আজ চৌগাছার জগন্নাথপুর হানাদার মুক্ত দিবস

0

মুকুরুল ইসলাম মিন্টু, চৌগাছা (যশোর) ॥ আজ ২২ নভেম্বর যশোর চৌগাছার জগন্নাথপুর হানাদার মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের আজকের দিনে মিত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সাথে পাক সেনাদের তুমুল যুদ্ধসহ মল্লযুদ্ধ (হাতাহাতি) হয়। যেটা যুদ্ধের ইতিহাসে দেশের আর কোথাও হয়নি। এ দিন তীব্র লড়াইয়ের পর পাকিস্থানি সৈন্যরা পরাজিত হয়ে পালিয়ে যায়।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ২১ নভেম্বর পবিত্র ঈদের দিন থেকেই যুদ্ধের সূচনা হয়। ঈদের নামাজ শেষে চারপাশে নিস্তব্ধ নীরবতা বিরাজ করে। যুদ্ধের নানা প্রস্তুতিতে অজানা আতঙ্ক দেখা দেয় এলাকাবাসীর মধ্যে। অবুঝ শিশুরাও পরিস্থিতি না বুঝে ঈদের আনন্দে মেতে থাকে। ঠিক সেই মুহূর্তে দুপুর ২ টার দিকে চৌগাছার জগন্নাথপুর-গরীবপুর মাঠ থেকে পাক হানাদার বাহিনী হঠাৎ অতর্কিত হামলা চালাতে থাকে। প্রচন্ড গুলির শব্দে চারদিক প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। জনসাধারণ দ্বিগি¦দিক ছোটাছুটি করতে থাকে। জীবন বাঁচানোর জন্য মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় প্রতিরোধ গড়ে তোলার নেশায় পাক সেনাদের বিরুদ্ধে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সাথে মুক্তি বাহিনী যুক্ত হয়ে যুদ্ধ শুরু করে। উভয়ের সম্মুখযুদ্ধে ভারী অস্ত্র ব্যবহার করা হয়। একই সাথে ট্যাংক যুদ্ধ ঘোষনা করে উভয়পক্ষ। তুমুল সংঘর্ষে পাকসেনাদের ৮টি ট্যাংক ধ্বংস করে দেয় মিত্র ও মুক্তি বাহিনী। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা মোশারফ হোসেন জানান, গোলাগুলি শেষ হলে মিত্র বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের পরাস্ত করার জন্য শুরু করা হয় আকাশযুদ্ধ। মুহূর্তের মধ্যে পাক জঙ্গি বিমান জগন্নাথপুর মাঠসহ চৌগাছার আকাশ প্রকম্পিত করে তোলে। মুহুর্মুহু গুলিতে বিধস্থ করার চেষ্টা করা হলেও ভারতীয় বিমানের কাছে পরাস্ত হয় পাক বিমান। বারবার বাধার মুখে পাক বিমান চৌগাছার আকাশে বেশিক্ষণ উড্ডয়ন করতে পারেনি। মিত্র বাহিনী দুটি বিমানকে ভূপাতিত করে দুজন পাইলটকে আটক করে। এই যুদ্ধে কয়েক’শ পাক সৈন্য নিহত হয়। যুদ্ধ চলাকালীন উভয়ের গোলাবারুদ শেষ হলে একপর্যায়ে জগন্নাথপুর আম্রকাননে শুরু হয় মল্লযুদ্ধ (হাতাহাতি)। এ সময় উভয় পক্ষ অস্ত্রের বাট, বেয়নেট, কিল-ঘুষির মাধ্যমে পরস্পরের সাথে যুদ্ধ করে।
প্রসঙ্গত, মল্লযুদ্ধ দেশের আর কোথাও হয়নি। দ্বিতীয় দফায় জগন্নাথপুর ও গরীবপুর মাঠে আজকের এই দিন (২২ নভেম্বর) পুনরায় শুরু হয় কামান যুদ্ধ। যুদ্ধে ৯৬ জন পাক সেনা নিহত হয়। পাক সেনারা দিশেহারা হয়ে বিধ্বস্ত ৭টি ট্যাংক, বাক্স ভরা মার্কিন চাইনিজ অস্ত্রশস্ত্র ফেলে রেখে যশোর সেনানিবাস অভিমুখে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। চৌগাছার যুদ্ধে ৫৭ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ সাধারণ জনগণ শহীদ হন। তাদের মধ্যে ১৯ জনের নাম পাওয়া গেছে। এরা হলেন-সুজাউদ্দৌলা, আসাদুজ্জামান মধু, আব্দুর রাজ্জাক, আবুল হোসেন, রেজাউল হোসেন, করিমন নেছা, মহিউদ্দীন, রহিমা খাতুন, ভানু বিবি, ছইরন নেছা, দেওয়ান মুন্সি, কফিল উদ্দীন, বিশু মন্ডল, খোকা বারিক, আলতাপ হোসেন, জহির উদ্দীন, হাসান আলী, আয়শা আক্তার ও তাহের আলী। মল্লযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণে যশোরের সাবেক জেলা প্রশাসক ড. মহিউদ্দীন খান আলমগীর জগন্নাথপুর গ্রামের নাম পরিবর্তন করে নাম রাখেন মুক্তিনগর। গ্রামেই মল্লযুদ্ধের ঐতিহাসিক আ¤্রকাননে প্রতিষ্ঠা করেন মুক্তিনগর শহীদ স্মরণী শিক্ষা নিকেতন নামের মাধ্যমিক বিদ্যালয়। এই আম্রকাননে ১৯৯৮ সালে ভারতীয় সেনা প্রধান শংকর রায় চৌধুরী পর্যবেক্ষণে আসেন। ১৯৭১ সালে এই এলাকায় তিনি যুদ্ধের নেতৃত্বে দেন বলে মুক্তিযোদ্ধারা জানান। মুক্তিনগর শহীদ স্মরণী শিক্ষা নিকেতনের প্রধান শিক্ষক শাহাজান আলী জানান, মুক্ত দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে বিজয়স্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ, দোয়া মাহফিল, আলোচনা সভা ও র‌্যালি।