আগামী বছর থেকে দৃশ্যমান হচ্ছে মেগা প্রকল্প

0

নূরে আলম জিকু॥ রাজধানীর যানজট নিরসেন নেয়া হয়েছে একাধিক মেগা প্রকল্প। তবে এসব প্রকল্প হাতে নেয়ার দীর্ঘদিনেও যানজট নিরসন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি। নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শুরু ও শেষ করতে না পারায় সুফল পায়নি নগরবাসী। উল্টো বেড়েছে জনদুর্ভোগ। গত কয়েক দশক ধরে যানজট ভোগান্তিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছেন সাধারণ মানুষ। তবে আসছে নতুন বছরে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে বলে মনে করছেন পরিবহন সংশ্লিষ্ট ও নগরবিদরা। তারা বলছেন, রাজধানীকে ঘিরে এই সরকারের বড় বড় প্রকল্পের কাজ শুরু করেছে। যা আগামী ডিসেম্বর থেকে নগরবাসী সুফল পাবে।
২০২২ সালে ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা বর্তমান সময়ের চেয়ে কিছুটা উন্নতি হবে। রাজধানীর মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে একটি মেট্রোরেল। এরই মধ্যে উত্তরা দিয়াবাড়ি এলাকা থেকে আগারগাঁও এলাকা পর্যন্ত কাজ শেষ হয়েছে। এই পথে পরীক্ষামূলকভাবে চলাচল করছে দেশের প্রথম মেট্রোরেল। পুরোদমে চলছে স্টেশনের কাজ। আগামী ১৬ই ডিসেম্বর এই অংশ জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হবে। এদিকে এগিয়ে চলছে মেট্রোরেলের বাকি অংশের কাজও। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ঢাকার গণপরিবহনে যুক্ত হবে স্বপ্নের মেট্রোরেল। এর ফলে উত্তরা থেকে মিরপুর হয়ে অল্প সময়ে মতিঝিল পৌঁচ্ছাতে পারবেন নগরবাসী। ২০ দশমিক ১০ কিলোমিটারের এই পথে ১৬টি স্টেশন থাকবে। ইতিমধ্যে পুরো প্রকল্পের ৭০ শতাংশের বেশি কাজ শেষ হয়েছে। ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন ছিদ্দিক গণমাধ্যমকে বলেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী মেট্রোরেলের সব লাইন বাস্তবায়িত হলে ঢাকার যানজট কমে যাবে। পরিবেশেও অসামান্য প্রভাব পড়বে। এদিকে চলতি বছরের ১লা ডিসেম্বর পরীক্ষামূলকভাবে চালু হচ্ছে বাস রুট রে?শনালাইজেশন। এদিন কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত চলবে ‘ঢাকা নগর পরিবহন’। প্রথম ধাপে ১২০টি বাস নিয়ে যাত্রা শুরু করবে এ প্রকল্পটি। এই রুটে ৪০টির বেশি যাত্রী ছাউনি ও এই রুটে ১৬টি বাস-বে নির্মাণ হবে। ৬ রংয়ের এই বাস চালাচলে টিকিট কেটে যাতায়াত করবেন যাত্রীরা। এতে যাত্রী হয়রানি ও যানজট নিরসন কমে আসবে বলে মনে করছেন পরিবহন সংশ্লিষ্টরা।
বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির সভাপতি ও ডিএসসিসির মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর একটি পাইলটিং রুট নির্ধারণ করেছি। এই রুটে নতুন নিয়ম এবং পদ্ধতিতে বাস চলবে। সবার প্রচেষ্টায় আমরা এত দূর আসতে পেরেছি। নগরে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে আগামী ১লা ডিসেম্বর এই রুটে বাস চলাচল শুরু হবে- এটা আমরা চূড়ান্ত করেছি। বাসগুলো জয়েন্ট ভেঞ্চারের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। পরে পুরো ঢাকায় কয়েকটি কোম্পানির মাধ্যমে বাস চলবে। ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর রুটে কোনো পুরাতন বাস চলবে না। এখানে নতুন বাস যোগ হবে। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের উপস্থিতিতে ঢাকা নগর পরিবহন চালু করা হবে। সে লক্ষ্যে আমরা যাবতীয় কার্যক্রম বিচার-বিশ্লেষণ করে নিয়েছি।
এদিকে রাজধানীর বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত সাড়ে ২০ কিলোমিটার নির্মাণ চলছে বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প। ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বিআরটি চালু হওয়ার কথা রয়েছে। সম্প্রতি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বিআরটি প্রকল্পটি পরিদর্শন করেছেন। সে সময়ে তিনি বলেন, কাজের ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২২ সালে চালু হবে এই প্রকল্পটি। এতে গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত যানজট থাকবে না। এই রুটে প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ২০ থেকে ২৫ হাজার যাত্রী যাতায়াত করতে পারবেন। এজন্য রাখা হয়েছে পৃথক পৃথক লেন। তবে প্রকল্পটি দেরিতে শুরু হওয়া ও নির্ধারিত সময়ের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি সময় অতিবাহিত হওয়া নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন অনেকে। পরিবহন ও নগরবিদরা বলছেন, গাজীপুর থেকে উত্তরার বিমানবন্দর পর্যন্ত বিআরটি প্রকল্পটির কোনো সুফল আসবে না। