যশোর শিক্ষা বোর্ডে বিশৃঙ্খলা, আরও সময় পেল তদন্ত কমিটি

0

স্টাফ রিপোর্টার ॥ যশোর শিক্ষাবোর্ডে চেক জালিয়াতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় দুদকের মামলা দায়েরের এক সপ্তাহ পর গতকাল প্রথম অফিস করেছেন অভিযুক্ত চেয়ারম্যান। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি পক্ষ গেটের বাইরে এসে অভ্যর্থনা জানিয়ে তাকে ভেতরে নিয়ে যান। অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটির রিপোর্ট জমার পর অভিযুক্ত ঊর্ধ্বতন ২ জন কর্মকর্তা দায় এড়ানোর সুযোগ পাবেন বলে একটি পক্ষের দাবি। এদিকে চেক জালিয়াতির ও তদন্তকারী ঘটনায় বোর্ডে একপ্রকার বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে বিভাজন সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। একপক্ষ আর একপক্ষকে দুষছেন। এ প্রেক্ষিতে পুরো মামলার মোড় ভিন্ন খাতে যেতে পারে বলে সংশ্লিষ্টদের আশংকা।
গত ৭ অক্টোবর যশোর শিক্ষাবোর্ডে আড়াই কোটি টাকার চেক জালিয়াতি ধরা পড়ে। এ ঘটনায় শিক্ষাবোর্ডের পক্ষ থেকে কলেজ পরিদর্শন কেএম গোলাম রব্বানিকে প্রধান করে অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। ৫ সদস্যের এ কমিটিকে ৭ কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়। শুরু থেকেই এই কমিটি নিয়ে অনেকেই দাবি করেন, চেয়ারম্যান চেয়ারে থাকা অবস্থায় কমিটি সঠিক রিপোর্ট দিতে পারবে না। কারণ হিসেবে তাদের দাবি, বোর্ডে চাকরি করে সরাসরি কেউ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে কোন কিছু বলার বা লেখার ক্ষমতা রাখে না। তাছাড়া কমিটির সদস্যরা প্রায় সকলেই চেয়ারম্যানপন্থী। ইতোমধ্যে দুদকের পক্ষ থেকে মামলা হলে অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি আরো ৩টি কার্যদিবস সময় চেয়ে আবেদন জানায়। গতকাল সে সময় অতিক্রান্ত হয়। নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই শিক্ষাবোর্ড কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটিকে আরো ৭ কার্যদিবস সময় বৃদ্ধি করেছে।
এ বিষয়ে তদন্ত কমিটির প্রধান কেএম গোলাম রব্বানি জানান, নতুন করে আরো ১৬টি চেক ও এর আগে ১১ অক্টোবরের ১টি চেক জালিয়াতি ধরা পড়ার পর এই সময় বৃদ্ধি করা হয়েছে। বোর্ড কর্তৃপক্ষ চায় সব বিষয় এবং সব চেক সঠিকভাবে তদন্ত করা হোক। তাই এই সময় বৃদ্ধি।
তদন্ত কমিটির প্রতি আস্থাহীনতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কমিটি কারো প্রতি দু’র্বলতা বা কাউকে দায়মুক্তি দেয়ার জন্যে কাজ করছে না। এদিকে বেশ কয়েকদিন ছুটি ও অন্যান্য কারণে অফিসে উপস্থিত হননি বোর্ড চেয়ারম্যান। মূলত: যশোরের দুদকের পক্ষ থেকে ১৮ অক্টোবর মামলা করা হলে সেই রাত থেকেই বোর্ড চেয়ারম্যান ও সচিব আকস্মিক ছুটিতে যান। দুজনই তাদের ফাইল নোটে পৃথক পৃথকভাবে ছুটির কথা লেখেন। ছুটি কাটিয়ে চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মোল্লা আমীর হোসেন গতকাল অফিসে আসেন। এদিকে তার আসার খবরে আগে থেকেই ভবনের বাইরে অভ্যর্থনা জানাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশ। তারা একপ্রকার অভ্যর্থনা দিয়ে চেয়ারম্যানকে নিয়ে ভেতরে ঢোকেন। অভ্যর্থনা দলের নেতৃত্বে ছিলেন উপসহকারী প্রকৌশলী মো. কামাল হোসেন, সহকারী সচিব (প্রশাসন) মুজিবুল হক, ভারপ্রাপ্ত সেকশন অফিসার রাকিব হাসান।
এ বিষয়ে মুজিবুল হক জানান, ঠিক সংবর্ধনা নয়, স্যার এসেছেন, ভালো ভালো কাজ করছেন, তাকে আনতে সামনে গিয়েছিলাম। তিনি আরো জানান, আমরা তাকে বলেছি এই দুর্নীতির সাথে যারা জড়িত তাদেরকে শাস্তি দিতে হবে।
এদিকে শিক্ষাবোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সুস্পষ্ট দু’টি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। এক পক্ষ দুর্নীতিবাজ এবং দুর্নীতির আশ্রয়দাতা হিসেবে চেয়ারম্যানের অপসারণ চাচ্ছেন। অন্য পক্ষ তাকে দুর্নীতি উৎখাতে উদ্যোক্তা হিসেবে অভিনন্দিত করছেন। এই পক্ষ চেক জালিয়াতির সকল দায়-দায়িত্ব প্রথমত হিসাব সহকারী আব্দুস সালামের ওপর এবং ঠিকমতো অডিট না করায় উপপরিচালক (হিসাব ও নীরিক্ষা)সহ অডিট বিভাগের ওপর চাপাচ্ছেন। তাদের মতে যারা আব্দুস সালামের বিচার চায় না, তারাই চেয়ারম্যান সচিবকে দায়ী করছেন।
তবে অন্য পক্ষে থাকা সিবিএ সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান বাবলু বলেন, আমরা কারো বিপক্ষে নই, আমরা দুর্নীতির বিপক্ষে। এ খাতে যার যার নাম এসেছে সবাইকে আইনের ও বিচারের আওতায় আনা হোক। বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের চাকরি সাময়িক স্থগিত করা হোক। এ বিষয়ে বোর্ড চেয়ারম্যান ড মোল্লা আমীর হোসেন বলেন, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সব সময় দুটি পক্ষে থাকেন। সিবিএ নির্বাচনে দুইটি পক্ষ হয়ে ভোট করে। এ জাতীয় বিভাজন কাজের ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলবে না।
প্রসঙ্গক্রমে আগামী মাসের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি ও কার্যক্রমে কোনো প্রভাব পড়বে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মাধবচন্দ্র রুদ্রের সাথে সহমত প্রকাশ করেন। তারা বলেন, পরীক্ষার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। খাতা বণ্টন চলছে, অন্যান্য কাজও শেষ হয়েছে।
এত বড় বড় জালিয়াতি নিয়ে বোর্ড চেয়ারম্যান একাধিকবার উপপরিচালক (হিসাব ও নীরিক্ষা) এবং অডিটরকে দায়ী করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, বছরের পর বছর যে অডিট রিপোর্ট হয়েছে সেখানে এতদিন এসব দুর্নীতি ধরা পড়ে কেন? একই প্রশ্ন চেয়ারম্যান পক্ষীয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। তারা এ বিষয়ে সালামকে সর্বত্রভাবে দায়ী করেন। অভিযোগের বিষয়ে বোর্ডের উপপরিচালক (হিসাব ও নীরিক্ষা) এমদাদুল হক এবং অডিটর আব্দুস সালাম আজাদ জানান, প্রতিটি কাজের একটি ধাপ ও চেইন থাকে। আমাদের এই শাখায় যে কোনো বিল পরিশোধের পর শাখা সহকারী মুড়ি বইয়ের সাথে সেটি মিল করে নোট দেন। যে সময় জালিয়াতি হয়েছে সে সময়ে আব্দুস সালাম এই শাখায় ওই দায়িত্বই পালন করতো। সে কখনোই কোনো সমস্যা জানায়নি, সর্বদাই সঠিক দেখিয়েছে। তারা জোর দিয়ে বলেন, সালাম নিজে যেহেতু ওই চক্রটির সাথে জড়িত ফলে কখনোই ধরা পড়েনি। তাদের দাবি, ছাড়ানো চেকে স্বাক্ষর তারিখ ঠিক রেখে টাকার অঙ্ক পাল্টানো যেতে পারে এটা কল্পনাও ছিল না।
এ প্রসঙ্গে উপর্যুক্ত ওই দুই কর্মকর্তাসহ শিক্ষাবোর্ডের কয়েকজন জানান, যে চেকগুলোতে জালিয়াতি হয়েছে, সে চেকের স্বাক্ষর চেয়ারম্যান সচিবের ঠিকই রয়েছে। তবে যে কোনো ভাবে আগের টাকার অংক মুছে অথবা অন্য কোনো উপায়ে সরিয়ে নতুনভাবে একই স্থানে টাকার নতুন অংক বসানো হয়েছে। দুটি পৃথক চেকে টাকার অংক লেখার ধর ও ছাপার অক্ষর দেখিয়ে তারা দাবি করেন। সম্ভবত চেক টেম্পারিং ‘কীভাবে’ এটা সম্ভব তার ব্যাখ্যা তারা দিতে পারেননি। এ প্রসঙ্গে অভ্যন্তীণ তদন্ত কমিটির প্রধান কেএম রব্বানীও চেকে শুধু টাকার অংক লেখার ধরন ভিন্ন পেয়েছেন বলে স্বীকার করেন। এ বিষয়ে যশোর দুর্নীতি দমন কমিশনের উপপরিচালক মো. নাজমুচ্ছায়াদাত বলেন, তাদের তদন্ত ও অনুসন্ধান শেষ হয়নি। পুঙ্খানু পঙ্খানুভাবে প্রতিটি বিষয়ে খতিয়ে দেখা হবে। কাউকে আটকানো বা কাউকে মুক্তি দেয়া তাদের কাজ নয়। সঠিক অনুসন্ধানে প্রকৃত দুর্নীতিবাজকে আইন ও বিচারের আওতায় আনাই তাদের লক্ষ্য। এ লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজনে আটক বা এ জাতীয় কাজ হতে পারে। তিনি আরো জানান, চেয়ারম্যান সচিব স্বপদে থাকবেন কিনা তা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত মামলা হালে দুদক হেড অফিসের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়। তারা সিদ্ধান্ত নেবে কে দায়িত্বে থাকবেন বা থাকবেন না।