স্বর্ণ চোরাচালানের হোতারা অধরা

0

॥শুভ্র দেব॥
কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছে না স্বর্ণ চোরাচালান। শুল্ক গোয়েন্দাদের কড়া নজরদারির মধ্যে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আসছে স্বর্ণ। বাংলাদেশকে ট্রানজিট রুট হিসাবে ব্যবহার করে চালান চলে যাচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে। আবার কিছু কিছু চালান নিয়ে রমরমা বাণিজ্য করছেন কিছু অসাধু স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা। শুল্ক গোয়েন্দারা মাঝেমধ্যে চোরাচালানের স্বর্ণ জব্দ করছেন। বাহকদের তুলে দিচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে। মামলা হচ্ছে, তদন্ত হচ্ছে। কিন্তু চোরাচালানের মূলহোতারা অধরাই থেকে যাচ্ছে।
বলা হয় দেশে চোরাচালানের যত স্বর্ণ আসে তার প্রায় শতভাগই দুবাই ও সিঙ্গাপুর থেকে আসে। অথচ ওই দুই দেশ থেকে কারা চালান পাঠাচ্ছে আবার দেশে এই চালানের মূল রিসিভার কে তার হদিস মিলছে না। মূলহোতাদের ধরতে না পারার কারণে দিন দিন স্বর্ণ চোরাচালান বাড়ছে। শুল্ক গোয়েন্দাদের শত চেষ্টাতে এটি বন্ধ করা যাচ্ছে না।
গত রোববার রাতে দুবাই থেকে চট্টগ্রাম হয়ে ঢাকায় আসা বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট নং-বিজি-৪১৪৮ থেকে ১২ কেজি স্বর্ণ জব্দ করেছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। এই স্বর্ণের আনুমানিক বাজার দর ৮ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসা এয়ারক্রাফটের কার্গো হোলের মাঝখানের প্রবেশদ্বারের বামদিকের ফ্লোরে ছাই রংয়ের তিনটি কাপড়ের বেল্টের ভেতরে অভিনব উপায়ে কালো স্কচটেপে মোড়ানো তিনটি প্যাকেটে স্বর্ণের বারগুলো রাখা ছিল। কাস্টমস গোয়েন্দারা বলছেন, স্বর্ণবারগুলো অবৈধভাবে সরকারি শুল্ক ফাঁকি দিয়ে চোরাচালানের উদ্দেশ্য দেশে আনা হয়েছে। এগুলো পরবর্তীতে যেকোনো পথে বাহিরে পাচারের আশঙ্কা ছিল। জব্দ করা বারগুলো বাহক চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে নামানোর কথা ছিল। কিন্তু সুযোগ না পেয়ে নিয়ে আসে ঢাকায়। তবে এ ঘটনায় গোয়েন্দারা কাউকে আটক করতে পারেননি। এর আগে গত ৯ই সেপ্টেম্বর শাহজালাল বিমানবন্দরে সিভিল এভিয়েশনের নিরাপত্তাকর্মী বেলাল উদ্দিনকে সাড়ে নয় কেজি স্বর্ণসহ আটক করা হয়। তার তিনদিন আগে বাংলাদেশ বিমানের ইএ-৪০৪৮ এর টয়লেট থেকে প্রায় ১৪ কেজি স্বর্ণ জব্দ করা হয়।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত আড়াই বছরে প্রায় ৩৯৪ কেজি ৮০৪ গ্রাম স্বর্ণ জব্দ করা হয়েছে। এরমধ্যে ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে এখন পর্যন্ত জব্দ করা হয়েছে ৬৬ কেজি ৯৬৪ গ্রাম। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে করা হয়েছে ১৭৪ কেজি ৪৯ গ্রাম। এবং ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে করা হয়েছে ১৮০ কেজি ৩৫ গ্রাম। চলতি মাসেই ৩ কেজি স্বর্ণ জব্দ করা হয়েছে। শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আসা এসব স্বর্ণ সিঙ্গাপুর ও দুবাই থেকে আসা বিমান হয়ে এসেছে। বাহকরা জানিয়েছে, তারা টাকার বিনিময়ে স্বর্ণ বহন করেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট তাদের কাছ থেকে চালানের হোতাদের বিষয়ে তেমন তথ্য পায়নি।
শুল্ক গোয়েন্দারা বলছেন, কড়া নজরদারি করেও চোরাচালান বন্ধ করা যাচ্ছে না। কারণ চোরাকারবারিরা চালান ধরা পড়ার আশঙ্কায় তাদের কৌশল পাল্টিয়েছে। আগে একজন কারবারি একাই কয়েক কেজি স্বর্ণ পাচার করতো। কিন্তু কাস্টমস গোয়েন্দাদের কাছে ধরা পড়ে লোকসানের স্বীকার হয়েছে বহুবার। এখন কৌশল পাল্টে অনেক কারবারি মিলে একটি চালান পাঠায়। এতে করে ধরা পড়লেও লোকসানের ভাগিদার সবাই হয়। এর বাইরে তারা আরও একটি নতুন কৌশল বের করেছে। দুবাই ও সিঙ্গাপুর থেকে দেশে আসা যাত্রীদের কাছে স্বর্ণের বার দিয়ে দেয়। বিনিময়ে এসব যাত্রীদের তারা কিছু টাকাও দিয়ে দেয়। বিমানের ৫০ জন যাত্রীকে ম্যানেজ করতে পারলে ১টি করে প্রায় ৫০টি বার নিয়ে আসা সম্ভব। এতে করে কারবারিদের ধরাপড়ার সম্ভাবনা নেই।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, দেশে প্রতিবছর ২৬ টন স্বর্ণের চাহিদা রয়েছে। অথচ গত বছর মাত্র ১০ কেজি স্বর্ণ আমদানি হয়েছে। চাহিদা মেটানোর জন্য বাকি স্বর্ণগুলো অবৈধভাবে এসেছে। স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা শুল্ক গোয়েন্দাদের জানিয়েছেন, ভ্যাট বেশি হওয়ার কারণে তারা আমদানিতে আগ্রহ পান না। ভ্যাট কমালে ব্যবসায়ীরা সহজে আমদানি করতে পারবে এবং স্বর্ণের দাম ক্রেতাদের ক্রয় ক্ষমতার ভেতরে থাকবে। কিন্তু ভ্যাট কমানোর বিষয়ে নারাজ শুল্ক গোয়েন্দা কর্র্তৃপক্ষ। দেশের উন্নয়নের স্বার্থে ভ্যাট বাড়ানো ছাড়া কমানোর সুযোগ নাই বলে গোয়েন্দারা জানিয়েছেন। শুল্ক গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, স্বর্ণের ওপর মাত্র ৫ শতাংশ ভ্যাট ধরা হয়েছে। অথচ আমদানি করা ওষুধের ওপর ১৭ দশমিক ২৪ শতাংশ ভ্যাট দেয়া হয়। কাপড় কেনা থেকে শুরু করে রেস্টুরেন্টে খাবার খেলেও ভ্যাট দিতে হয়। কিন্তু স্বর্ণে ভ্যাট দিতে চায় না কেউ। ভ্যাটের জন্য অনেকে আমদানি করে না।
গোয়েন্দাসূত্র জানিয়েছে, স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে দেশি- বিদেশি সিন্ডিকেট জড়িত। স্লিপার সেলের আদলে স্বর্ণ চোরাচালান করা হয়। বাহকরা নিজেও জানে না স্বর্ণের মূল প্রেরক ও রিসিভার কে। অনেক মাদক ব্যবসায়ী ও অস্ত্র ব্যবসায়ীরাও স্বর্ণ চোরাচালান করেন। মূলহোতারা খুব সুকৌশলে কাজটি সম্পন্ন করেন। বিমানবন্দরের পরিচ্ছন্নতাকর্মী থেকে শুরু করে, নিরাপত্তাকর্মী, বিমানবন্দর, ফ্লাইট ও বিমান সংশ্লিষ্টরাও চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত বলে বিভিন্ন তদন্তে উঠে এসেছে। বিভিন্ন সময় অনেককে আটক করে আইনের আওতায় নিয়ে এসেছেন শুল্ক গোয়েন্দারা।
একাধিকসূত্র নিশ্চিত করেছে, চাহিদা বেশি থাকায় দেদারছে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে স্বর্ণ আনা হচ্ছে। বৈধভাবে আমদানি করতে বৈধ টাকার প্রয়োজন। শুল্ক ছাড়াও আরও কিছু খরচ রয়েছে। এ ছাড়া অনেক নিয়ম কানুনও রয়েছে। আমদানি করা স্বর্ণ ও আমদানিকারকদের নজরদারিতে রাখা হয়। সেই স্বর্ণ কোথায় যাচ্ছে কার কাছে বিক্রি করা হয় তার হিসাব রাখেন গোয়েন্দারা। ঝক্কি-ঝামেলা বেশি হওয়াতে কারবারিরা বিকল্প উপায় খুঁজে নেন। শুধুমাত্র দেশের চাহিদা মেটানোর জন্য চোরাচালান করা হয় না। অনেক সময় অনেক চালান বাংলাদেশ হয়ে অন্য দেশে চলে যায়। দেশের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে প্রায়ই চালান আটক করা হয়। যেগুলোর গন্তব্য দেশের বাহিরে থাকে।
গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, দেশে-বিদেশে অন্তত অর্ধশতাধিক গডফাদার চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। কিছু স্বর্ণ ব্যবসায়ীও জড়িত আছেন। এসব গডফাদারদের শনাক্ত ও পরিচয় বের করা হয়েছে। কিন্তু উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ ও অনেক গডফাদার দেশের বাহিরে থাকার কারণে তাদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না। অবৈধভাবে স্বর্ণের টাকা দিয়ে অস্ত্র ও মাদক কেনা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দারা। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. আব্দুর রউফ বলেন, দেশে আসা স্বর্ণের ৯৮ ভাগই আসে যাত্রীদের মাধ্যমে। দুবাই ও সিঙ্গাপুর থেকে আসা যাত্রীদের মাধ্যমেই স্বর্ণ বহন করানো হয়। দেশে আসার সময় যাত্রীদের ম্যানেজ করে তাদের কাছে স্বর্ণের বার ধরিয়ে দেয়া হয়?। এ সময় তাদের কিছু টাকা দেয়া হয়। আমদানি করে খরচ বেশি হওয়াতে কারবারিরা এইভাবে স্বর্ণ এনে বেশি লাভবান হয়। স্বর্ণ আমদানিতে ভ্যাট বেশি হয় বলে ব্যবসায়ীরা বৈধভাবে স্বর্ণ আমদানি করেন না। চোরাচালানের মাধ্যমে এনে ধরা খেয়ে অনেকে কোটি কোটি টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিনি বলেন, চোরাচালানের মাধ্যমে আসা স্বর্ণের টাকা বিনিয়োগ করা হয় বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। অস্ত্র ও মাদকের পেছনে এই টাকা বিনিয়োগ হয়। এই চোরাচালানের পেছনে নানা অপরাধ জড়িত। অনেক চালানের স্বর্ণ বাংলাদেশ থেকে সীমান্ত পার হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে চলে যাচ্ছে। তবে স্বর্ণ চোরাচালানের মূলহোতা কারা এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি এই কর্মকর্তা।