আফগানিস্তানের আগামী

0

গৌতম দাস
চলতি অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে আমেরিকান উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়েন্ডি শেরমান ভারত সফরে এসেছিলেন। দুই দিনের সফরে তিনি প্রকাশ করেননি, তিনি ফেরার সময় আর কোথায় যাবেন; যদিও ধরে নেয়া হয়েছিল তিনি ভারতে এসেছেন, আফগান-তালেবান ইস্যুতে বেদিশা হয়ে থাকা ভারতকে দিশা ও রাস্তা দেখাতে আসছেন। দিশা কতটা দেখাতে পারছেন, সেটি নিয়ে আমরা আজ কিছু কথা বলব। কিন্তু এর চেয়েও দিশা দেয়া ঘটনা ছিল শেরমানও বুঝে গেছেন যে, ভারত একটা দেখানো ফুটানিতে চলতে চায় এমন দেশ। ফলে শেরমান তার ভারত ছাড়ার আগে যখন প্রকাশ পেল তিনি পাকিস্তান হয়ে ফিরবেন (শুধু তা-ই নয়, তিনি আসলে পাকিস্তান সফর শেষে পরে তালেবানদের আফগানিস্তান হয়ে ফিরেছিলেন) তখন সেটি শুনে ভারতের ভান-ভণিতা আর ভারত খুবই উচ্চবংশীয় যেন, এই মিথ্যা ফুটানি প্রদর্শন তুঙ্গে উঠেছিল। তারা শেরমানকে অভিযুক্ত করেছিলেন যে তিনি ভারত-পাকিস্তানকে সমান পাল্লায় মাপছেন। মানে বলতে চেয়েছেন, পাকিস্তান ভারতের সমতুল্য নয়, বরং ভারত অনেক শুদ্ধ বা পবিত্র। কাজেই এতে ‘ভারত-পাকিস্তান’ এভাবে মাঝখানে হাইফেন দিয়ে লেখা (হাইফেনেটেড) শুরু হয়ে যাবে। এটি ভারতের জন্য ‘অপমানজনক’। শেরমান বুঝে যান তিনি কোনো ভয়ঙ্কর পেটি, নিচা কালচারের খপ্পরে পড়েছেন। উপায়ন্ত না পেয়ে তিনিও তেল ঢালা শুধু করেছিলেন। আর যে কথার আড়ালে যেটা বলে পার পেতে চেয়েছিলেন তা হলো- পাকিস্তানের সাথে আমি কোনো গভীর ভালোবাসায় জড়াতে যাচ্ছি না। আমার ‘খুবই সুনির্দিষ্ট আর ছোট্ট একটি কাজ’ আছে; তাই যেতে হচ্ছে। কোনো পুরুষ যখন তার এক প্রেমিকার কাছে ধরা পড়ে যায় তার অপর প্রেমিকার খবরসহ- সেই দশা। শেরমান নাকি তখন বলেছিলেন, ভারতের সাথে আমেরিকার যে সম্পর্ক সেই লেভেলের কোনো দিন পাকিস্তানের সাথে হবে না। কিন্তু সেটি কেউ ভালো করে না ছাপানোয় ভারত আবার সেটি নিজেই লন্ডন গার্ডিয়ান পত্রিকায় ছাপানোর ‘বন্দোবস্ত’ করেছিল। এ ঘটনা জেনে আমাদের মনে হতে পারে ভারত আসলেই খুবই উচ্চবংশীয় কালচারের দেশ! কিন্তু শেরমান পাকিস্তান থেকেও আমেরিকা ফেরেননি। গিয়েছিলেন আফগানিস্তানে এবং সরাসরি তালেবানের সাথে একই টেবিলে মুখোমুখি বসে মিটিং করে গেছেন। কিন্তু কেন আফগানিস্তানে আর তালেবানদের সাথে মিটিং? শুধু আমেরিকা কেন, বলতে গেলে কোনো রাষ্ট্রই এখনো যে তালেবান সরকারকে আনুষ্ঠনিক স্বীকৃতি দেয়নি। তবে এ কারণে তত দিনে ভারতের অসুবিধা হয়নি; কারণ ভারতের হিন্দুত্বপ্রেমী ভোটারদের দৃষ্টি-আগ্রহের বাইরে চলে গিয়েছিলেন শেরমান। আসলে মোদির নিজের তৈরি যে খাঁচা সেখানে তিনি নিজেকে বন্দী দেখাতে বাধ্য হন যে, তিনি বিদেশী ক‚টনৈতিক দেখা সাক্ষাৎ সম্পর্কগুলোর মধ্যেও ক্রমেই মুসলমান বা পাকিস্তান কোপানোর একমাত্র নেতা এবং সফল হিন্দুবাদী নেতা তিনি। আর এটি দেখিয়েই তিনি ভোটের বাক্স ভরিয়ে ক্ষমতাসীন আছেন। আর কাহিনী হলো, নয়নীমা বসু প্রমুখের মতো ক‚টনৈতিক সংবাদদাতাদেরও এই সেনসিটিভিটি দিকে খেয়াল রেখে তেমন শব্দ বেছে রিপোর্ট লিখতে হয়।
