তরিকুল ইসলামের স্মরণ সংখ্যার একগুচ্ছ লেখা-২

0

তরিকুল ইসলাম ও
অসাম্প্রদায়িকতা
॥ নার্গিস বেগম ॥

‘সাম্প্রদায়িকতা’ কথাটি এখন বহুল ব্যবহৃত। সেই সাথে ‘অসাম্প্রদায়িক’ ও ‘ধর্ম নিরপেক্ষ’। কাউকে গালি দিতে বা দেশদ্রোহী হিসাবে চিহ্নিত করতে চাইলে ‘সাম্প্রদায়িক’ ও ‘মৌলবাদী’ তকমাটি জুড়ে দিলেই হল। তার জীবন বরবাৎ হয়ে উঠবে, কেল্লাফতে। আমাদের ছাত্র-জীবনে, আমরা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে গালি দিতাম ‘মোনায়েম খাঁ’ বলে। দেশের স্বার্থ-বিরোধী এবং ঐ নামটি সমার্থক ছিল। স্বাধীনতার পরে এলো ‘কোলাবরেটর’। এই দাগ লাগিয়ে নিজের বিপক্ষের ব্যক্তিকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে মেরেছে আওয়ামী লীগ। নব্বই এর পরে তারা নতুন বুলি ধরলেন ‘স্বাধীনতার চেতনা’। এবং নতুন গালি ‘রাজাকার’। এই নতুন বুলি ও গালি ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ বিরুদ্ধ মতের রাজনীতিকদের মামলায় জড়াচ্ছে, শাস্তি দিচ্ছে। এখন ঐ অস্ত্র সম্ভবতঃ ভোঁতা মনে হচ্ছে। সে কারণেই নতুন অস্ত্র। সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ। বলার অপেক্ষা রাখে না, সমস্ত অস্ত্রেরই লক্ষ্যবস্তু এদেশের জাতীয়তাবাদী শক্তি। বিশেষ করে বিএনপি।
কুমিল্লার নানুয়ার দীঘির পাড় পূজা মন্ডপে পবিত্র কোরান শরীফ অবমাননার ঘটনায় সমস্ত দেশে বিভিন্ন পূজা মন্ডপে হামলা ও প্রতিমা ভাংচুর, হিন্দুদের বাড়ি-ঘরে হামলা ও লুটপাট হয়েছে। এবং বিভিন্ন অঞ্চলে হাজারো মানুষ এতে অংশ নিয়েছে। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে গুলি চালিয়েছে। প্রাণহানি ঘটেছে। তদন্ত, মামলা, ধরপাকড়, রিমান্ড, সরকারী দল কর্তৃক বিএনপিকে নোংরা ভাষায় অভিযুক্তকরণ সবই চলছে। এ নিয়ে অনেক কথাই বলা যায়। বলা যায়, সরকারের সদিচ্ছা থাকলে এসব কিছুই ঘটতো না। বর্তমান সময়ে তরিকুল ইসলামের ৩য় মৃত্যুবার্ষিকীতে এ কথাটাই বার বার মনে হচ্ছে। তিনি এবং তাঁর সরকার, যার বিরুদ্ধে সংবিধান পরিবর্তন করে ধর্ম নিরপেক্ষ বদলে ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম’ ও ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহ্তে বিশ্বাস’ সংযোজন করায় মৌলবাদের উত্থান হয়েছে বলে অভিযুক্ত করে আওয়ামী লীগ, সেই সরকারের আমলে সংখ্যালঘুরা কি এর চাইতে অনিরাপদ ছিল?
তরিকুল ইসলামের জন্ম ও বেড়ে উঠা যশোর শহরের একটি রক্ষণশীল, মধ্যবিত্ত, ব্যবসায়ী পরিবারে। রাজনীতির চর্চা ছিল না। সদ্য ভূমিষ্ট পাকিস্তানে তাঁর শৈশব কেটেছে। পঞ্চাশ এর দশকে নতুন রাষ্ট্র গড়ে উঠার সময়ই তাঁর বাল্য ও কৈশোর কাল। নতুন রাষ্ট্রের নরম পলিমাটিতে যে রাজনীতিক সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিচয় তৈরী হচ্ছিল, তাঁর বেড়ে উঠার বয়সই ছিল সেটা। সব কিছুই তাঁর চরিত্রে প্রভাব রেখেছে। যশোর ছিল চিরকালই সাংস্কৃতিকভাবে উন্নত। উচ্চবর্ণের শিক্ষিত হিন্দুদের বসবাস এবং প্রভাব ছিল এখানে। তাঁদের মধ্যে সঙ্গীত, সাহিত্য, নাট্যচর্চা ছিল। মুসলিম সম্প্রদায়ও পিছিয়ে ছিলেন না। সাংস্কৃতিক চর্চায় হিন্দু মুসলিম সমভাবে অংশ নিতেন। গানের স্কুল ছিল। ঘরে ঘরে সঙ্গীত চর্চা ছিল। সেই ৫০’এর দশকে মাইকেল মধুসূদন কলেজে ছাত্র সংসদ এর অনুষ্ঠানে মাহমুদুল এবং মঞ্জু আপা অভিনয় করেছেন। নারী চরিত্রে পুরুষরাই অভিনয় করতেন। নারীর অভিনয় তখন দুঃসাহস। কলেজে তখন ছাত্র রাজনীতির চর্চা শুরু হয়েছে। ভাষা আন্দোলনে যশোর সাহসী ভূমিকা পালন করে। তেমনি শুরু হয়েছে স্বায়ত্বশাসনের আন্দোলন। যশোর জিলা স্কুলের ছাত্র হওয়ায়, এই রাজনীতিক ও সামাজিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের আবহ তাঁকে প্রভাবিত করেছে। তখন মহরমের জাঁকালো তাজিয়া মিছিল যেমন হতো, তেমনি শান শওকতের সাথে পালিত হতো দূর্গোৎসব। সকল সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েরাই পূজা উপলক্ষে আয়োজিত মেলায় যেত। বাচ্চাদের জন্য মেলার আলাদা বাজেট রাখতে হতো। দাঙ্গা কখনও হয়নি। উভয় ধর্মের লোকজন এ ব্যাপারে সচেতন ছিলেন। তরিকুল ইসলামের পিতা মরহুম আবদুল আজিজ প্রথম জীবনে স্কুল ইন্সপেক্টর ছিলেন। পরে চাকরি ছেড়ে ব্যবসায়ে আসেন। তিনি অত্যন্ত ধর্মপরায়ন ব্যক্তি ছিলেন। ১৯৬৪ সালে পবিত্র হজ্জ্বব্রত পালন করেছিলেন। তখন জাহাজে করে যেতে হতো। ধর্মপালনে অত্যন্ত নিষ্ঠাবান এই ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গী ছিল অত্যন্ত উদার। তাঁর বড় দু’পুত্র, মরহুম নূরুল ইসলাম ও মরহুম সিরাজুল ইসলামের বেশির ভাগ বন্ধুই ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের। তাঁদের অবাধ যাতায়াত ছিল এ বাড়িতে, তাঁর মাতাও বিষয়টি খুবই স্বাভাবিক ভাবেই নিতেন। ঈদের দিন তাঁদের আসার জন্য সবাই আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতেন। তেমনি পূজা উপলক্ষে তাঁদের বাড়ির বিবাহ বা অন্নপ্রাশনের অনুষ্ঠানে এঁদের বাড়ির মহিলাদের অংশগ্রহণ ছিল খুবই স্বাভাবিক। সম্পর্কটা ছিল একেবারেই পরিবারিক। তাঁরা প্রয়াত হবার পরেও তাঁদের সন্তানেরা সম্পর্কটি অটুট রেখেছেন।
সুতরাং, তরিকুল ইসলামকে অসাম্প্রদায়িক হবার জন্য বিশেষ কোন চেষ্টা করতে হয়নি। বা তাঁর পরিচয়কে বিশেষ অভিধা দেবার প্রয়োজন হয়নি। এটি তাঁর চরিত্রের অংশ ছিল। তিনি মহান আল্লাহর একত্বে গভীর বিশ্বাসী ছিলেন। একই সাথে অন্য সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্বাধীনতাকে তিনি শ্রদ্ধা করতেন। সম্প্রদায় হিসাবে নয়; মানুষ হিসাবে দেখেছেন সবাইকে।
সংকটে সহায়তা দিয়েছেন। ১৯৬৪ সালে ভারতে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বাধলে এখানকার অবাঙালিরা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ভিতরে ভিতরে সংগঠিত হতে থাকে। বগচরে তখন অনেক হিন্দু বসতি ছিল। তাঁদের আক্রান্ত হবার আশংকা দেখা দিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ইউনিয়নের সদস্যরা ক্লাস ফেলে ছুটে গিয়েছিল তাদের রক্ষা করতে। তরিকুল ইসলাম তাদের অন্যতম ছিলেন।
কেশশ্রী সেলুনের সত্ত্বাধিকারী রাজকুমার দা’ বয়সে বড় হলেও তাঁর সাথে সর্ম্পকটি ছিল বন্ধুর মতো। চুল কাটাবার জন্য শুধুই নয়, মাঝে মাঝে গল্প করবার জন্যও যেতেন। ও বাড়ি ছিল তাঁর নিজের বাড়ি। স্বাধীনতার পরে রাজকুমার দা ১৬০০০ টাকায় একটি জমি ক্রয়ের বায়না করেন। কিন্তু পরে জমির মালিক ১৮০০০ টাকা না দিলে জমি রেজিস্ট্রি করতে অস্বীকার করেন। তিনি ছিলেন সরকার পক্ষের লোক। প্রভাবশালী। তরিকুল ইসলাম তখন যশোর পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান। সময় ১৯৭৩/৭৪। বন্ধুর পাশে দাড়ালেন এবং মালিককে ওই ১৬০০০ টাকায় রেজিস্ট্রি করে দিতে বাধ্য করলেন। ওই জমির সনাক্তকারীও হলেন তিনি। বর্তমান পরিস্থিতিতে বার্ধক্যকবলিত রাজকুমার দা’র অনুভূতি জানতে চাইলে বলেন, ‘শূণ্যতা অনুভব করছি। অনেক নেতাই আসতেন এখানে, কিন্তু তিনি ছিলেন অন্যরকম।’
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে, যখন ভারত ফেরত তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে হাতে অস্ত্র, দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সারা শহর, সেই সময় তরিকুল ইসলামের একজন হিন্দু বন্ধু ক্রন্দনরত অবস্থায় ছুটে এসে জানালো, তার বাড়িতে অস্ত্রধারী একজন তরুণ তার বোনকে অপদস্থ করছে। আড্ডা ফেলে তিনি ছুটলেন, খালি হাতে। দেখলেন, দ্রৌপদীর বস্ত্র হরনের পুরাবৃত্তি হতে যাচ্ছে। বিছানার উপরে স্টেনগান। মেয়েটি অসহায়ভাবে দয়া ভিক্ষা করছে। পূর্বাপর না ভেবেই তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন ছেলেটির উপর। জামার কলার ধরে টেনে তুলে জোরে মারলেন এক চড় এবং ঘুষি। সঙ্গে গালাগাল। ছেলেটি তড়িতে উঠে, ভাই! বলে বেরিয়ে গেল। পরে তিনি বলেছিলেন, ‘ঐ অস্ত্রটি সুযোগ পেয়েও কেন ব্যবহার করেনি সেটিই অবাক ব্যাপার।’ এরকম অনেক ঘটনাই আছে। যেটি তিনি ফলাও করে কখনও বলেননি। জানা গেছে, উপকারভোগী বা অন্য কারো নিকট থেকে।
১৯৯২ সালে ভারতে বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার ঘটনায় দাঙ্গা শুরু হলে সারাদেশের মুসলিমরা ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠেন। প্রতিবাদে সর্বত্র মিছিল হয়। যশোরেও উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে। তরিকুল ইসলাম তখন মন্ত্রী। আইন শৃংখলা রক্ষা কমিটির মিটিংয়ে কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করে পুলিশকে নির্দেশ দেন সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে। এবং হিন্দু বসতিপূর্ণ এলাকায় পাহারার ব্যবস্থা করেন। তাঁরা নিরাপদ ছিলেন। এখনও তাঁর সেই ভূমিকার কথা হিন্দু সম্প্রদায় শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় তিনি অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেছেন। শুধু এটি নয় যে কোন জাতীয় সংকটে যেমন উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলার পরে তিনি সেই গভীর রাতে হাসপাতালে ছুটে যান এবং আহতদের চিকিৎসা দেন। নিজের গাড়িতে করে আহতদের উন্নত চিকিৎসার্থে খুলনায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। তেমনি রিকসাওয়ালাদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ হলে পুলিশ গুলি চালিয়ে কয়েকজনকে হত্যা করে। শহরময় আতঙ্ক, হরতাল, পুলিশের তান্ডব। তরিকুল ইসলাম এগিয়ে গেলেন। প্রশাসনের সাথে আলোচনায় বসলেন। অবস্থা শান্ত হয়ে এলে। অথচ এই দুইটি ঘটনার সময়ই কিন্তু তিনি ছিলেন বিরোধী দলে। প্রথমটির সময়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, দ্বিতীয় ঘটনার সময় স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার। তিনি ছিলেন আপাদমস্তক একজন্য রাজনীতিবিদ। একই সাথে সমাজসচেতন মানবদরদী। তাঁর কর্মকান্ডের মূল লক্ষ্য ছিল মানুষের কল্যাণ, দেশ ও জাতির কল্যাণ। তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর বন্ধু এবং রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী মরহুম খালেদুর রহমান টিটো বলেছিলেন, ‘যশোরের মানুষ এখন বুঝতে পারবে, তারা কি হারালো?’
তাঁর মুত্যুর পরে জানাযা’য় মানুষের ঢল নেমেছিল। মানুষের কত আপন ছিলেন তিনি সংখ্যাতীত শোকার্ত মানুষের উপস্থিতি তার প্রমাণ দেয়। তিনি ছিলেন দেশপ্রেমিক। দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বকীয়তা রক্ষায় তাঁর ভূমিকা ছিল স্পষ্ট, আপোষহীন। তাঁর মতো নেতার প্রয়োজন বেশি করে অনুভূত হবে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকটে।
মহান আল্লাহ তাঁকে জান্নাতবাসী করুন, তার কাজকে কবুল করুন।

নার্গিস বেগম
সম্পাদক
দৈনিক লোকসমাজ

 

প্রত্যাশা এক নতুন রাজার
আনোয়ারুল কবির নান্টু

আজ ৪ নভেম্বর। আজ জাতীয়ভাবে পালনীয় বিশেষ কোনো দিন নয়, তবে দিনটি যশোরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের কাছে স্মরণীয়। রাজনৈতিক মত, পথ, পার্থক্য নির্বিশেষে অধিকাংশ জনের কাছে শোকের দিন। যশোরের ধর্ম-বর্ণ, গোত্র বিভেদের গন্ডি পেরিয়ে অতি সাধারণ থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের বিবেকবান মানুষের জন্য স্বজন হারানোর দিন। প্রকৃতির নিয়মে সময়ের ব্যবধানে চোখের পানি শুকিয়ে গেলেও আজকের দিনটিতে তাদের বুকের ভেতর চিন চিন ব্যথা অনুভূত হয়। এবারও সে হচ্ছে তা নির্দ্বিধায় বলতে পারি। এই দ্বিধাহীনতা দৃঢ় হয়েছে পাঁচদিন আগে ৩০ অক্টোবর দৈনিক লোকসমাজের জন্মদিনে পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা প্রকাশক তরিকুল ইসলাম স্মরণে আয়োজিত দোয়া মাহফিলে স্বজন, সুহৃদ, শুভাকাক্সিক্ষর স্বতঃস্ফূর্ত অংশ গ্রহণ দেখে। আমন্ত্রণের পাঁচ গুণ বেশি মানুষের উপস্থিতি যার দোয়া মাহফিলে হয় তাঁর প্রতি মানুষের দরদ নিয়ে দৃঢ়তা তো দেখানোই যায়। বলা যায়, শুধু চিন চিন ব্যথা নয়, আজ অনেকের চোখ ভিজছে, ভারী হচ্ছে বুক। আমাদের চোখও অশ্রুমুক্ত নয়। কারণ, সবার সাথে আমরাও আজ হারিয়ে ছিলাম আমাদের নেতা আমাদের পিতা জনতার রাজাকে। হ্যাঁ আমাদের এই নেতা, পিতা, রাজা আর কেউ নন, তিনি তরিকুল ইসলাম। ২০১৮ সালের এই দিনে তিনি সবাইকে কাঁদিয়ে চলে যান না ফেরার দেশে। স্মৃতিভ্রম না হলে চরম বিরোধীও স্বীকার করবেন সেদিন যশোর কেঁদেছিল অঝোর ধারায়। যশোরের জনকল্যাণে গড়া সরকারের ইট, কাঠ, পাথর, ভিজেছিল আপন বেদনায়। ভিজেছিল অলিগলি, রাজপথও। এ যেন ছিল নির্মাতার প্রতি জড়ো পদার্থের শ্রদ্ধা ভালোবাসা কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ। শুধু যশোর নয়, সে দিন কেঁদেছিল গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল। কান্নার রোল ছিল সব শহর বন্দর গ্রামে। কান্না ছিল স্বজন, অভিভাবক ও পিতৃহারার মতো।
আপনহারার এ কান্নার ঢেউ আছড়ে পড়েছিল পরদিন যশোর শহরে। রাজার মরদেহ আসবে তাই ভোর থেকেই রাজপথে নেমেছিল জনতার ঢল। বিমানবন্দর থেকে ঘোপের ‘রাজমহল’ পর্যন্ত জনতা ভিজিয়ে ছিল চোখের জলে। দিন শেষে ভিজে ছিল ঈদগাহ ময়দান থেকে শহরের পাড়া মহল্লা। অশ্রুভেজা ফুলে ঢাকা শেষ বিদায়ের জানাজায় সমবেত হয়েছিল ইতিহাসের সর্বাধিক মানুষ। জানাজা শেষে কারবালামুখি সব মিছিলে অংশ নিয়েছিল হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের হাজার হাজার মানুষ ও সমবেত জনতা। কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে উচ্চস্বরেই বলেছিল ‘আর হবে না এমন নেতা, হবে না এমন আপনজন। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ঘরে ঘরে এমন বন্ধু কিংবা অভিভাবক শত বছরেও আসবে না এই জনপদে। শরীর থেকে রক্ত পকেট থেকে অর্থ দিয়ে কেউ আর দাঁড়াবে না অসহায় মানুষের পাশে। বারবার ভোট ভালোবাসা বিশ্বাস বঞ্চিত হয়েও কেউ মনের মাধুরী মিশিয়ে যশোরকে গড়বে না। মসজিদ, মন্দির, উপাসনালয়ের উন্নয়নে অকৃপণ হাতে দান অনুদান কেউ দেবে না। মক্তব, মাদ্রাসা, স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, দাতব্য চিকিৎসালয় থেকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল অলিগলি, রাজপথ, বন্দর নির্মাণে যশোরকে কেউ গড়বে না। মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষায় জীবনবাজী রেখে কেউ লড়বে না। দলমত ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই শেষ কথা ছিল ‘আরেকটি তরিকুল ইসলাম জন্মাবে না এ জনপদে। যশোরকে এমন করে কেউ ভালোবাসতে পারবে না। মহান স্রষ্ঠা তাকে বেহেস্ত নসিব করুন।’
আমরা জানি ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর তরিকুল ইসলামের মৃত্যুর সংবাদ প্রচারের পর যশোরাঞ্চলের মানুষের মাঝে কী হয়েছিল। আমাদের জানার কারণ মানুষের কল্যাণে তরিকুল ইসলামের হাজার সৃষ্টির অন্যতম হচ্ছে ‘দৈনিক লোকসমাজ’। এ কারণে মানুষ সত্য জানতে লোকসমাজরই স্মরণাপন্ন হয়েছিল। সারারাত আমরা খবর দিয়েছিলাম, আর কান্নার আওয়াজ শুনেছিলাম। একের পর এক বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষের শিশুর মতো কান্না আমাদেরকে শোকের সাগরে ডুবিয়েছিল। আমরা হাউহাউ করে কেঁদেছিলাম আপনাদের মতোই। এর পরদিন মরদেহ যশোরে আনার আগে পরে কী ঘটেছিল সবাই জানে। আমরা সে শোক সাগরের জনসমুদ্র ধারণ করেছিলাম। ধারণ করেছিল অন্যরাও জনতার রাজার রাজপথে প্রস্থানের সে দৃশ্য আর কোনোদিন যশোরে কারো দেখা হবে কি-না জানি না। তবে, অন্য সবার মতো জানি-বুঝি হাজারো তরিকুল ইসলাম জন্ম নেবে। হয়তো অনেকে অনেক কীর্তি গড়ে স্মরণীয়-বরণীয় হবে। শুধু হবে না মানুষের হৃদয় জুড়ে বসে থাকা জনতার রাজা তরিকুল ইসলাম। যার হাসিতে মানুষ হাসতো, যার মলিন মুখ মানুষকে কাঁদাতো। যার পরশে মানুষ ভুল যেত শত দুঃখ-কষ্ট বেদনা। তারপরও আমরা চাই, যে নামেই হোক আবারও আসুক কোনো তরিকুল ইসলাম। হোক তার যোগ্য উত্তরসূরী। জিতে নিক জনতার হৃদয়ের রাজ আসন। জান্নাতুল ফেরদৌস থেকে দেখুক আমাদের রাজা। আর প্রাণভরে দেয়া করুক উত্তরসুরি হোক তাঁরই মতো মানবদরদী-যশোরপ্রেমী। হোক তাঁরই মতো জনতার রাজা। সমাপ্ত করুক তাঁর অসমাপ্ত কাজ। যশোরকে সাজাক নতুন সাজে যেমন স্বপ্ন ছিল তাঁর। সফল করুক আমৃত্যু স্বপ্ন। আজকের এই দিনে আমরাও প্রত্যাশা করি আসুক কোনো নতুন রাজা, হোক তাঁর যোগ্য উত্তরসূরী। সবশেষে আত্মার মাগফিরাত কামনা করি আমাদের পিতা, আমাদের রাজার। ঠাঁই হোক তাঁর জান্নাতের সুমহান মর্যাদায়।

তরিকুল ইসলাম এবং লোকসমাজ
সুন্দর সাহা

গেল ৩০ অক্টোবর ২৫ বছর আগে এক ক্রান্তিকালে জাতির ঐতিহাসিক প্রয়োজনে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের অবিভাবক হিসেবে সাবেক মন্ত্রী তরিকুল ইসলাম এই কাগজটির জন্ম দিয়েছিলেন। তৎকালীন আওয়ামী শাসকের দুঃশাসনে নির্বাক হয়ে যাওয়া মানুষের কথা বলা এবং খুন, গুম, লুট, জুলুমের বিরুদ্ধে জনপ্রতিরোধ সৃষ্টির লক্ষ্যেই মূলত তিনি এই সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ইতিহাস রচনা নয়, ইতিহাসের স্বাক্ষী ও উপাদানের অংশ হওয়াও ছিল লক্ষ্য। সময়ের ব্যবধানে পত্রিকাটি সে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। ২৬তম বর্ষে পা রেখেছে লোকসমাজ-এর প্রকাশনা। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রাণ পুরুষ তরিকুল ইসলাম প্রতিষ্ঠিত দৈনিক লোকসমাজ সময়ের প্রয়োজনে হয়ে ওঠে সময়ের সাহসী দৈনিক। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দেশপ্রেমিক বাংলাদেশীদের অধিকার রক্ষার বিশ্বস্ত সৈনিক হিসেবেই গত ৩০ অক্টোবর পার করেছে ২৫ বছর। প্রবল-প্রতাপশালী ক্ষমতাসীন বিরুদ্ধশক্তির একের পর এক আক্রমণ-ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে লোকসমাজ শুধু আপন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখেনি, সেই সাথে পালন করে চলেছে বস্তুনিষ্ঠ সাহসী সাংবাদিকতার আপসহীন ভূমিকা। প্রতিষ্ঠার পর থেকে নানান প্রতিকূলতা, সীমাহীন বাঁধা আর সমস্যা অতিক্রম করে এগিয়ে চলেছে লোকসমাজ।
জননেতা তরিকুল ইসলামের মত তাঁর প্রতিষ্ঠিত লোকসমাজের পথ চলাও মসৃণ ছিল না। লোকসমাজ-কে আজকের এ পর্যায়ে আসতে মোকাবিলা করতে হয়েছে প্রতাপশালীদের নানান ষড়যন্ত্র আর কঠিন প্রতিকূল পরিস্থিতি। নানামুখী ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে পত্রিকাটি। আক্রান্ত হয়েছেন লোকসমাজের প্রতিষ্ঠাতা প্রকাশক, সাবেক মন্ত্রী, আধুনিক যশোরের রূপকার, নন্দিত জননেতা প্রয়াত তরিকুল ইসলাম। রাজনীতির পাশাপাশি লোকসমাজ প্রকাশনার কারণে ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দিয়ে প্রবীণ এই রাজনীতিককে বার বার কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। গত ২৫ বছরে প্রকাশক ও সম্পাদকসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদকের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা করেও সত্যের পথ থেকে পিছু হটাতে পারেনি আগ্রাসী আধিপত্যবাদী শক্তির সেবাদাসরা। একের পর এক শত-সহস্র বাঁধা অতিক্রম করে লোকসমাজ এগিয়ে চলেছে। কখনও মাথানত করেনি কোন দুঃশাসনের কাছে। সাহসী সাংবাদিকতা এবং পাঠক শুভানুধ্যায়ীদের সহযোগিতায় পত্রিকাটির প্রকাশনা অব্যাহত রয়েছে শত প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে। দেশে ভোটের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করাসহ স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আর মানবাধিকার রক্ষার লড়াইয়ের পাশাপাশি দুর্নীতিবাজ ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম-লড়াইয়ে সব সময় অবিচল রয়েছে লোকসমাজ। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেম লোকসমাজ-এর এগিয়ে যাওয়ার চেতনার মূল মন্ত্র। পাহাড় সমান বাঁধার মাঝেও সত্য প্রকাশ অব্যাহত রাখার পেছনে লোকসমাজ-এর মূল প্রেরণাই হচ্ছে সততা আর সত্যনিষ্ঠা। বর্তমান শাসকগোষ্ঠী ও তাদের দোসররা মনে করেছিল, প্রকাশকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক মামলার পর মামলা দিয়ে সত্য প্রকাশ থেকে বিরত রাখা যাবে। দুঃশাসনের পথভ্রষ্ট করার ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে সত্য প্রকাশে অবিচল-অটল রয়েছে পাঠক প্রিয় পত্রিকাটি। লোকসমাজ-এর কপালে নতুন করে শনির দশা নিয়ে আসে মহাজোট সরকারের প্রথম আমলের আক্রোশ। সে সময় হঠাৎ করেই শুরু হয় লোকসমাজ-এর প্রকাশনা বাতিল করার ষড়যন্ত্র। বিশেষ প্রতিনিধিকে হত্যার হুমকি প্রদানসহ নানাবিধ ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে যশোরে স্মরণকালের সর্ববৃহৎ মানববন্ধনে হাজার-হাজার মানুষ অংশ নেন। সত্য প্রকাশের কারণে এ পত্রিকার প্রকাশক, সম্পাদক, নির্বাহী সম্পাদক, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও বিশেষ প্রতিনিধিসহ সাংবাদিকদের নামে অসংখ্য মামলা দায়ের করা হয়েছে। যশোরেই শুধু নয়, বিভিন্ন জেলায় এসব মামলা দায়ের করা হয়। পত্রিকাটির প্রকাশক-সম্পাদকসহ ও সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদকের বিরুদ্ধে মামলা করেও সত্যের পথ থেকে লোকসমাজকে পিছু হটাতে পারেনি শাসকগোষ্ঠী। সরকারের দুর্নীতি আর সর্বক্ষেত্রে দলীয়করণসহ লাগামছাড়া অনিয়মের ফিরিস্তি স্ববিস্তারে লোকসমাজে প্রকাশিত হয়েছে অত্যন্ত সাহসীকতার সাথে। আর এ কারণেই লোকসমাজ-এর সরকারি বিজ্ঞাপন প্রদানে অঘোষিতভাবে জারি করা হয় নিষেধাজ্ঞা। আওয়ামী লীগের ইতোপূর্বেকার দুঃশাসনামলেও (১৯৯৬-২০০১ সাল) লোকসমাজ-এর কন্ঠ স্তব্ধ করতে সবরকম বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিয়েছিল সরকার। লোকসমাজে বস্তুনিষ্ট সংবাদ প্রকাশের কারণে লোকসমাজের প্রতিষ্ঠাতা প্রকাশক তরিকুল ইসলামকে ষড়যন্ত্র মূলকভাবে ঘৃণিত সব মামলায় জড়ানো হয়েছিল। রাষ্ট্রপতির অনুকম্পা বা ক্ষমতার প্রভাবে নয়, আইনী লড়াইয়ে সরকারের সব ঘড়যন্ত্র মিথ্যা প্রমাণ করে তিনি উচ্চ আদালত থেকে নিষ্কন্টক হন তিনি।
২০০৭ সালের জরুরি অবস্থার সরকারের সময়েও রোষানলে পড়েন লোকসমাজ-এর তৎকালীন প্রকাশক সাবেক মন্ত্রী তরিকুল ইসলাম, সম্পাদক অধ্যাপক নার্গিস বেগম এবং নির্বাহী সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিতসহ তাদের প্রিয় লোকসমাজ। প্রকাশক ও নির্বাহী সম্পাদককে কারারুদ্ধ করা ছাড়াও সম্পাদকসহ পরিবারের সকলকে মিথ্যা অভিযোগে অসংখ্য মামলায় জড়িয়ে পত্রিকাটি বন্ধের ষড়যন্ত্র চলে। এতেও তৎকালীন প্রকাশক তরিকুল ইসলামসহ লোকসমাজ পরিবারের কারও মনোবলে চিড় ধরেনি সামান্যও। পত্রিকার প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ সংবাদ কর্মীদের দৃঢ়তায় তখন পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যাওয়া থেকে রেহাই পায়। তরিকুল ইসলামের অনুপ্রেরণায় বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে পাঠক প্রিয় লোকসমাজ। বর্তমান সরকারের আমলের দ্বিতীয় দফায়ও তৎকালীন লোকসমাজ প্রকাশক সাবেক মন্ত্রী তরিকুল ইসলাম এবং নির্বাহী সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিতের নামে দায়ের করা হয়েছে একের পর এক ষড়যন্ত্রমূলক মামলা। এমন কি গাড়ি পুড়ানোসহ নাশকতার মামলা দেয়া হয়েছিল প্রবীণ রাজনৈতিক তরিকুল ইসলাম ও তাঁর উত্তরসূরি অনিন্দ্য ইসলাম অমিতের নামে। তাতেও থামানো যায়নি লোকসমাজের অগ্রযাত্রা। আমরা হতোদ্যম না হয়ে মাটি কামড়ে লড়ে যাচ্ছি এবং সে লড়াইয়ে বিপুল জনসমর্থন আমাদের সঙ্গী হয়েছে বলেই লোকসমাজ এখন এক ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তাধন্য দৈনিকের নাম। লোকসমাজ সত্য প্রকাশে কখনও পিছপা হয়নি; ভবিষ্যতেও হবে না। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমতের¡ প্রশ্নে লোকসমাজ আপস করতে শেখেনি। অনেকেই ভেবেছিলেন তরিকুল ইসলামের মৃত্যুর পর লোকসমাজ হারিয়ে যাবে। তাদের সেই স্বপ্ন দুঃস্বপ্নেই রয়ে গেছে। বর্তমান প্রকাশক শান্তনু ইসলাম সুমিত দায়িত্ব নেয়ার পরও লোকসমাজ একচুলও নড়েনি তার আদর্শ থেকে। একই ধারাবাহিকতায় মানুষের কল্যাণ এবং দেশপ্রেমের চেতনায় আরও এগিয়ে যাবে তরিকুল ইসলামের লোকসমাজ। কোনো মহল এটাকে ‘অপরাধ’ মনে করে অব্যাহত শত্রুতার পথ বেছে নিলে আমাদের করার কিছু নেই। আমরা কারও পাকা ধানে মই দিতে চাই না। তবে, আমাদের তথা জনগণের ধান কেউ কেড়ে নিতে চাইলে আমরা সেই অপকর্ম প্রতিহত করতে অঙ্গিকারবদ্ধ। আগ্রাসন ও আধিপত্যবাদের কালো থাবার বিরুদ্ধে লোকসমাজ লড়াই চালিয়ে যাবে এটাই সবার দৃঢ় প্রত্যয়। দেশের মানুষের মনের খোরাক ও চেতনা জাগিয়ে তুলবে প্রতিদিন। ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়া ও একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার ধারাবাহিক অনিয়মের বিরুদ্ধে লোকসমাজের শাণিত লেখনি অব্যাহত থাকবে। ভোট ও ভাতের অধিকার নিশ্চিত না করা পর্যন্ত গণমানুষের লড়াই সংগ্রামে লোকসমাজ তাদের পাশে ছিল, আছে এবং থাকবে দেশপ্রেমিক মানুষের প্রিয় পত্রিকা লোকসমাজ। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন তরিকুল ইসলামের রেখে যাওয়া আদর্শকে শিরে ধারণ করে লোকসমাজ সত্য ও ন্যায়ের পতাকা হাতে পাঠকের দরবারে হাজির হবে। যে অঙ্গিকার নিয়ে লোকসমাজ পেরিয়ে এসেছে দীর্ঘ ২৫ বছর। সেই অঙ্গিকার থেকে আগামীতেও লোকসমাজ একচুলও পিছু হঠবে না। বরং সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে লোকসমাজের লেখনি হবে আরও শাণিত। এটাই নন্দিত জননেতা তরিকুল ইসলামের রেখে যাওয়া আদর্শ এবং অঙ্গিকার।
লেখক:-লোকসমাজ অনলাইন এডিটর ও বিশেষ প্রতিনিধি।

প্রতিদিনের প্রার্থনায় নিঃসীম ভালোবাসায়
এহতেশামুল হক শাওন

চার দশকেরও বেশি সময়ের সম্পর্ক আমাদের। ভাই সম্মোধন করতাম। কিন্ত ¯েœহ করতেন পিতার মতো। শাসন করতেন শিক্ষকের মতো। চলার পথের ভুলত্রুটি শুধরে দিতেন। একজন শিক্ষক যেভাবে ছাত্রকে শেখায়। রাজনীতির দীর্ঘ পথপরিক্রমায় তার কাছ থেকে কেবল শিখেছি। এতোটা ত্যাগ, এতোটা আত্মবিসর্জন আর কার আছে? প্রলুব্ধ করেছে শাসক। ভয় দেখিয়েছে! লাভ হয়নি। ফলে নেমে এসেছে জলপাই ছাউনির নারকীয় বর্বরতা। তবু কি টলেছেন তিনি? টলানো সম্ভব হয়নি।
ভেতরে ভেতরে ক্ষয়েছেন ক্রমাগত। সামরিক স্বৈরশাসকের ক্ষতচিহ্ন বহন করেছেন সমস্ত শরীর জুড়ে। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দর্শন থেকে একচুল টলানো যায়নি। জিয়া পরিবারের প্রতি ভালোবাসায় চিড় ধরেনি। দক্ষিণ জনপদের উন্নয়নের স্বপ্ন দেখে গেছেন আমৃত্যু। বাস্তবায়নের নজির সারা দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে।
উন্নয়নের দাবি আদায়ে দলীয় প্রধানের সামনে অকুন্ঠচিত্ত। ঋজু ও কিছুটা উদ্ধত। অন্যরা তখন ত্রাহিকম্পমান। ভয়ে আর আতংকে। না জানি কি প্রলয় ঘটে যায়।
নেতা তখনও বলেই চলেছেন- আগামীতে ভোটে দাঁড়াতে হবেনা? জনগণের কাছে কি বলে ভোট চাইবো?
এক দৃঢ়চেতা জননেতার অকাট্য যুক্তি মেনে নিলেন আপোসহীন খেতাবে ভূষিতা একজন দেশনেত্রী। উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার রূপকার একজন প্রধানমন্ত্রী। একের পর এক স্থাপিত হয়ে চললো উন্নয়ন স্থাপত্যের মাইল ফলক।
এভাবেই তরিকুল ইসলাম সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করছিলেন খুলনার শফিকুল আলম মনা। জেলা বিএনপির সভাপতি তিনি। ছাত্রজীবনে যার রাজনীতিতে হাতেখড়ি। একসাথে রাজনীতি করতে গিয়ে দেখেছি দুজনের (তরিকুল চাচা ও মনা ভাই) সম্পর্কের নৈকট্য। ফলে নেতার মৃত্যুবার্ষিকীতে পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় লেখার জন্য তার (শফিকুল আলম মনার) স্মৃতিচারণের স্মরণাপন্ন হওয়াকেই সবচেয়ে যথোপযুক্ত মনে হয়েছে।
হেমন্তের সকাল। কোভিড উত্তরকালে নিত্যদিনের জীবনধারায় বিরাজমান স্থবিরতা। নিত্যপণ্যের দামের চাপে চিড়েচ্যাপ্টা মধ্যবিত্ত। যুগপদ হতাশা আর স্থবিরতার ছাপ সর্বত্র। ভোর থেকে সকাল আর বিকেল থেকে রাত অবধি কুয়াশায় মোড়া থাকে প্রকৃতি। এ যেন বাঙালি ক্ষয়িষ্ণু জীবনযাত্রার প্রতিচিত্র। এমনই এক সকালে নগরীর মুন্সিপাড়ার বাড়িতে চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসেন শফিকুল আলম মনা।
‘১৯৭৩-১৯৭৪ সালের কথা। আমি বিএল কলেজের ছাত্র। বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের সাথে জড়িত। তরিকুল ভাই ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ন্যাপের নেতা। বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন ন্যাপের ছাত্র সংগঠন। সেই প্রথম তরিকুল ভাইয়ের সান্নিধ্যে আসা। শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করতেন ভাই। বস্তিবাসী শ্রমিক পরিবারের সাথে দিনের পর দিন অবলীলায় কাটিয়ে দিতেন। তাদের সাথে মিটিং করতেন, তাদের সাথে এক খাবার খেতেন, বস্তির স্যাঁতস্যাতে ঘিঞ্জি ঘরে রাতে ঘুমাতেন। শ্রমিক মেহনতী জনতার মুক্তির শ্লোগান তুলতেন। তাদেরকে দাবি আদায়ে সচেতন করে তোলার দায়িত্ব ছিল তার।
সে সময় খুলনায় ন্যাপ নেতা ছিলেন এম নুরুল ইসলাম দাদু ভাই, শান্তি ঘোষ, মাহমুদ আলম খান মুকু ভাই, অ্যাডভোকেট হাসান ভাই।
একসাথে বহু রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করেছি। মাওলানা ভাষানীর ডাকে ফারাক্কা লংমার্চে তার পাশে ছিলাম। যশোর পৌরনির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে খুলনা থেকে গিয়ে তার জন্য কাজ করেছি।
জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে জাগদল গঠন করেন। শুরু থেকেই জাগদলের সাথে ছিলেন তরিকুল ভাই। তার ধারাবাহিকতায় বিএনপিতে। আমরাও খুলনাতে বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন করা অনেকেই যোগ দিলাম বিএনপির যুব সংগঠন যুবদলে।
জিয়াউর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর বিএনপির চরম দুঃসময়ে হাল ধরেন তরিকুল ভাই। দক্ষিণ পশ্চিম জনপদে দলকে শক্তিশালী ও পুনর্গঠিত করতে নিরলসভাবে কাজ করেছেন।
এরজন্য তাকে জীবনের সবচেয়ে চরম মাশুল দিতে হয়েছে। সামরিক জান্তা চেয়েছিল অন্য অনেক রাজনীতিকের মতো তাকেও অর্থে অথবা প্রলোভনে কিনে নিতে! কিন্ত আমৃত্যু বিক্রি হওয়ার মতো পণ্যে পরিণত করেননি নিজেকে। ফলে সেনা ব্যারাকের বন্দি শিবিরে জঘণ্য ও বর্বরতম নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে দিনের পর দিন। রাতের পর রাত।
একটা সময় গেছে যখন অনেক দিন আমরা তরিকুল ভাইয়ের কোন সন্ধান পাইনি। পরিবারের পক্ষ থেকে স্বজনদের পক্ষ থেকে শুভাকাঙ্খীদের পক্ষ থেকে খোঁজ করা হয়েছে। কোথাও ছিলেননা তিনি। ধরে নেওয়া হয়েছিল তরিকুল ভাই আর নেই।
সামরিক জান্তা মন্ত্রী হওয়ার অফার করেছিল। মুখের ওপর বলে দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমানের আদর্শ ত্যাগ করবেন না। হাতের নখের ভেতরে সুঁচ ফোটানো, পায়ের নখ উপড়ে ফেলা, প্লাসের দ্বারা দাঁত তুলে ফেলা, দিনের পর দিন নিকষ কালো অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বন্দী করে রাখা- ফ্যাসিস্ট শাসকের নির্যাতনের সকল ধরণের প্রয়োগ চলেছে গণমানুষের নেতা তরিকুল ভাইয়ের ওপর।
অনেক বছর পর রাজনৈতিক সুদিনে একান্ত আলাপচারিতার সময়ে সেই সব লোমহর্ষক সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এসব জানিয়েছেন তরিকুল ভাই। অনেক চিকিৎসা নিয়েছেন। দেশে বিদেশে বহু ডাক্তারের ট্রিটমেন্ট চলেছে। কিন্ত আমৃত্যু যন্ত্রণামুক্ত হতে পারেননি। রাতে ঘুমাতে পারতেন না। বসে থাকতেন চেয়ারে।
১৯৯১ সালে গণতন্ত্রের নবযাত্রার সূচনায় তিনি মন্ত্রী হয়েছেন। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়, পরে তথ্য মন্ত্রণালয়। তাছাড়াও সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। সরকারি দায়িত্ব পেয়েই যে কাজটি করেছিলেন তা হলো এলাকার উন্নয়নে সর্বোচ্চ সংখ্যক প্রকল্প গ্রহণ করা। আর অগ্রাধিকার ভিত্তিক এসব কাজের বাস্তবায়নে কোন ধরনের শৈথিল্য তিনি মেনে নিতেন না। এক্ষেত্রে ছিলেন ভয়ানক কঠোর। অজন্ম গণতন্ত্রের চেতনায় বিশ^াসী তরিকুল ভাই সব সময় বিশ^াস করতেন নেতা হতে গেলে, জনপ্রতিনিধি হতে চাইলে জনগনের কল্যাণে কাজ করার কোন বিকল্প নেই।
রাজপথের রাজনৈতিক কর্মীকে প্রাণ উজাড় করে ভালোবাসতেন। শাসনের দিক দিয়ে ছিলেন প্রচণ্ড কড়া ধাচের। গালিগালাজ করতেন অহরহ। সেই গালি খাওয়া কর্মী মামলায় জড়ালে কিংবা পুলিশি হয়রানির শিকার হলে অন্য কারো আগে বুক পেতে ঝাপিয়ে পড়তেন তরিকুল ভাই। প্রাণ উজাড় করে ভালোবাসতে জানতেন। কমিটি গঠনের সময় এলে কচুরিপানার মতো আগাছ পরগাছা হাইব্রিড এসে ভিড় করে। তরিকুল ভাই সব সময় আন্দোলনের কর্মীকেই দলে পদ পদবী দিতে উৎসাহী ছিলেন।
শেখ হাসিনার প্রথম দফা, ওয়ান-ইলেভেনের অসাংবিধানিক সরকার এবং শেখ হাসিনার দ্বিতীয় দফার দিনের ও রাতের ভোটের সরকারের মেয়াদকালে মিথ্যা, বানোয়াট, আজগুবি, হাস্যকর অভিযোগের একের পর এক মামলা হয়েছে তরিকুল ভাইয়ের বিরুদ্ধে। এবারও অফার ছিল আপোসের। অফার ছিল বিএনপি ত্যাগের। অফার ছিল মিথ্যা স্বাক্ষ্য প্রদানের। কিন্ত- সমুদ্রে যার শয্যা পাতা, শিশির তাকে কতোটুকু ভেজাতে পারে?
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলামের সাংগঠনিক সুদৃঢ় অবস্থান শুধু দক্ষিণবঙ্গেই নয়, বিস্তার ঘটেছিল খোদ রাজধানীর কেন্দ্রবিন্দুতেও। নব্য ফ্যাসিবাদী শাসকের বিরুদ্ধে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট আয়োজিত একাধিক মহাসমাবেশ সফল করার গুরু দায়িত্ব তার ওপর বর্তিয়েছিলেন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। এবং অসামান্য সাংগঠনিক দক্ষতার সাথে সবাইকে সমন্বয় করে, সবাইকে একত্রিত করে, সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে সবকটি সমাবেশ তিনি সফল করেছেন।
বিভাগীয় সদর খুলনায় দেশনেত্রীর লংমার্চের প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে কর্মসূচির বহু আগে এসেই এ শহরে ঘাঁটি গেড়েছেন তিনি। একদিকে বর্ষিয়ান এম নুরুল ইসলাম দাদু ভাই, তার পাশে তরিকুল ইসলাম। উজ্জীবিত কর্মীরা শাসক দল ও পুলিশ প্রশাসনের বাঁধার পাহাড় ডিঙ্গিয়ে সফল করেছে সমস্ত আয়োজন। কখনো ধমকাচ্ছেন, গালিও দিচ্ছেন। পরক্ষণেই হাসছেন, কৌতুক করছেন। কাজ ভালো হলে কাছে টেনে পিঠ চাপড়ে দিচ্ছেন। দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। গভীর মনোযোগে কর্মীর কথা শুনছেন। আবার নিজের সুচিন্তিত মতামত প্রদান করছেন। এমন একজন অভিভাবকের ছত্রছায়ায় নিজেদেরকে সবচেয়ে নিরাপদ মনে করছেন কর্মীরা। ’
সংক্ষিপ্ত পরিসরে তরিকুল ইসলাম চাচাকে নিয়ে লেখার ইচ্ছা ছিল। কলেবর এতোখানি বেড়ে যাবে ভাবিনি। পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটানো সমীচিন নয়। কিন্ত শেষ একটা কথা না বললে লেখাটাই অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। ২০১৩ সালের এপ্রিলে রাষ্ট্র ক্ষমতাদখলকারী সরকার গায়ের জোরে দৈনিক আমার দেশ বন্ধ করে দিলে কার্যত বেকার হয়ে পড়ি। পুরোপুরি রাজনীতিতে ঝুঁকে পড়ার সুবাদে সাংগঠনিক কাজে বেশ কবার তরিকুল চাচার বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ হয়। খুলনা জেলা বিএনপির সভাপতি এস এম শফিকুল আলম মনা ভাই এবং বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির অন্যতম সদস্য লন্ডন প্রবাসী (কোভিডে আক্রান্ত হয়ে গত নভেম্বরে ইন্তেকাল করেছেন) ড. মামুন রহমান ভাইয়ের সাথে। কি যে ¯েœহ আর ভালোবাসা নিয়ে কথা বলতেন, যা ভোলার নয়।
এই সময়কালে অনেক বার চাচা খুলনায় এসেছেন। বেগম খালেদা জিয়ার রোড মার্চ, বিএনপির বিভাগীয় মহাসমাবেশ, প্রতিনিধি সভা উপলক্ষে। তবে প্রতি বছর পবিত্র মাহে রমজানে জেলা অথবা মহানগর বিএনপির ইফতারে তাকে প্রায়ই পেতাম, যদি না শরীর খুব বেশি অসুস্থ থাকতো। বিএনপি কর্মীরা মনেপ্রাণে চাইতেন তরিকুল চাচা সুস্থ থাকুক, তাকে যেন আমাদের মাঝে পাই। কারণ পদ্মার এপাড়ে স্থায়ী কমিটির সদস্য বলতে তিনিই আমাদের আপনজন।
তো তরিকুল চাচা খুলনায় এলেই সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে থাকা অনেক কর্মীর মতো আমাকেও আমাদের নেতা পরিচয় করিয়ে দিতেন। বলতেন, বিএনপির প্রেস রিলিজগুলো ওই করে। মেইল পাঠায় সব পত্রিকায়। ওর লেখা ভালো। বড় কাগজে কাজ করতো। সরকার পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়ায় বেকার হয়ে পড়েছে। বেশ কষ্ট ও চাপের ভেতরে আছে। দলের জন্য অত্যন্ত নিবেদিত।
চুপচাপ শুনতেন তরিকুল চাচা। তাকিয়ে থাকতেন দেয়ালের দিকে। নেতার কথা শেষ হলে মুখ খুলতেন। শাওনকে আমি চিনি। ওকে আর কতোবার আমাকে চেনাবি? একটা ছেলেকে দলের স্বার্থে খুব তো ব্যবহার করছিস। ওর পরিবার আছে, সংসার আছে, অসুখ বিসুখ আছে, বাজার সদাই আছে। চাকরি হারানো একটা ছেলে শুধুমাত্র দলীয় আদর্শের কারণে অন্য কোথাও চাকরি করতে যাচ্ছেনা। তাহলে ওর সংসার কিভাবে চলছে সেই খবর কখনো নিয়েছিস?
সমস্ত রুমে তখন পিনপতন নিরবতা। বরফ গলানোর দায় তখন আমার। দ্রুত বলে উঠি, জি চাচা, দল আমাকে টেক কেয়ার করে। বলি, কিন্ত গলায় জোর পাইনা। চাচা ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বলে ওঠেন, তোর কি খেয়াল রাখে তা আমি জানি!
বক্তৃতার মঞ্চে দাঁড়িয়ে বহুবার একটা কথা আমি উচ্চারণ করেছি- সাংবাদিকতা আমার পেশা, রাজনীতি আমার নেশা। দীর্ঘ ৭ বছর সেই পেশা থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসনে ছিলাম। হয়ে পড়েছিলাম পরিচয়হীন, শেকড় উপড়ানো বৃক্ষ। তরিকুল চাচার চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকীর মাস তিনেক আগে তার প্রাণের প্রতিষ্ঠান দৈনিক লোকসমাজ আমাকে সাংবাদিক পরিচয় ফিরিয়ে দিয়েছে। দূরারোগ্য পারকিনসন রোগে আক্রান্ত আমার আম্মা সকাল বেলা নামাজ কালাম, দোয়া দরুদ পাঠ শেষ করেই খোঁজ নেয় লোকসমাজ এসেছে কিনা। হাতে পেলে আগে তন্নতন্ন করে খোঁেজন, তার ছেলের নামে কোন রিপোর্ট ছাপা হয়েছে কিনা? ছাপার অক্ষরে ছেলের নাম পেলে বুক চেরা এক দীর্ঘশ^াস ফেলে উচ্চারণ করেন, আলহামদুলিল্লাহ। তার ছেলে ফুরিয়ে যায়নি, তার ছেলে হারিয়ে যায়নি। আমার মায়ের মতো অসংখ্য মায়ের, অজ¯্র বাবার, লাখো কর্মী সন্তানের প্রতিদিনকার দোয়ায় আপনার নাম উচ্চারিত হয়। কারবালার শেষ ঠিকানায় মাটির কোলে শুয়ে আপনি কি আমাদের এই অকৃত্রিম ভালোবাসা অনূভব করেন ?