সংঘর্ষ ও সহিংসতার মধ্যে দিয়েই শেষ হলো যশোরের ৩৫ ইউপির নির্বাচন

0

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ ও সহিংসতার মধ্যে দিয়েই শেষ হয়েছে তৃতীয় ধাপের যশোরে ৩৫ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচনের ভোটগ্রহণ। ভোট শুরুর আগেই সহিংসতায় প্রাণ গেছে একজনের। বেশকিছু এলাকায় বিশৃঙ্খলার পাশাপাশি জাল ভোট, কেন্দ্র দখলের চেষ্টার অভিযোগ পাওয়া গেছে। দ্বিতীয় ধাপের মতো তৃতীয় ধাপের নির্বাচনেও দিনভর ছিলো সহিংসতার খবর। নির্বাচন ঘিরে জেলার শার্শা উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নে বিচ্ছিন্ন হামলা, ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে অন্তত ২০ জন আহত হয়েছে। রোববার জেলার শার্শা, বাঘারপাড়া এবং মণিরামপুর উপজেলার ৩৫ টি ইউনিয়নে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়।


সকালে ভোটগ্রহণের শুরুতেই শার্শার সীমান্তবর্তী ইউনিয়ন ডিহিতে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বাধে। প্রতিপক্ষ মেম্বর প্রার্থীর হামলায় তিনজন গুরুতর জখম হয়। উপজেলার ডিহি ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে মেম্বর প্রার্থী তরিকুল ইসলাম তোতা (তালা) ও তার সমর্থকরা প্রতিপক্ষ শহিদুল ইসলামের (মোরগ মার্কা) তিন সমর্থককে কুপিয়ে জখম করে।

সকাল সাড়ে ৯টার দিকে শালকোনা প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের পাশে এ ঘটনা ঘটে। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন সকালে বর্তমান মেম্বর তরিকুল ইসলাম তোতাসহ তার সমর্থক আশানুর সরদারসহ কয়েকজন রামদা, চাইনিজ কুড়াল, শাবল নিয়ে মোরগ মার্কার লোকজনের ওপর চড়াও হয়। তারা কুপিয়ে ও পিটিয়ে ফারুক, মিজান ও রাসেলকে গুরুতর জখম করে। তাদের বয়স ২০ থেকে ২২ বছরের মধ্যে। খবর পেয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রাসনা শারমিন মিথিসহ পুলিশ ও বিজিবি সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে হামলাকারীদের ধাওয়া দেয়। পরে পুলিশের সহযোগিতায় আহতদের শার্শার বুরুজবাগান স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়।

একইসাথে হাঙ্গামার সঙ্গে জড়িত অভিযোগে কটা খালেক নামে এক ব্যক্তিকে পুলিশ আটক করে। দুপুর ১ টার দিকে একই উপজেলার নিজামপুর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের গোড়পাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের পাশে ভোটার স্লিপ বিতরণকালে পিতা-পুত্রকে ছুরিকাঘাত করেছে প্রতিপক্ষরা। আহতরা হলেন, বাবা আলিমুর রহমান (৫৫) ও তার ছেলে রাব্বী (৩০)। কেন্দ্রে দায়িত্বরত এসআই মেজবাহ বলেন, তাদের মাথায় আঘাত লেগেছে। আহতদের উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্যে হাসপাতালে পাঠানো হয় বলে তিনি জানান। কেন্দ্রের বাইরে এ ঘটনা ঘটায় ভোটগ্রহণে কোনও সমস্যা হয়নি বলে তিনি দাবি করেন।


ডিহি ইউনিয়নের স্বতন্ত্রপ্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা ওবায়দুর রহমান বলেন, তার প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের প্রার্থী আসাদুজ্জামান মুকুল ও তার লোকজন ইউনিয়নের কাশিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে, টেংরালি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রসহ বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে তার ভোটারদের বাধা দিচ্ছে। এ বিষয়ে প্রশাসনের লোকজনকে বলেও তিনি কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেন।


তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে নৌকার প্রার্থী আসাদুজ্জামান মুকুল উল্টো বলেন স্বতন্ত্রপ্রার্থী আনারস প্রতীকের লোকজনরা ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি কেন্দ্র থেকে আমার পোলিং এজেন্টদের বের করে দেয়।
শার্শার দৌলতপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে সেখানে ভোটারদের দীর্ঘ লাইন। কেন্দ্রে পুরুষের চেয়ে নারী ভোটারের উপস্থিতি অনেক বেশি। এ সময় বিদ্রোহী প্রার্থী আলতাফের ছেলে অভিযোগ করে বলেন, কায়বার প্রতিটি ভোট কেন্দ্র নৌকার লোকজন ভোট কাটাকাটি করছেন। প্রশাসন তাদেরকে সহযোগিতা করছেন বলে তিনি অভিযোগ করেন। তবে নৌকার প্রার্থী হাসান ফিরোজ টিংকু জানান, কায়বার সকল কেন্দ্রেই শান্তিপূর্ণভাবে ভোট গ্রহণ চলছে। নৌকার কোন লোকজন কায়বার কোন কেন্দ্রে ভোট কাটাকাটি করছে না। যারা এ ধরনের অভিযোগ করছে তারা মিথ্যা বলছে। অগ্রভুলোট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের নৌকার পুলিং এজেন্ট শিউলি বেগম অভিযোগ করে বলেন, এ কেন্দ্রে স্বতন্ত্র প্রার্থীর লোকজন জাল ভোট দিচ্ছেন।


জেলার মণিরামপুরে ১৬ টি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ভোট অনুষ্ঠিত। ভোর থেকেই ভোটারদেরকে ভোটের মাঠে এসে লাইন দিতে দেখা গেছে। অনেক ভোটকেন্দ্রের বাইরে হামলা, ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে বাধা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়ার ঘটনাও ঘটছে। এদিকে শনিবার মধ্যরাত থেকে উপজেলার খানপুর ও পাড়দিয়া ভোটকেন্দ্রের বাইরে ককটেল বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গেছে। পাড়দিয়া হাইস্কুল কেন্দ্রের বাইরে রাত থেকে ভোট শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত অন্তত ২০টি বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানান। এ কেন্দ্রের মেম্বর প্রার্থী ইউনুস আলী দাবি করেন, বহিরাগত সন্ত্রাসীরা ঘুঘুরাইল চাতাল মোড়ে বোমা ফাটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। তারা ভোটারদের কেন্দ্রে আসতে বাধা দিচ্ছে।


এ বিষয়ে জানতে চাইলে শ্যামকুড় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের দায়িত্বপ্রাপ্ত রিটার্নিং কর্মকর্তা মাসুদ হোসেন বলেন, পাড়দিয়া ৯ নম্বর কেন্দ্রের বাইরে বোমা হামলার ঘটনার খবর পেয়ে সেখানে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এখন পরিবেশ অনুকূলে আছে। এদিকে খেদাপাড়া ইউনিয়নের চাঁদপুর-মাঝিয়ালী ভোটকেন্দ্রে স্বতন্ত্র প্রার্থী সামছুজ্জামান শান্তর (ঘোড়া) এজেন্টদের বের করে দেয়ার অভিযোগ করেছেন প্রার্থীর বোন শিরিনা পারভিন। এ বিষয়ে ওই ইউনিয়নের রিটার্নিং কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা আব্দুর রশিদ বলেন, এ বিষয়ে আমার কাছেও অভিযোগ এসেছে আমি খোঁজ নিয়ে দেখছি।


