যশোর শিক্ষা বোর্ডে জালিয়াতি : যাদের নামে চেক তারা দায়ী করলেন চেয়ারম্যানসহ কর্মকর্তা কর্মচারীদের

0

স্টাফ রিপোর্টার॥ যশোর উচ্চ মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডে আড়াই কোটি টাকা যে দুইটি প্রতিষ্ঠানের নামে লোপাট করা হয়েছে তাদের মালিকরা এ জালিয়াতির জন্য দায়ী করেছেন বোর্ডের চেয়ারম্যানসহ চার কর্মকর্তা-কর্মচারীকে। চেক জালিয়াতির এ ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পর খোঁজ নেই আব্দুস সালাম নামে এক কর্মচারীর। এদিকে এ ঘটনায় আজ মামলা করবেন বলে গতকাল জানিয়েছেন শিক্ষা বোর্ডের সচিব। ৯টি চেকে ১০ হাজার ৩৬ টাকার বিপরীতে ২ কোটি ৫০ লাখ ৪৪ হাজার ১০ টাকা আত্মসাতের এ ঘটনা ঘটেছে দুইটি প্রতিষ্ঠানকে দেয়া চেকের মাধ্যমে। এ দুই প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ভেনাস প্রিন্টিং এণ্ড প্যাকেজিং ও শাহী লাল স্টোর। ভেনাস প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিংয়ের মালিক যশোর শহরতলীর রাজারহাটের বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম বাবু ও শহরতলীর শেখহাটি হাইকোর্ট মোড় এলাকার শাহী লাল স্টোরের মালিক যশোর উপশহর ই-ব্লক এলাকার বাসিন্দা আশরাফুল। ভেনাস প্রিন্টিংয়ের মালিক শরিফুল ইসলাম বাবু গতকাল সময় টেলিভিশনে এ ঘটনা সম্পর্কে বলেন, চেয়ারম্যান মোল্লা আমীর হোসেন, উপ-সহকারী প্রকৌশলী কামাল হোসেনসহ ৪ জন জড়িত। তিনি জানান, ভুয়া প্যাড, সিল ব্যবহার করে প্রকৌশলী কামাল হোসেন ও চেয়ারম্যান এ কাজের সাথে সরাসরি জড়িত। টাকা সব তাদের কাছে। আমার কাছ থেকে ফিরতি চেকে তারা এই টাকা নিয়ে গেছেন। শরিফুল ইসলাম বাবুর দাবি অনুযায়ী এ ঘটনায় জড়িত আরও দুই জন হচ্ছেন প্রশাসন শাখার ভারপ্রাপ্ত সেকশন অফিসার রাকিব হাসান ও হিসাব সহকারী আবদুস সালাম।
অপরদিকে শাহী লাল স্টোরের মালিক আশরাফুল লোকসমাজকে বলেছেন, হিসাব সহকারী আব্দুস সালামের কথা। তিনি বলেন, সালাম তার দোকান থেকে ফটোকপি করাতো। একদিন সে এসে তার ইসলামী ব্যাংক যশোর শাখার অ্যাকাউন্ট নাম্বার নেয়। এরপর সে প্রথম মোবাইল ফোনে এসএমএসের মাধ্যমে দেখতে পায় তার অ্যাকাউন্টে ৩৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা জমা হয়েছে। এসময় তিনি সালামের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে সালাম বলে এ টাকা অন্যান্য কাজের বিলের। আশরাফুল আরও জানায় দ্বিতীয় দফায় তার অ্যাকাউন্টে জমা হয় ২৫ লাখ ৪২ হাজার টাকা। প্রতিবার টাকা জমা হওয়ার পর সালাম তার কাছ থেকে চেক নিয়ে ওই টাকা উঠিয়ে নিতো। তবে তিনি সালামের দেয়া প্রতি চেকের মুড়ি অংশে তার স্বাক্ষর নিয়ে রেখেছেন। যাতে বোঝা যায় চেক দুইটি সালামকে দেয়া হয়েছে।
গতকাল দৈনিক লোকসমাজসহ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে যশোর শিক্ষা বোর্ডের মাত্র ১০ হাজার ৩৬ টাকার বিপরীতে ৯টি চেকে জালিয়াতির মাধ্যমে ২ কোটি ৫০ লাখ ৪৪ হাজার ১০ টাকা উঠিয়ে নেওয়া হয়। ভেনাস প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিং এবং শাহী লাল স্টোর নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এই চেক উত্ত্ােলন করা হয়েছে বলে বোর্ড কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। এদিকে এই ঘটনায় গতকাল পর্যন্ত কোনো মামলা না হলেও আজ শনিবার মামলা করা হবে বলে শিক্ষা বোর্ড সচিব প্রফেসর এএমএইচ আলী আর রেজা লোকসমাজকে জানান। কারা বিবাদি হবে বা যার যার স্বাক্ষরে এই চেক প্রস্তুত ও ইস্যু হয় তাদের বিরুদ্ধে মামলা হবে কি না জানতে চাওয়া হয়েছিল। এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কাল যেহেতু মামলা করা হবে, কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ করে ও আইনজীবীর সাথে পরামর্শে এটি ঠিক করা হবে। তিনি বলেন, শনিবার বোর্ডে গেলে এর উত্তর মিলতে পারে। ‘আপনার স্বাক্ষরও তো রয়েছে’ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেখা যাক, চেকেতো ‘আমার স্বাক্ষর রয়েছে’।
এদিকে বোর্ডের একাধিক সূত্র মতে, কোনো পাওনাদার বা প্রতিষ্ঠানকে বিলের চেক দিতে হলে প্রথমে পাওনাদার বা ঠিকাদার বা কোনো প্রতিষ্ঠানের দেওয়া বিলটি ডিলিং অফিসার নোটসহ সেটি প্রস্তুত করে সেকশন অফিসারকে দেন, সেকশন অফিসার প্রস্তুতকৃত বিলটি পরীক্ষা করে সহকারী হিসাব অফিসারের টেবিলে পাঠান, তিনি সেটি দেখে নোট সাপেক্ষে হিসাব আফিসারের টেবিলে পাঠান। সব বিষয় মিলিয়ে তিনি সেটি স্বাক্ষর করে অনুমোদনের জন্যে বোর্ড সচিবের কাছে পাঠান। সেখানে স্বাক্ষরসহ অনুমোদিত হলে ফাইলটি যায় বোর্ড চেয়ারম্যানের কাছে। এতক্ষণে অনুমোদিত হয় এর পর চেক ইস্যুর প্রশ্ন। বিল যেভাবে যে যে টেবিল ঘুরে সর্বশেষ অনুমোদন পেয়েছে সেই প্রক্রিয়াই নোটসহ প্রিন্টেড চেক তৈরি হয়ে সর্ব শেষে চেয়ারম্যানের কাছে যায়। বোর্ড কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকের দাবি একটি বিল মোট দুই দফায় ১০ হাত ঘোরে। ফলে সেখানে কোটি কোটি টাকা জালিয়াতি সম্ভব নয়। কেমন করে ঘটলো? এর উত্তরে কর্মকর্তাদের দাবি, প্রতিদিন শিক্ষা বোর্ডে অসংখ্য বিষয়ে চেক দিতে হয় এবং বিভিন্ন খাত থেকে টাকা নিতে হয়। এ সব লেনদেনের চেক স্বাক্ষর করানোর সময় মূল চেকটি না দিয়ে তৈরিকৃত চেক ঢুকিয়ে স্বাক্ষর করানো হতে পারে।
শিক্ষা বোর্ডের অডিট অফিসার মো. আব্দুস সালাম আজাদ জানান, বছর শেষে প্রতিটি বিল অডিট করতে হয়। চেকের মাধ্যমে কোনো টাকা দেওয়া হলে তার সংশ্লিষ্ট নোট, ফাইল ও চেকের মুড়ি বই পরীক্ষা করতে হয়। গত কয়েকদিন আগে এ জাতীয় কাজ করার সময় আলোচিত ৯টি চেকের বিষয় নজরে আসে। চেকের মুড়ি ও উত্তোলিত টাকার পরিমাণে গড়মিল ধরা পড়লে প্রথমে তিনি ব্যাংক থেকে বিষয়টি জানার চেষ্টা করেন। সেখানে তার সন্দেহ বেড়ে গেলে তার ঊর্ধ্বতন অফিসার উপপরিচালক (হিসাব ও নিরীক্ষা) মো. এমদাদুল হকের পরামর্শে গোপনে বিষয়টি নিয়ে কাজ করেন। তিনি রেজিস্ট্রার নিরীক্ষা করে দেখেন প্রতিষ্ঠান দুটি ওই টাকার বিপরীতে বোর্ড স্টোরে কোনো মালামাল সরবরাহ করেনি এবং বিল ভাউচারও দাখিল করেনি। এরপর তিনি পুরো প্রক্রিয়াটি আবার নীরিক্ষা করেন। পরে গত বৃহস্পতিবার কাজ শেষে ফাইল ও প্রমাণ সাপেক্ষে রিপোর্ট প্রস্তুত করে সচিব ও চেয়ারম্যানের কাছে জমা দেন। এরপর সেটি জানাজানি হয়। এ প্রসঙ্গে তিনি দেখতে পান, চেকের মুড়ি বই (সেখানে দেয় টাকার অঙ্কও লেখা থাকে) সাপেক্ষে যে চেক ইস্যু হয়েছে, ব্যাংকে জমা দেওয়া হয়েছে ভিন্ন অক্কের টাকার চেক। এটি কীভাবে সম্ভব অবশ্য তার পুরো ব্যাখ্যা তিনি দিতে পারেননি। তবে বোর্ডের একাধিক সূত্র মতে, যে ছাপাখানা থেকে শিক্ষা বোর্ডের সব কাজ হয় সেখান থেকে অনুরূপ নকল চেক ছাপা হতে পারে। এর সাথে ঠিকাদার ও কর্মচারীরা কেউ কেউ জড়িত রয়েছেন বলেও দাবি করা হয়। বোর্ডের অডিট অফিসারের দাখিলকৃত লিখিত তথ্যের ভিত্তিতে জানান যায়, এই আড়াই কোটি টাকার জন্যে উল্লেখিত প্রতিষ্ঠান দুটি ওই টাকার বিপরীতে বোর্ড স্টোরে কোনো মালামাল সরবরাহ করেনি এবং বিলভাউচারও দাখিল করেনি। ব্যাংকিং ব্যবসার উন্নতির ফলে এখন মোবাইল ফোনের এসএমএসের মাধ্যমে গ্রাহক জানতে পারেন কত টাকা জমা বা উত্তোলিত হলো। শিক্ষা বোর্ডের একাউন্টে কোনো টাকা জমা ও উত্তোলিত হলে কোন মোবাইল ফোনে এমন এসএমএম যায় জানতে চাইলে বোর্ড সচিব প্রফেসর এএমএইচ আলী আর রেজা জানান, তার জানা মতে কোনো এসএমএস তারা পাননা। অডিট অফিসার জানতে পারেন কিনা এমন সংশয়ে অডিট অফিসারকে ফোন দিলে তিনি জানান, অ্যাকাউন্ট যে নামে তার মোবাইলে মেসেজ যেতে পারে। তবে তার জানান মতে বোর্ডের কোনো একাউন্টে টাকা লেন দেনের তথ্য মোবাইল ফোনে মেসেজ আকারে যায় না। এ বিষয়ে সোনালী ব্যাংক শিক্ষা বোর্ড শাখার ম্যানেজার এস এম সাইদুর রেজার কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, বোর্ডের একাউন্টটি এসটিডি, এখানে লেন দেনও অসংখ্য তাই কোনো মেসেজ পাঠানো হয় না। সচিব বরাবর হিসাব ও নিরীক্ষা বিভাগের তৈরিকৃত ৯টি চেকের জালিয়াতির যে বিবরণ দেওয়া হয়েছে সেখানে শাহী লাল স্ট্ােরের নামে ২টি চেকে ৬১ লাখ ৩২ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। অবশিষ্ট ১ কোটি ৮৯ লাখ ১২ হাজার ১০ টাকা ভেনাস প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিং এর নামে ৭টি চেকে জালিয়াতির মাধ্যমে উত্তোলিত হয়েছে। প্রসঙ্গত, চেক ৯টি বোর্ডের ১০ হাজার ৩৬ টাকা আয়কর ও ভ্যাট পরিশোধের জন্যে প্রস্তুত করা হয়েছিল। সেই চেকের পরিবর্তে জালিয়াতি করে তৈরি করা ৯টি চেক ব্যবহার করে বিশাল অংকের টাকা লোপাট করা হয়েছে।