের দারস্থ হলে ২লক্ষ টাকা ঘুষ দাবী করেন তিনি। টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে ১৭ ফেব্রুয়ারি কারখানাটি আবাসিক এলাকায় অবস্থিত উল্লেখ করে কারখানা সরানোর জন্য আরও একটি নোটিশ প্রদান করেন উপ-পরিচালক আরেফিন বাদল। পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠানের পরিবেশগত ছাড়পত্রের মেয়াদ শেষ হলে ২৪ মার্চ প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ সরকার নির্ধারিত ফি জমা দেন সালমা বেগম। এর পরে ছাড়পত্র প্রদান না করে আবারও ঘুষ দাবি করেন ওই কর্মকর্তা। এর সাথে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার নানা ধরণের হুমকী-ধামকী চলতে থাকে। ঘুষ না দেওয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে একই বছর ৫ মে উপ-পরিচালকের নির্দেশে বায়োকেমিস্ট নিখিল চন্দ্র ঢালি সালমা প্লাস্টিক কারখানা সিলগালা করে দেন। পরবর্তীতে সালমার আবেদনের প্রেক্ষিতে ২১ জুন জেলা প্রশাসনের নির্দেশে আবার কারখানাটি চালু করা হয়। তারপরও পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে সালমাকে ছাড়পত্র প্রদান না করে ১৩ আগস্ট পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে আদেশ অমান্য করে কারখানা খোলার অপরাধে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য শুনানীর নোটিশ দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ১৮ আগস্ট পরিবেশ অধিদপ্তরের সদর কার্যালয়ের এনফোর্সমেন্ট উইং শাখায় এই অভিযোগের শুনানী অনুষ্ঠিত হয়। এবং ২৪ সেপ্টেম্বর শুনানীর রায়ে প্রমানিত হয় যে, পরিবেশ অধিদপ্তর বাগেরহাটের উপ-পরিচালক নিয়ম বহির্ভূত ভাবে কারখানাটি বন্ধ করেছিল। এরপরেও পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে কোন প্রকার সহযোগিতা পায়নি সালাম বেগম। এক পর্যায়ে ৩১ ডিসেম্বর পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে উপ-পরিচালক আরেফিন বাদলের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন সালমা বেগম। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে এখন পর্যন্ত ওই অভিযোগের কোন সুরাহা করেনি পরিবেশ অধিদপ্তর।
সালমা বেগমের স্বামী আরমান শরীফ বলেণ, ভবনটি ঝুকিপূর্ণ বলার পরে আমি পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ পরিচালকের কাছে যাই। তিনি আমার কাছে দুই লক্ষ টাকা ঘুষ দাবি করেন। আমি টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে আমার সাথে দূর্ব্যবহার করেন। বেআইনিভিাবে আমাদের কারখানা সিলগালা করেন। অনৈতিক সুবিধা আদায়ের পন্থা হিসেবে পরিবেশের ছাড়পত্র আটকে দেন তিনি। হেলেনা বেগম নামের কারখানার এক নারী শ্রমিক বলেন, আমার স্বামী আগে ভ্যানে করে সবজী বিক্রি করতো। কিন্তু একটি দূর্ঘটনার পরে পঙ্গু হয়ে যাওয়ায় ভ্যান নিয়ে বের হতে পারে না। আমার আয়েই সংসার চলে। কিন্তু মাঝে মাঝেই বড় স্যাররা এসে কারখানা বন্ধ করে দিয়ে যায়। তখন দুই মেয়ে আর স্বামী নিয়ে আমাদের অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাতে হয়। সালমা বেগম বলেন, অব্যহৃত ফেলে রাখা প্লাস্টিক কুড়িয়ে এনে ফ্যাক্টরীতে ব্যবহার করি আমরা। যার মাধ্যমে পরিবেশের অনেক উপকার হয়ে থাকে। এই কারণে ২০১৬ সালে আমি যৌথভাবে বিভাগীয় পরিবেশ পদকও পেয়েছি। এছাড়া কারখানায় অন্তত ৮ জন হত দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছি। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তরের স্বেচ্ছাচারিতায় বারবার আমার ব্যবসা বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। পরিবেশের ছাড়পত্র না দেওয়ায় আমি স্বাভাবিকভাবে কারখানা চালাতে পারছিনা। মাঝে মাঝেই পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা এসে আমার কারখানা বন্ধ করে দেয়।
সালমা বেগম আরও বলেন, একজন নারী উদ্যেক্তা হয়েও যদি সরকারী কর্মকর্তাদের এ ধরনের আচরণের সম্মুখিন হই তাহলে কোথায় যাবো বলে আক্ষেপ করেন তিনি। এই অবস্থায় কারখানার পরিবেশ ছাড়পত্র পাওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন এই নারী উদ্যেক্তা। ঘুষ দাবির বিষয়টি অস্বীকার করে পরিবেশ অধিদপ্তর, বাগেরহাটের উপ-পরিচালক আরেফিন বাদল বলেন, এলাকাবাসীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে কারখানা পরিদর্শণ করা হয়। এরপর নির্দিষ্ট সময় পার হলে ছাড়পত্র নবায়ন করতে আসেন সালমা বেগম। ভবন ঝুকিপূর্ণ ও কারখানার বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকায় ছাড়পত্র প্রদান করা হয়নি। পরবর্তীতে নানা জটিলতায় পরিবেশ অধিদপ্তরের বিভাগীয় কার্যালয় থেকে সালাম প্লাস্টিক কারখানার ফাইল তলব করে নেওয়া হয়েছে। এখন এই প্রতিষ্ঠানকে ছাড়পত্র দেওয়া হবে কি হবে না সে বিষয়ে বিভাগীয় কার্যালয়ের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি। তিনি আরও বলেন, আমি কারও কাছে ঘুষ দাবি করিনি।আইনের মধ্যে থেকে আমি কাজ করেছি। দপ্তরের সিদ্ধান্ত কারও বিরুদ্ধে গেলে, তারা নানা ধরণের অভিযোগ করে থাকে। এছাড়া আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করেছে সেটি প্রধান কার্যালয়ে তদান্তাধীন রয়েছে। তদন্ত শেষে আমাকে সিদ্ধান্ত জানানো হবে। পরিবেশ অধিদপ্তর, খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক সাইফুর রহমান খান বলেন, ২০২০ সালের ২ জুলাই সালমা প্লাস্টিক কারখানার ফাইলটি মহাপরিচালক বরাবর পাঠানো হয়েছে। এরপর থেকে আমাদের কাছে আর কোন নির্দেশনা আসেনি।