জেলার বাঘারপাড়া উপজেলার ৯ ইউনিয়নেও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ উপজেলায় নির্বাচনের একদিন আগে কয়েকটি ইউনিয়নে সহিংসতা ঘটলেও নির্বাচনের দিন বড় ধরনের সহিংস ঘটনা ঘটেনি। উপজেলার জোহরপুর ইউনিয়নে বেতালপাড়া এলাকায় ভোট চলাকালে নৌকার ও স্বতন্ত্রপ্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। সকালের দিকে স্বতন্ত্রপ্রার্থী বদর উদ্দীন মোল্যা সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করে বলেন, তার প্রতিদ্বন্দ্বী নৌকার প্রার্থীর লোকজনরা ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আসতে দিচ্ছেনা। এর বাইরে উপজেলার নারিকেলবাড়িয়া ইউনিয়নের দৌলতপুর কেন্দ্রে নৌকা ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে এতে ১০ জন আহত হন। এদের মধ্যে ৫ জনকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ বিষয়ে জেলা সিনিয়র নির্বাচন অফিসার মো. হুমায়ূন কবীর বলেন, দুএকটি ছোট ছোট ঘটনা ছাড়া যশোরে শান্তিপূর্নভাবে তৃতীয় ধাপের নির্বাচন শেষ হয়েছে। নির্বাচনে মাঠ পর্যায়ে প্রশাসনের লোকজনের কঠোর দায়িত্বের কারণে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব হয়েছে।


বেনাপোল (যশোর) সংবাদদাতা জানান, শার্শা উপজেলার ১০টি ইউনিয়নে সংঘর্ষ, ভাঙচুর ও নির্বাচন বয়কটের মধ্য দিয়ে রোববার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। শার্শা উপজেলার বাগআঁচড়া ইউনিয়নে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ইলিয়াস কবির বকুল সকাল থেকে নিজ বাড়িতে অবরুদ্ধ ছিলেন। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী আব্দুল খালেকের সমর্থকরা তাকে অবরুদ্ধ করে রাখেন বলে তিনি অভিযোগ করেন। তিনি নিজের ভোটটিও দিতে পারেননি বলে সাংবাদিকদের জানান। গতকাল দুপুরে নিজ বাড়িতে এক সংবাদ সম্মেলনে ভোট বয়কটের ঘোষণা দেন তিনি। অপরদিকে এদিন বিকেলে বাগআঁচড়া ছোট কলোনি কেন্দ্রে নৌকার প্রার্থী ইলিয়াস কবির বকুল ও স্বতন্ত্র প্রার্থী (আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী) আব্দুল খালেকের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে উভয়পক্ষের ৮ জন আহত হয়েছেন। এছাড়া উপজেলার ডিহি ইউনিয়নে শালকুনা দু গ্রুপের সংঘর্ষে ৩ জন আহত, পুটখালী ইউনিয়নের শিকড়ী মাদ্রাসা কেন্দ্রে ৪ জন আহত, বাগআঁচড়ার কলোনী কেন্দ্রে ৩ জন আহত ও ঘরবাড়ি ভাঙচুর, বাহাদুর ইউনিয়নের ঘিবা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৪ জন আহত ও ডুপপাড়া কেন্দ্রে স্বতন্ত্র প্রার্থীর ৩ জন কর্মী আহত হয়েছেন। নিজামপুর ইউনিয়নে গোড়াপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থক পিতা-পুত্রসহ ৩ জন আহত হয়েছেন। অপরদিকে ১০ টি ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, কম বেশি সংঘর্ষ, ভাঙচুর ও আহতের ঘটনা ঘটেছে। তবে, নির্বাচনে গোগা ইউনিয়নের বিভিন্ন কেন্দ্রে নারী ভোটারদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মত। যশোরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সাইদুজ্জামান জানান, শার্শার ১০টি ইউনিয়নে শান্তিপূর্ণভাবে ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। প্রতিটি কেন্দ্রে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার ছিল। কোথায় কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। উল্লেখ্য, গত শনিবার রাতে শার্শা উপজেলার কায়বা ইউনিয়নের রুদ্রপুর গ্রামে নির্বাচনী সহিংসতায় কুতুব উদ্দিন (৪০) নামে এক ব্যক্তি নিহত হন। আহত হন ১৩ জন। নিহত কুতুব উদ্দিন রুদ্রপুর গ্রামের মহিউদ্দীনের ছেলে।