চাল আমদানিতে ধীরগতি

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ শুল্ক কমিয়ে বেসরকারিভাবে আমদানির উদ্যোগ নেওয়ার পর চালের দাম কিছুটা কমে স্থিতিশীল হয়েছে। এ অবস্থায় চাল আমদানিতে ধীরগতি নেমেছে। এ নিয়ে ব্যবসায়ীরা বলছেন, নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার কারণে তারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে চাল আনতে পারছেন না। আবার চাল আনতে কেজিপ্রতি যে খরচ হচ্ছে, বাজারে বিক্রি করতে হচ্ছে তার চেয়েও কম দামে। এসব কারণেই চাল আমদানিতে ধীরগতি নেমেছে বলে দাবি তাদের। এবার মোট ৪১৫ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ১৬ লাখ ৯৩ হাজার টন সেদ্ধ ও আতপ চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছে সরকার। এর মাঝে বৃহস্পতিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত মাত্র ২ লাখ টনের মতো চাল এনেছেন আমদানিকারকরা। যদিও চাল আমদানির প্রক্রিয়া শেষ হবে ৩০ অক্টোবর।
আমদানিকারকরা জানিয়েছেন, সরকারের বেঁধে দেওয়া শর্ত অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ভারত থেকে চাল আনতে খরচ বেশি পড়ছে। বন্দরে দীর্ঘ জট থাকায় বেঁধে দেওয়া সময়ে রপ্তানিকারকরা চাল দিতে চাইছেন না। দেশের বাজারেও চালের দাম কিছুটা কমেছে। চাল এনে ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বরাদ্দ পাওয়া আমদানিকারকদের চাল আনতে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে। যাদের প্রয়োজন হচ্ছে এলসি খোলার সময় বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমদানির চাল যাতে নির্বিঘ্নে আসতে পারে সেজন্য অন্যান্য দপ্তরের সঙ্গেও কথা বলা হচ্ছে। দেশে অনেক দিন ধরেই অস্থিতিশীল ছিল চালের বাজার। এর ধারাবাহিকতায় এবার ভরা বোরো মৌসুমেও চালের বাজার ছিল ঊর্ধ্বমুখী। মোটা চালের কেজিপ্রতি দাম ৫০ টাকার কাছাকাছি চলে যায়। চিকন চালের কেজি দাঁড়ায় ৬০ থেকে ৭০ টাকায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে চালের বাজারের লাগাম টানতে শুল্ক কমিয়ে চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। তাই চাল আমদানি শুল্ককর কমানোর অনুরোধ জানিয়ে গত ৬ জুলাই এনবিআরকে চিঠি দেয় খাদ্য মন্ত্রণালয়। এরপর গত ১২ আগস্ট চাল আমদানির শুল্ক কমিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। চালের আমদানি শুল্ক ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করে এনবিআর। এরপর কমানো শুল্ক হারে চাল আমদানির জন্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে আগামী ২৫ আগস্ট পর্যন্ত খাদ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদনের সময় বেঁধে দেওয়া হয়। ১৭ আগস্ট থেকেই চাল আমদানির জন্য অনুমতি দিতে শুরু করে খাদ্য মন্ত্রণালয়।