শেরমানের দেশ আমেরিকা স্বীকৃতি না দেয়া সত্ত্বেও তার আফগান সফর এবং ফ্লাইট-এয়ারপোর্ট ঠিকমতো ন্যূনতম থিতু হয়ে চালু না হওয়া সত্তে¡ও এক আমেরিকান মন্ত্রী হিসেবে তার আফগানিস্তান গিয়ে সরাসরি তালেবানের সাথে মিটিং বেশ উল্লেখযোগ্য ঘটনা বৈকি। আর এ ঘটনাটিকে তালেবানদের অনেকে আমেরিকার ওপর তাদের ‘বিজয়’ বলে দেখার আগ্রহ। এমনকি আমাদের দেশেও অনেকের। এমন আরো কথা হলো- তালেবান, ২০ বছর ধরে মার্জিনালাইজড বা চাপা পড়ে থাকা জনগোষ্ঠী বলে তাদের মনেও ক্ষোভ কম নয় এমন হওয়ারই কথা। হতে পারে তারা সেটি প্রকাশ করেছিল পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সংস্পর্শে কখনো আসার কালে, যা মোটেও অসম্ভব নয়; কারণ আমরা দেখেছি ইমরান খান তাদের মুখপাত্র হয়ে আমেরিকাকে একটু বকা দিতে গেয়েছিলেন। সিএনএনের সাথে ইন্টারভিউয়ে বলেছেন, এবারের তালেবান উত্থানে গত ২০ বছরের আমেরিকান চাপ-নির্যাতন থেকে আফগানরা মুক্তি পেয়েছে। আবার ইমরান একইভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন এই বলে যে, গত ২০ বছর আমেরিকা পাকিস্তানকে ‘ভাড়া করা অস্ত্রের মতো ব্যবহার’ করেছে। গত ১৫ আগস্টের পর ইমরানের এ ধরনের কথাগুলো আমেরিকার ভালো হজম হয়নি। কথাগুলোতে খানিকটা সত্যতা তো আছেই। ইমরান নিজের দেশের অভিজ্ঞতা হিসেবে দ্বিতীয় কথাটা বলতে পারতেন হয়তো, কিন্তু তালেবানদের জন্যও তাদের মুখপাত্র ও নেতা হতে চেয়ে আমেরিকাকে দায়ী করে কিছু বলা হয়তো আমেরিকানরা ‘একটু বেশি কথা’ হিসেবে দেখেছে। ফলে শেরমান সফরে ইমরানের সাথে সাক্ষাৎ করেননি; যদিও করবেনই এমন শিডিউল ছিল না। অন্য কিছু মূল কথা, আমেরিকান সেনা প্রত্যাহারের পর আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশের আর পাকিস্তানকে প্রয়োজন নেই বা ফুরিয়েছে- বাস্তবতা কিন্তু এর একেবারেই ধারেকাছেও নয়। বরং উল্টো আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশের পাকিস্তানকে এখন আরো বেশি দরকার। লন্ডন ইকোনমিস্ট সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সম্প্রতি এক আর্টিকেল ছেপেছে। আবার পাকিস্তানেরও আমেরিকাকে আর তেমন দরকার নেই, পরিস্থিতি সেটিও নয়। আজকের পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে আমেরিকা ছেড়ে অনেক বেশি চীন নির্ভরশীল হলেও এটি কোনো ‘আমেরিকা অপ্রয়োজনীয়’ ধরনের অবস্থা নয়। তাই মাঠের সাধারণ নাগরিকের ভাষায়, কোনো প্রধানমন্ত্রীর আমেরিকার সাথে বা নিয়ে কথা বলতে যাওয়ার কিছু ভুল তো এখানে আছেই। ব্যাপারটাকে সেভাবে দেখতে পারি আমরা। ভুল হওয়ার অন্য আরো যে বিশেষ কারণ, তা এখন বলব। প্রথমত, এবারের সেনা প্রত্যাহার করার পর বাইডেন প্রশাসনের কারো মানে শেরমানের এই পাকিস্তান সফর একেবারের ভিন্ন ও নয়া তাৎপর্যের। এক নয়া