৪৩ বছরে ইসলামী বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষা-গবেষণায় এখনো পিছিয়ে

0

ইমানুল সোহান, ইবি ্(ঝিনাইদহ)॥ প্রতিষ্ঠার চার দশক পরেও ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়টি সমস্যা থেকে মুক্তি পায়নি। শিক্ষা ও গবেষণায় যেমন পিছিয়ে রয়েছে তেমনি আবাসন, পরিবহন সংকট রয়েছে। একটি দলের কাছে এখনো দখলে রয়েছে পুরো ক্যাম্পাস ও তার নিয়োগ ব্যবস্থা। শিক্ষক স্বল্পতা যেমন রয়েছে তেমন রয়েছে শিক্ষক অপরাজনীতি। ফলে পাঠদানের চয়ে আধিপত্য বিস্তার এখানে অনেক সময় মুখ্য হয়ে উঠেছে। ৪৩ পেরিয়ে ৪৩ এ পা দেওয়ার সময় শিক্ষঅর্থরিা চান এর থেকে পরিত্রাণ, চান শিক্ষা ও গবেষণায় এগিয়ে যাক বিশ^বিদ্যালয়টি।
কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়, ১৭৫ একরের ক্যাম্পাসটি ৪২ পেরিয়ে ৪৩ বছরে পদার্পণ করছে। ১৯৭৯ সালের ২২ নভেম্বর কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহের মধ্যবর্তী স্থান শান্তিডাঙ্গা-দুলালপুরে বিশ^বিদ্যালয়টির স্থাপিত হয়। তবে দুই দফায় বিশ^বিদ্যালয়টির স্থান পরিবর্তন হয়। ১৯৮৩ সালের ১৮ জুলাইয়ের এক আদেশে বিশ^বিদ্যালয়টিকে গাজীপুর বোর্ড বাজারে এবং ১৯৯০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি অপর এক আদেশে পুনরায় কুষ্টিয়ায় স্থানান্তর করা হয়।
১৯৮৫-৮৬ শিক্ষাবর্ষে দুটি অনুষদের চারটি বিভাগে ৩ শত ছাত্র ভর্তির মধ্য দিয়ে শুরু হয় বিশ^বিদ্যালয়টির একাডেমিক যাত্রা। এখন বিশ^বিদ্যালয়টিতে ৮টি অনুষদের অধীনে ৩৪টি বিভাগ ও একটি ইনস্টিটিউট রয়েছে। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৫ হাজার ৩৮৪। আর শিক্ষক রয়েছেন ৩৯০। প্রতিষ্ঠার চার দশকে সবকিছুরই পরিধি বেড়েছে। একের পর এক চালু হয়েছে নতুন বিভাগ। তবে পড়াশোনা ও গবেষণার গুণগত মানের উন্নতি হয়েছে, এ কথা জোর দিয়ে বলতে পারছেন না সাবেক ও বর্তমান শিক্ষকেরা। এছাড়াও পরিবহন সমস্যা, আবাসন সংকট, শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষক সংকট, বিশ^বিদ্যালয়ের নাম নিয়ে বিভ্রান্তিসহ নেই অনেক কিছু।
আবাসিক বিশ^বিদ্যালয়ের প্রস্তাবনা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হলেও সেই সংকট এখনো কাটেনি। ছাত্রদের জন্য ৫টি ও ছাত্রীদের জন্য ৩টি আবাসিক হল রয়েছে। এসব হলে মাত্র ২৪ শতাংশ শিক্ষার্থীর আবাসন সুবিধে রয়েছে। বাকী ৭৬ শতাংশ শিক্ষার্থী ক্যাম্পাস পাশ^বর্তী ও কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ শহরের মেস ও বাসা ভাড়ায় থাকেন। তবে প্রকৌশল অফিস বলছে, বিশ^বিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য দশতলা একটি করে আবাসিক হলের কাজ শুরু হয়েছে। আরও দুইটি হলের কাজ শুরু হবে। কাজগুলো সম্পূর্ণ হলে আবাসন সংকট ৯০ শতাংশ কমে যাবে।
এতবছরেও মেধার মানদণ্ডে হলগুলোর সিট বরাদ্দ দিতে ব্যর্থ হল কর্তৃপক্ষ। নিয়ন্ত্রণ করে ছাত্রসংগঠনগুলো। গত ৪ বছর ধরে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাই দখল করে রেখেছে হলের সিটগুলো। এ বিষয়ে বাংলা বিভাগের ¯œাতক শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী আদনান বলেন, প্রতিষ্ঠার ৪৪ বছরেও আবাসন সুবিধা দিতে ব্যর্থ কর্তৃপক্ষ। এছাড়াও হলে থাকতে হলে করতে হয় রাজনীতি। মেধার ভিত্তিতে সিট বরাদ্দ কাল্পনিক বিষয়। ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ে পরিবহন খাতে। বছরে ব্যয় হয় প্রায় ৭ থেকে ৮ কোটি টাকা। বিশাল অংকের টাকা ব্যয় হলেও এ খাতে সেবা মিলে যৎসামান্য । সংশ্লিষ্ট খাতে বিশ^বিদ্যালয়ের নিজস্ব গাড়ি সংখ্যা ৪৩। এছাড়াও কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহ হতে শিক্ষার্থীদের আনা নেওয়ার জন্যে ভাড়ায় চালিত গাড়ি সংখ্যা ৩২টি। এই ৩২টি বাসের ভাড়াবাবদ বাস মালিকদেরকে বিশ^বিদ্যালয় প্রতিদিন দিনে ১ লাখ ৬৭ হাজার ৪৪০ টাকা গুণতে হয়। বছরে যার পরিমাণ ৪ থেকে ৫ কোটি টাকা। বিশাল অংকেট টাকা ব্যয় হলেও ভাড়ায়চালিত বাসগুলো নিয়ে শিক্ষার্থীদের অভিযোগের শেষ নেই। বাসগুলোতে নেই বিশ^বিদ্যালয়ের কোনো স্টিকার, নেই রুট প্লান। ফলে পথে থামিয়ে বাহিরের যাত্রী ওঠানো, শিক্ষার্থীদের সাথে ড্রাইভার ও হেলফালদের বাকবিতন্ডা নিত্যনৈমত্তিক ঘটনা।
এ বিষয়ে পরিবহন প্রশাসক অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক হলের কাজ চলমান রয়েছে। হলগুলো নির্মাণ সম্পন্ন হলে পরিবহন সমস্যার সমাধান হবে।
গত এক দশকে বিশ^বিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে প্রায় একশ শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর অধিকাংশ নিয়োগে দলীয় বিবেচনা, প্রভাবশালী শিক্ষক ও রাজনৈতিক নেতাদের সুপারিশ ছিল বলে অভিযোগ আছে। এছাড়াও শিক্ষক নিয়োগে বিশাল অংকের টাকা লেনদেন হয়েছে। যা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কয়েকজন শিক্ষককের অডিও ফাঁস হয়েছে। বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এদিকে শিক্ষক রাজনীতিতে আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের রয়েছে শাপল ফোরাম ও বঙ্গবন্ধু পরিষদ নামে দুটি সংগঠন। এই দুই সংগঠনের মধ্যেও রয়েছে বিভক্তি। দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে শাপলা ফোরামের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। অন্যদিকে বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের সাদা দল নামে দুটি সংগঠন রয়েছে। আর জামায়াতপন্থীদের রয়েছে গ্রীণ ফোরাম। গত শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে বিএনপি-জামাআতপন্থী ও আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের একাংশের ভোটে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয় জামাআতের এক শিক্ষক। এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক বলেন,‘ বিশ^বিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো শিক্ষক ও শিক্ষার্থী দুই পক্ষকেই দলীয় রাজনীতিতে নিয়োজিত করা হয়েছে। এখান থেকে উত্তরণ না ঘটলে শিক্ষার মান ও গবেষণার মানের উন্নতি হবে না।’
গবেষণায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ের অর্জন খুবই নগন্য। উল্লেখযোগ্য গবেষণা নেই বললেও চলে। এর পিছনে শিক্ষকদের দাবি, পর্যাপ্ত বাজেট দেওয়া না এই খাতে। একাডেমি অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত অর্থবছরে গবেষণায় ৮০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যা মূল বাজেটের ০.৫৮ শতাংশ। এ খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে পাঠদান নিয়ে সন্তষ্ট নন শিক্ষার্থীরা। সিনিয়র শিক্ষকরা নামমাত্র ক্লাস নিয়েই কোর্স শেষ করেন। আর জুনিয়র শিক্ষকরা রাজনীতিতে ব্যস্ত। ফলে দায়সারা ভাবে চলে পাঠদান। এ বিষয়ে বিশ^বিদ্যালয়ের ২০ জন শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, সেশনজট এড়াতে নামমাত্র ক্লাস নেন শিক্ষকরা। সিট পড়েই শিক্ষা জীবন শেষ করতে হয়। ৪৩ বছরেও নাম বিভ্রান্তি কাটেনি বিশ^বিদ্যালয়টির। বিশ^বিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ, প্রশাসনিক, অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডার ও বাসে ভিন্ন ভিন্ন নাম ব্যবহার করা হয়। নামগুলোর মধ্যে রয়েছে কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়, কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়, ইসলামী বিশ^বিদ্যালয় কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ, ইসলামী বিশ^বিদ্যালয় কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ বাংলাদেশ, ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়, বাংলাদেশ। দুই অঞ্চলের মধ্যবর্তী স্থানে বিশ^বিদ্যালয়টি হওয়ায় এ সমস্যা হয়েছে বলে জানান বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তবে শিক্ষার্থীরা বিষয়টির সমাধান চায়। তাদের দাবি, বিশ^বিদ্যালয় অ্যাক্ট অনুযায়ী বিশ^বিদ্যালয়ের নামকরণ করা হোক। আঞ্চলিক ভিত্তিতে নয়। এসব সংকট ছাড়াও এতবছরেও ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নেই। যা নিয়ে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষক সংকট। এতকিছুর মাঝেও আশার আলো দেখছেন উপ- উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমান।