আমাদের কন্যা শিশুরা ভালো নেই

0

উদিসা ইসলাম
বগুড়ার শেরপুরের সপ্তম শ্রেণির এক কিশোরী। গ্রামের এক যুবকের সঙ্গে তার ‘প্রেমের সম্পর্ক’ হয়। এক সময় মেয়েটির কয়েকটি ব্যক্তিগত ছবি ছেলেটির হাতে পৌঁছায়। শুরু হয় হয়রানি। ছবি ফাঁস করে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে যৌন হয়রানি ও নির্যাতন চালাতে থাকে ওই যুবক। কিছুদিন পর ছবিগুলো এক বন্ধুকে দিয়ে দেয় সে। সেই বন্ধুও যোগ দেয় হয়রানিতে। দিশেহারা মেয়েটি এক পর্যায়ে বাবা-মাকে ঘটনাটি জানায়। হয়রানি থেকে বাঁচতে ঢাকায় আশ্রয় নেয় পরিবারটি। মেয়েটির বাবা এখন দিনমজুর। কিশোরীও হারাতে বসেছে তার দুরন্ত শৈশব; একরকম গৃহবন্দি দিন কাটছে তার। এটা দেশের প্রত্যন্ত এলাকার একটি খণ্ডচিত্র। খোদ রাজধানীতেও কন্যাশিশুরা নিরাপদে নেই। একদিকে হয়রানি, আরেকদিকে আছে বিচার না পাওয়ার অপমান। বিশ্লেষকরা বলছেন, অভিযোগ করার প্রক্রিয়া সহজ করা গেলে বিচারের দাবি নিয়ে অনেকে সামনে আসতো।
এ পরিস্থিতিতে ‘প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ হবো, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়বো’ স্লোগানে আজ ৩০ সেপ্টেম্বর পালিত হচ্ছে জাতীয় কন্যাশিশু দিবস। যারা সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করছেন তারা বলছেন যদি সাইবার জগৎ নিরাপদ না করা যায়, তা হলে ডিজিটাল প্লাটফর্ম ব্যবহার কমার শঙ্কা দেখা দেবে। সাইবার ক্রাইম বিশ্লেষক তানভীর জোহা বলেন, ‘প্রতিদিন আমার কাছে ১০ থেকে ১৫টি অভিযোগ আসে। খেয়াল করা জরুরি, আমি কাজ করি এটা যারা জানেন তারাই কেবল আমাকে জানান। প্রকৃত অর্থে এর পরিমাণ আরও বেশি। যদি এই সাইবার জগৎ নিরাপদ না করা যায় তবে ডিজিটাল প্লাটফর্ম ব্যবহার কমার আশঙ্কা দেখা দেবে। কেন নিরাপদ করা সম্ভব হচ্ছে না প্রশ্নে তিনি বলেন, দুটো কারণে এটা এখনও হয়ে ওঠেনি। প্রথমত, অভিযোগের প্রক্রিয়াটাকে ভয় পাওয়া। যেকোনও অভিযোগ আমলে নেওয়ার আগে থানায় সাধারণ ডায়েরি করতে বলা হয়, অভিভাবককে সঙ্গে আনতে বলা হয়। পারিবারিক জটিলতা এড়াতে তখন আর অভিযোগ করতে আগ্রহী হয় না কিশোরীরা। দ্বিতীয়ত, যে অভিযোগ দায়ের হয় সেগুলোরও বিচার নিশ্চিত হওয়ার পরিমাণ কম।
বিশ্লেষকরা বলছেন, তথ্য-প্রযুক্তির সহজলভ্যতার কারণে দেশের বিভিন্ন বয়স ও শ্রেণির মানুষের মধ্যে ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের ব্যবহার বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সাইবার অপরাধও। সাধারণত ফেসবুকে এই অপরাধের প্রবণতা বেশি। করোনাকালে সব শ্রেণির মধ্যে অনলাইনের ব্যবহার বেড়ে যাওয়াতেও হয়রানি বেড়েছে। অলনাইনে যৌন হয়রানি নিয়ে সম্প্রতি এক গবেষণা-জরিপ প্রকাশ করে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। এতে বলা হয়, করোনাকালে দেশে ৩০ শতাংশ শিশু অনলাইনে নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। নিপীড়নের শিকার হওয়া শিশুদের ৫২ দশমিক ২৫ শতাংশ মেয়ে শিশু। ৪৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ ছেলে শিশু। করোনাকালে অনলাইনে শিশু নির্যাতন বিষয়ক এই জরিপে অনলাইনে শিশু নিপীড়নের যে ধরন বের হয়ে আসে সেগুলো হলো—শিশুদের ব্যক্তিগত ও সংবেদনশীল তথ্য ইন্টারনেটে প্রকাশ, যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন, অশালীন প্রস্তাব, সাইবার বুলিং, ব্ল্যাকমেইলিং, পর্নোগ্রাফি এবং যৌনতা বিষয়ক ছবি ও তথ্য দেখতে পাওয়া। ডিজিটাল প্লাটফর্ম আমাদের কন্যাদের জন্য কতটা নিরাপদ হয়েছে জানতে চাইলে সিটিটিসির সিটি সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের সিনিয়র সহকারী উপ-পুলিশ কমিশনার (এসি) ধ্রুব জ্যোতির্ময় গোপ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সবকিছুর ভালো-মন্দ আছে। কোনটা আপনি গ্রহণ করবেন সেটা বিবেচনার বিষয়।’ অভিযোগ করার বিষয়ে থানায় যেতে অনীহার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরাও দেখেছি ভুক্তভোগীরা আইনি ব্যবস্থা নিতে চান না। কিন্তু সমাধান চান। কেন থানায় যাওয়ার সময় অভিভাবক জরুরি সেই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অভিভাবক বাধ্যতামূলক নয়। কিন্তু বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতায় অপ্রাপ্তবয়স্ক বা যেকোনও বয়সীদের ক্ষেত্রেই পরিবারকে জানানো জরুরি।’