যুগের; কারণ আগের ২০ বছর আমেরিকা-পাকিস্তান সম্পর্ক ছিল এমন যে, আফগানিস্তানে হামলা চালাতে চায় তাই হামলার লঞ্চিং প্যাড হিসেবে আমেরিকার পাকিস্তানকে দরকার ও তাকে বাধ্য করা হবে- এই যে সম্পর্ক এত দিন থাকলেও এবারই প্রথম সেই শর্ত আর নেই। পাকিস্তানও এসব বাধ্যবাধকতা থেকে একেবারে মুক্ত। এই নতুন মুক্ত পরিস্থিতিতে শেরমান পাকিস্তান সফরে এসেছেন, তা থেকে সব পক্ষের দেখা উচিত। ফলে কথাবার্তা বা নতুন প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার সময় এ নিয়ে সব পুরনো রেফারেন্স বাদ দিয়ে এটি নয়া সম্পর্কের কাল হিসেবে কথা বলতে পারতে হয়েছে বা হবে উভয়পক্ষকে। কিন্তু সাবধান, এরই মধ্যে এক নয়া কমন পাকিস্তান-আমেরিকাসহ আরো অনেকের সাথে কমন এই ইস্যু সামনে। সেটি হলো- ১. তালেবান এখনো কোনো সরকার গঠন করতে পারেনি। ২. তারা এখনো এক আমিরের আফগানিস্তান নিয়ে আঁকড়ে পড়ে আছে। রাজা আর জনপ্রতিনিধির ফারাক বুঝতে চাইছে না। ফলে অবলীলায় রাজা বা আমিরের পক্ষে দাঁড়িয়ে যেতে পারছে। আমিরের দেশে আমিরই দেশের মালিক এখানে কোনো নাগরিক থাকে না, হুকুমের বান্দা থাকে। এখানে দেশ গড়ার কিছু থাকে না। আমিরের খেয়াল থাকে। ৩. জাতিসঙ্ঘসহ সারা পশ্চিম যেটা নিয়ে উদ্বিগ্ন, তা হলো- প্রায় ১০ লাখ শিশু না খেয়ে মরার মুখোমুখি, প্রায় ১৮ লাখ দুস্থ মানুষ যারা জাতিসঙ্ঘের মানবিক নানান ধরনের সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল প্রভৃতি। এসব মানবিক সাহায্য তালেবান সরকার স্বীকৃত নয় বলে আগের মতো সরবরাহ বজায় রাখতে তা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মানুষের ক্ষুধা এসব কী সমস্যা তা জানার যোগ্য থাকে না। পশ্চিম তাই আগেই স্বীকৃতির ইস্যু এড়িয়ে সরাসরি কথা বলতে এসেছে। আমেরিকা, ইইউ এরই মধ্যে বিনা স্বীকৃতিতেই কাবুল সফরে কথা বলেছে। একটি স্বীকৃত সরকার হতে করণীয় সম্পর্কে আলোচনা, পরামর্শ করেছে। কিন্তু এটিকে তাদের ঠেকা, তারাই বিপদে পড়েছে- এমন অনুমান নিয়ে ব্যাপারটাকে দেখা এক বিরাট ভুল ও আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের দিকে যাওয়া হবে। আসলে আমেরিকা, ইইউ যেটা আগবাড়িয়ে করছে, সেটা হলো নিজেদের দিক থেকে যা করণীয় কর্তব্য ছিল, তা পূরণ করে রাখছে; যাতে শেষ পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তহীনতায় যদি কিছু শিশু অভুক্ত মারা যায়; যাতে সে আগেই পরিষ্কার রাখতে পারে তাদের দায়ের অংশ ও উদ্যোগ তারা যথেষ্ট নিয়েছিল। কিন্তু তালেবানদের কারণে পুরোটাই ব্যর্থ হয়ে গেছে। এটি কখনই হয় না যে, দানগ্রহীতার আগ্রহ নেই আর মানুষ দাতাকে প্রধান দায়ী করবে।
৪. অতএব দাতারাই ঠেকায় পড়েছে আর তাদের সেই ঠেকে যাওয়া দশাকেই ব্যবহার করে চাপ দিয়ে তাদের স্বীকৃতি আদায় করে নিতে হবে- এটি খুবই আত্মঘাতী ও বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত হবে।