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, এই রুটটি বিআরটির জন্য উপযুক্ত নয়। এছাড়া বিমানবন্দরে দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি করবে। কোনো প্রকার পরীক্ষিত পরিকল্পনা ও সম্ভাব্যতা যাচাই-বাছাই ছাড়াই এই প্রকল্পটি নির্মাণ করা হয়েছে।
বিগত সময়ে যানজট নিরসনে নগরীতে মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার, মহাখালী ফ্লাইওভার, মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার, কুড়িল ফ্লাইওভার ও বনানী ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে। তবে কমেনি রাজধানীর যানজট। ফলে নতুন করে চালু হবে মেট্রোরেল, বিআরটি, বাস রুট রেশনালাইজেশন। অনেকেই মনে করছেন বিআরটি ও মেট্রোরেল চালু হলে এসব ফ্লাইওভারেও কমবে চাপ। এদিকে আরও দুটি ফ্লাইওভার নির্মাণের পরিকল্পনা করছে সরকার। এগুলোর সম্ভাব্যতা হিসেবে থাকবে আমিনবাজার থেকে পলাশী ও শান্তিনগর থেকে ঝিলমিল পর্যন্ত। এছাড়া আগামীতে আরও বাড়ছে মেট্রোরেলের নেটওয়ার্ক। মেট্রোরেল লাইন-৫ এর আওতার মাধ্যমে দুটি রুট নির্ধারণ করেছে সরকার। একটি উত্তর, অন্যটি দক্ষিণ রুট। উত্তর রুটের আওতায় ২০২৮ সালের মধ্যে উড়াল ও পাতাল রেলের সমন্বয়ে প্রায় ২০ কিলোমিটার লাইনের নির্মাণকাজ শেষ হবে। এই রুটে স্টেশন থাকবে ১৪টি, ৯টি পাতাল ও ৫টি উড়াল। এ রুটের শ্রেণিবিন্যাস হচ্ছে হেমায়েতপুর-বালিয়ারপুর, মধুমতি-আমিনবাজার, গাবতলী-দারুস সালাম-মিরপুর-১, মিরপুর-১০, ১৪-কচুক্ষেত-বনানী-গুলশান-২, নতুনবাজার-ভাটারা। লাইন-৫ এর সাউথ রুটের মাধ্যমে গাবতলী থেকে দাশেরকান্দি পর্যন্ত পাতাল রেল ও উড়াল রেলের সমন্বয়ে হবে ১৭ দশমিক ৪০ কিলোমিটার। থাকবে ১৬টি স্টেশন। এ অংশে ১২ দশমিক ৮০ কিলোমিটার পাতাল ও ৪ দশমিক ৬০ কিলোমিটার উড়াল রেল থাকবে। এ রুটের শ্রেণিবিন্যাস হচ্ছে গাবতলী-টেকনিক্যাল-কল্যাণপুর-শ্যামলী-কলেজগেট-আসাদগেট-রাসেল স্কয়ার-পান্থপথ-সোনারগাঁও মোড়-হাতিরঝিল-নিকেতন-রামপুরা-আফতাবনগর-পশ্চিম আফতাবনগর, সেন্টার আফতাবনগর পূর্ব-দাশেরকান্দি। মেট্রোরেল রুট-১ এর আওতায় প্রায় ৩১ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রোরেল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ রুটে থাকছে দুটি অংশ। প্রথম অংশ বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর রেলস্টেশন। দ্বিতীয় অংশ নতুনবাজার থেকে পূর্বাচল ডিপো পর্যন্ত। এছাড়া এমআরটি লাইন-২ এর আওতায় ২০৩০ সালের মধ্যে গাবতলী থেকে চট্টগ্রাম রোড পর্যন্ত আন্ডারগ্রাউন্ড ও এলিভেটেড সমন্বয়ে প্রায় ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রোরেল নির্মিত হবে। এমআরটি লাইন-৪ এ ২০৩০ সালের মধ্যে কমলাপুর-নারায়ণগঞ্জ রেলওয়ে ট্র্যাকের নিচ দিয়ে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ পাতাল মেট্রোরেল নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. এসএম সালেহ উদ্দিন মানবজমিনকে বলেন, সরকারের নানা মেগা প্রকল্প আগামী বছর চালু হচ্ছে। একসঙ্গে মেট্রোরেল, বিআরটি ও বাস রুট রেশনালাইজেশন চালু হলে যানজট কমে আসবে। রাজধানীর নাগরিকরা সুবিধা পাবেন। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলেও আমাদেরকে কয়েকটি বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ একটি নির্দিষ্টসংখ্যক জনসংখ্যার যাতায়াত হিসাব করে এসব গণপরিহন ও রুট চালু হবে। মানুষ দিন দিন শহরমুখী হচ্ছেন। ঢাকায় মানুষের চাপ আরও বাড়তে থাকলে তেমন সুফল মিলবে না। তবে আমাদেরকে মেট্রোরেল, বিআরটি ও বাস রেশনালাইজেশন টিকিয়ে রাখতে হবে। এজন্য সরকারকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়া ঢাকার যানজটকে নিরসনে ঢাকার পার্শ্ববর্তী স্থানকে ব্যবহার করতে হবে। এজন্য গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জসহ কয়েকটি জেলায় শিল্প কারখানায় নজর দিতে হবে। শুধু ঢাকাকে কেন্দ্র করে সবকিছু করলে যানজট নিরসন হবে না।