হুন্ডি এবং প্রবাসীরা চাকরি হারানোয় রেমিট্যান্স কমেছে

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দেশে রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমে যাওয়ার হার উদ্বেগজনক। বিশেষজ্ঞরা এর পেছনে কারণ হিসেবে মহামারির বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ার পর অর্থ লেনদেনের অবৈধ চ্যানেলগুলো চালু হওয়া, নতুন বৈদেশিক নিয়োগ কমে যাওয়া এবং প্রবাসীদের চাকরি হারানোর মতো বিষয়গুলোকে চিহ্নিত করেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে দেশে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে প্রায় ৫ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার এসেছে। গত বছর একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৬ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংক এবং জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়া, এই তিন দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে। এ বছর এই তিন দেশ থেকে উল্লিখিত তিন মাসে গত বছরের চেয়ে ৯৩২ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার কম এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য থেকে আরও জানা গেছে, বাংলাদেশ ২০২১-২০২২ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে গত অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকের চেয়ে ৭৭১ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার কম রেমিট্যান্স পেয়েছে।
মহামারিতে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ধস নামলেও দেশে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছিল। প্রবাসীরা দেশে ২৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়ে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে, যা অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান জানান, মহামারির মধ্যে রেমিট্যান্সের বৃদ্ধি অনেককেই বিস্মিত করেছিল।
তিনি জানান, ‘এক্ষেত্রে যা হয়েছে, তা হলো, সব ধরনের অর্থ আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে আসছিল। যাতায়াতের বিধিনিষেধ ও বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি কার্যত বন্ধ থাকার কারণে হুন্ডির মতো অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলগুলো তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছিল না।’
কিন্তু এই অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলগুলো বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ার পর আবারো চালু হয়েছে। ‘ফলে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্স কমে যাচ্ছে’, বলেন সেলিম।
তিনি যোগ করেন, গত এক বছরে অনেক কর্মী বিদেশে যেতে পারেনি এবং এটি রেমিট্যান্সের ওপর একটি ‘সমষ্টিগত প্রভাব’ ফেলেছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান জানান, অনেক প্রবাসী তাদের সঞ্চয় দেশে পাঠিয়েছেন অথবা সঙ্গে করে নিয়ে দেশে ফিরেছেন, কিন্তু এটি একটি এককালীন ঘটনা।
এছাড়াও, এখন প্রবাসীদের জন্য চাকরির সুযোগ আগের তুলনায় কমে যাওয়ার কথা জানান তিনি।
২০২০ সালে বিদেশে চাকরি করছেন এরকম নতুন কর্মীর সংখ্যা ছিল ২ লাখ ১৭ হাজার। ২০১৯ সালে এই সংখ্যা ৭ লাখ ছিল বলে জানিয়েছে বিএমইটি।
রেমিট্যান্স উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে
২০২০ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশি প্রবাসীরা মালয়েশিয়া থেকে ৬০৭ দশমিক ২৪ মিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছিলেন। এই পরিমাণ কমে এ বছর ২৯০ দশমিক ৮৫ মিলিয়ন হয়েছে, অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় এ বছরের রেমিট্যান্স ৩১৬ দশমিক ৩৯ ডলার কম।
সৌদি আরব থেকে গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসে। এ বছর, একই সময় ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে গত বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে ৭৫২ দশমিক ৪৭ মিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। এ বছরের পরিমাণ ৪৪৬ দশমিক ১৭ মিলিয়ন।
যুক্তরাজ্য ও কুয়েত থেকে আগের বছরের তুলনায় রেমিট্যান্স যথাক্রমে ৬৪ দশমিক ১৮ মিলিয়ন ও ২৪ দশমিক ৩৩ মিলিয়ন ডলার কমে গেছে।
শরীফুল ইসলাম কুয়ালালামপুরে মোবাইল ফোনের আনুষঙ্গিক পণ্য বিক্রি করেন। তিনি ৪ অক্টোবর একটি ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে ১০০ রিঙ্গিত পাঠিয়েছেন বলে জানান।
তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে ফোনে জানান, ‘আমাকে সার্ভিস চার্জ হিসেবে ৫ রিঙ্গিত খরচ করতে হয়েছে এবং বিনিময় মূল্য ছিলো ২০ দশমিক ৩৫ টাকা।’ তিনি যোগ করেন, ‘হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠালে প্রতি রিঙ্গিতে কম পক্ষে ১ টাকা বেশি পাওয়া যায়। তারা কোনো সার্ভিস চার্জও নেয় না।’
জুলাই ২০১৯ থেকে সরকার বিদেশ থেকে পাঠানো টাকার ওপর ২ শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান অগ্রণী ব্যাংক অতিরিক্ত আরও ১ শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছিল, কিন্তু তারা এ বছরের সেপ্টেম্বরে এই সেবা বন্ধ করে দেয়।
শরীফুল জানান, অগ্রণী ব্যাংক যখন বাড়তি প্রণোদনা দিচ্ছিল, তখন অনেক বাংলাদেশি কর্মী এই ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠাতেন।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাস আল খায়মার বাসিন্দা এক বাংলাদেশি ব্যবসায়ী জানান, সেখানে থাকেন এরকম অনেক বাংলাদেশি মানুষ চাকরি হারাচ্ছেন এবং দেশে কিছুই পাঠাতে পারছেন না।
উদ্বেগের কারণ
অধ্যাপক সেলিম বলেন, ‘আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে আসা রেমিট্যান্স কমে যাওয়াতে সরকারের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ এবং বিনিময় মূল্যের ওপর চাপ পড়বে। যেহেতু সরকারের জন্য রেমিট্যান্স খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।’
অধ্যাপক মোস্তাফিজুর জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিরীক্ষণ প্রক্রিয়াকে আরও শক্তিশালী করতে হবে যাতে অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে টাকা পাঠানো নিরুৎসাহিত হয়।
এছাড়াও, সরকারের উচিত বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় মূল্য স্থিতিশীল রাখা, যোগ করেন তিনি।
অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম জানান, রেমিট্যান্স সাময়িক ভাবে কমে গেছে। এ পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হবে না।
তিনি জানান, সরকার রেমিট্যান্সের ওপর ৩ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করছে।
তিনি যোগ করেন, অগ্রণী ব্যাংক সিঙ্গাপুর থেকে টাকা পাঠানোর জন্য একটি অ্যাপ ভিত্তিক সেবা চালু করেছে।
৬ অক্টোবর অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানান, তিনি আশাবাদী যে তিন মাসের মধ্যে রেমিট্যান্স প্রবাহ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে, কারণ মহামারির সময় যেসব বাংলাদেশি নাগরিক দেশে ফিরে এসেছিলেন, তারা এখন ফিরতে শুরু করেছেন।