৫. এরপর যা লিখব সেগুলোই তালেবান ইস্যুর মূল প্রসঙ্গ। নয়া তালেবান এরা স্বীকৃত সরকার নয় বলেই এটি থিতু সরকার নয়, এ অনুমান ভুল, ভিত্তিহীন। এটি এখনো অস্থিতিশীল মূলত এর অভ্যন্তরীণ সংহতি খুবই দুর্বল। কথাটাকে যদি রেডিক্যাল আর লিবারেল ধারা হিসেবে বলি, তবে এ দুই ধারার বিরোধ প্রধান অ-সংহতি চিহ্ন। এখানেই শেষ নয়। তালেবানের ভেতরের এই বিরোধের বাইরের আরো চরম রেডিক্যাল (আইসিস-কে) ধারা আছে, যার ছাতার নিচে সমমনা আরো ছোট গ্রæপ আছে। এরা তালেবানদের ‘চরম অসহনীয় শত্রæ’ জ্ঞান করে।
৬. এরই মধ্যে আইসিস-কে গত আগস্টের দুই এয়ারপোর্ট হামলার পরে আর বসেনি। তাদের এখনকার টার্গেট মূলত হাজারা ট্রাইব বা এথনিক গোষ্ঠী, যারা শিয়া জনগোষ্ঠী। আর মোট আফগান জনসংখ্যার ৯ শতাংশ। প্রথম তিন গোষ্ঠী পশতুন (৪০-৫০ শতাংশ ), তাজিক (২৫ শতাংশ) আর হাজারা (৯ শতাংশ)। এ হামলা মূলত নির্মূল করা ধরনের। আপাতত যা তাদের মসজিদে হামলা টাইপের। অনেকে হাজারা মুসলমান কি না তর্ক সে দিকে নিতে পারেন। এটি ভুল পথ। এমন তর্ক ইসলামের ভেতরে। কিন্তু বাইরের পুরো দুনিয়া ব্যাপারটাকে দেখে কোনো এথনিক জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করা হিসেবে, বসনিয়ায় যা হয়েছে। দুনিয়াতে ১৯৪৫ সালের আগে এমন বহু এথনিক জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করে দেয়া গেছে। কিন্তু ১৯৪৫ সালের পরে দুনিয়া বদলে গেছে; কারণ এক ‘গ্লোবাল রাজনৈতিক ব্যবস্থা’ তৈরি হয়ে আছে। বিশেষত ২০০০ সালের পরে যে গ্লোবাল আইনিকাঠামো, আদালত ব্যবস্থা তৈরি হয়ে গেছে; তাতে যারাই কোনো এথনিক জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করতে যাবে, তো সে যে অজুহাতেই হোক তারা সহি মুসলমান ছিল না বলে অথবা অন্য কিছু, এরা প্রত্যেকেই এখন বিচারের সম্মুখীন হবে, সর্বোচ্চ সাজা পাবে। এসব হলো আফগানিস্তানের আরেক জগৎ। সেই জটিলতার একটু ইঙ্গিত দিলাম। আর এখানে এবার ভারতের অবস্থা নিয়ে একটি কথা বলে শেষ করব। অবশেষে ভারতের মিডিয়া জানাচ্ছে, আগামী মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আফগানিস্তানে স্বার্থসংশ্লিষ্ট দেশগুলোর ‘জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার’ দায়িত্বে আছেন এমন মর্যাদার মন্ত্রী-উপদেষ্টাদের নিয়ে এক সম্মেলন আহ্বান করতে যাচ্ছে ভারত। আর তাতে প্রধান দুই মেহমান পাকিস্তান ও চীন। তা হলে এত দিন মোদির হিন্দুত্ববাদ আর ভোটের স্বার্থে যে এ দুই দেশকে ভারতের চরম শত্রু বলে প্রপাগান্ডা চালানো হয়েছিল, এর কী হবে? যে চরমশত্রু দেশ সেই আবার দাওয়াতি-অতিথি হয় কী করে? ভারতের স্বার্থ অবশ্যই চীন-পাকিস্তানের স্বার্থের বিরোধী এবং এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে ‘চরমশত্রু দেশ’ বলে চিনানো আর প্রতি মুহূর্তে তাদের বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা- এই হিন্দুত্ববাদ অগ্রহণযোগ্য, ভারতের পক্ষেও যায় না।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক