ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধি অর্থনীতিতে নয়া ধাক্কা

0

আলতাফ হোসাইন॥ জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে আমদানি-রপ্তানিতে বিঘ্ন ঘটায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য। সরাসরি প্রভাব পড়ছে মূল্যস্ফীতি, বিদ্যুৎ, কৃষি ও রপ্তানি খাতে । অর্থনীতিবিদরা বলছেন, জ্বালানি তেলের দাম এক লাফে ১৫ টাকা বৃদ্ধির ফলে কৃষি পণ্য উৎপাদন ও পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাবে। এতে মূল্যস্ফীতি ক্রমেই আরও বেড়ে যাবে। এটি সাধারণ মানুষকে যেমন ভোগাবে, তেমনি রপ্তানিসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ খাতে নেতিবাচক প্রভাবের ফলে দেশের সার্বিক অর্থনীতি নতুন করে বাধার মুখে পড়বে। একইসঙ্গে করোনায় বিপর্যস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারও বাধাগ্রস্ত হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। করোনা মহামারি পরবর্তী অর্থনীতিতে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন শুরু হয়েছিল। রপ্তানি খাতসহ অর্থনীতির প্রায় সকল খাতই ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল। বিশেষ করে পোশাক রপ্তানিতে গত কয়েক মাসে রেকর্ড প্রবৃদ্ধি হয়েছে। যা ভঙ্গুর অর্থনীতিতে শক্তি যুগিয়েছে। তবে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিতে ইতিমধ্যেই ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। রপ্তানিকারকরা বলছেন, হঠাৎ করে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি আমদানি-রপ্তানিসহ স্থানীয় বাজারেও নেতিবাচক প্রভাব স্পষ্ট।
পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম মনে করেন, বিশ্ব বাজারে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধিতে ইতিমধ্যেই চাপের মধ্যে আছে পোশাক শিল্প। এমন পরিস্থিতিতে আকস্মিকভাবে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিতে গভীর সংকটে পড়বে খাতটি। এতে সুতার দাম সহ পোশাক শিল্পের অন্য সব খরচ আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা করছেন তারা। তিনি বলেন, জ্বালানির দাম বাড়ায় এখনই পরিবহন খরচ বেড়ে গেছে। অন্যদিকে কারখানার অনেক মেশিন ডিজেলে চালাতে হয়। একটি মাঝারি আকারের পোশাক কারখানায় মাসে আড়াই লাখ টাকার জ্বালানি খরচ পড়ে। এতে পোশাকের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। ফলে শিল্প সংশ্লিষ্টরা চাপের মুখে পড়বে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের জিডিপিতে ১৪ শতাংশ অবদান রাখা কৃষিখাত। দেশে মোট ডিজেল ও কেরোসিনের ৬৫ শতাংশ ব্যবহার হয় কৃষিতে। এখন জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিতে উৎপাদন খরচ ও কৃষকদের ব্যক্তিগত ব্যয়ও বাড়বে। ফলে কৃষক চাষাবাদ কমাতে বাধ্য হবে। বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, মহামারিকালে অনেক কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সরকারি প্রণোদনা সহায়তায় কৃষকরা যখন ধীরে ধীরে মহামারির ক্ষতি কাটিয়ে উঠছিলেন তখন হঠাৎ ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বড় ধাক্কা খাবে কৃষিখাত। করোনা মোকাবিলায় সরকার যেসব খাতে প্রণোদনা দিয়েছে, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির ফলে সেই প্রণোদনার সুফল বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি রিজওয়ান রহমান মনে করেন, হঠাৎ করেই জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি করোনাকালের বিপর্যস্ত অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। তিনি বলেন, সরকার চাইলে ভর্তুকি দিয়ে জ্বালানির দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারতো। অন্তত ছয় মাস মূল্য স্থিতিশীল থাকলে অর্থনীতিও এই সময়ের মধ্যে মহামারির আঘাত কাটিয়ে উঠতে পারতো। কিন্তু এক লাফে জ্বালানির দাম এতটা বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে অর্থনীতি সংকটের মুখে পড়তে পারে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে অর্থনীতিতে বেশকিছু নেতিবাচক প্রভাবের কথা উল্লেখ করেন। এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় পণ্য পরিবহন ও গণপরিবহন ব্যয়, কৃষি ও শিল্প উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। এতে দেশের প্রায় সব নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বেড়ে যাবে। বাড়িভাড়া বেড়ে যাবে। এর ফলে লাখ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবে। এতে বাধ্য হয়ে মধ্যবিত্ত, সীমিত ও নিম্ন আয়ের মানুষদের তাদের খাদ্য বাজেট কমাতে হবে। শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে ব্যয় কাটছাঁট করতে হবে, নারী ও শিশুর চিকিৎসা আরও সংকুচিত হয়ে যাবে, তাদের ঋণ বেড়ে যাবে। অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ বলেন, সরকার প্রতিষ্ঠিত এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে হয় পাশ কাটিয়ে, নয়তো প্রভাবিত করে অযৌক্তিকভাবে তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম উপর্যুপরি বৃদ্ধি করে। এটি সাধারণ মানুষকে সরাসরি আক্রমণ করার শামিল। এসব সিদ্ধান্তে কতিপয় ব্যক্তি ও গোষ্ঠী খুবই লাভবান হয়। কিন্তু জনগণের ওপর বহুমাত্রিক বোঝা তৈরি হয়। তিনি বলেন, করোনাকালে বড় ধাক্কায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যখন বিপর্যস্ত। নতুন করে দরিদ্র হয়েছে দেশের তিন কোটির বেশি মানুষ। করোনাকালে ও করোনা পরবর্তী নানা জটিলতায় দেশের ৮০ শতাংশ মানুষই এখন অর্থ সংকটে। এর মধ্যে সব জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে সরকার কিছু বলছে না। যদিও মানুষের ওপর জুলুম ও নতুন নতুন বোঝা চাপাতে সরকার খুব চাঙ্গা। তাই সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে ডিজেল, কেরোসিন, এলপি গ্যাসের দাম একের পর এক বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এ ছাড়াও বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতেও জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব পড়বে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছেন অর্থনীতিবিদরা। কারণ, বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি তেল ব্যবহার করা হয়। তাই বিদ্যুৎ উৎপাদনের সার্বিক সক্ষমতায় জ্বালানির দাম বৃদ্ধির চাপ পড়তে পারে।