গত ১৭ আগস্ট ৪১ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে চার লাখ ১০ হাজার টন, ১৮ আগস্ট ৬৯ প্রতিষ্ঠানকে চার লাখ ১৮ হাজার টন, ২১ আগস্ট ৯১ প্রতিষ্ঠানকে তিন লাখ ৯১ হাজার টন, ২২ আগস্ট ৭৩ প্রতিষ্ঠানকে দুই লাখ ২২ হাজার টন, ২৩ আগস্ট ৪১ প্রতিষ্ঠানকে ৯৪ হাজার টন, ২৪ আগস্ট ৩৪ প্রতিষ্ঠানকে ৫৭ হাজার টন ও ৩০ আগস্ট ৭৯ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে ১ লাখ ১ হাজার টন সেদ্ধ ও আতপ চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। বরাদ্দ আদেশ জারির ১৫ দিনের মধ্যে এলসি (লেটার অব ক্রেডিট-ঋণপত্র) খুলতে হবে এবং এলসি খুলতে ব্যর্থ হলে বরাদ্দ বাতিল হয়ে যাবে বলেও ওই সময় আমদানিকারকদের শর্ত করে সরকার। বরাদ্দ পাওয়া আমদানিকারকদের চাল বাংলাদেশে আনার সময়ও বেঁধে দেয়া হয়। যদিও এরপর থেকেই এলসি খোলার সময় বাড়িয়ে যাচ্ছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। এরপর চাল আমদানি শুরু হলে দেশের বাজারে দাম কিছুটা কমে আসে।
সরকারি বাণিজ্য সংস্থা- ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) দেওয়া ৩০ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগরীর খুচরা বাজারদর অনুযায়ী, সরু চালের কেজিপ্রতি দাম ৫৬ থেকে ৬৮ টাকা। এক মাস আগে এই দাম ছিল ৬০ থেকে ৬৮ টাকা। এক মাসের ব্যবধানে দাম কমেছে ৩ দশমিক ১৩ শতাংশ। মাঝারি মানের চাল বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৬ টাকা, এক্ষেত্রে দাম কমেনি। মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৪৮ টাকায়। এক মাস আগে যা ছিল ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। এক্ষেত্রে দাম কমেছে ২ দশমিক ১১ শতাংশ। চাল আমদানির ধীরগতি নিয়ে যশোর নওয়াপাড়া ভাংগাগেটের মজুমদার অ্যাগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের স্বপন কুণ্ডু বলেন, ‘বরাদ্দ পাওয়া অংশের কিছু চাল আনা গেছে। বাকিটা আনা যাবে কি না জানি না। চাল আনার খরচ অনেক, অনেক ঘুস-টুস লাগে। চাল এনে লাভ হচ্ছে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখন যে স্বর্ণা চাল আনতে খরচ হয় ৪২-৪৩ টাকা, সেটা বিক্রি করতে হয় ৪০ টাকায়। সামনে আর কেউ চাল আনবে বলে মনে হয় না। কেউ লোকসান দিয়ে তো চাল আনবে না।’ যশোরের এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘সরকারের উচিত চাল আমদানি কিছুদিন খুলে রাখা। বলে দেওয়া যেতে পারে, যে যা পারো, চাল আনো। তখন হয়তো বাজারে একটা প্রভাব পড়বে। সরকার যখন দেখবে প্রয়োজনীয় চাল চলে এসেছে, তখন বন্ধ করে দিতে পারবে। এবার এখনও কেউ সেভাবে চাল আনতে পারেনি।’ চাল আমদানির সময় শেষ হলে আবার দাম বেড়ে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন এ ব্যবসায়ী।
চাল আমদানিকারক বগুড়া শেরপুরের মেসার্স আলাল এন্টারপ্রাইজের ফিরোজ আহমেদ বলেন, ‘ভারতের ওপাশে প্রচুর জ্যাম, ভারতের কোনো রপ্তানিকারক আমাদের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে চাল দিতে চাচ্ছে না। চালের ট্রাক ২০-২৫ দিন করে লাইনে থাকতে হচ্ছে। এলসি করার ১৫ দিনের মধ্যে অর্ধেক চাল আনার শর্ত দিয়েছে সরকার। আমরা এলসি করে রেখেছি, কিন্তু ভারতের রপ্তানিকারকরা রাজি হচ্ছেন না।’ তিনি বলেন, ‘এছাড়া বড় আমদানিকারকরা আগেই রেল ও জাহাজ বুকিং দিয়ে রেখেছেন। সেখানে আমাদের মতো ছোট আমদানিকারকদের সুযোগ নেই। জাহাজ ও রেলে চাল আনলে খরচ কম পড়ে। সড়কপথে চাল আনার খরচ বেশি।’ সড়কপথে চাল আমদানি করে ব্যবসায়ীদের ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে দাবি করে ফিরোজ আহমেদ বলেন, ‘ক্ষতি হলেও যেগুলোর এলসি খোলা হয়েছে, সেই চালগুলো আমরা আনছি। এ চালগুলো লস দিয়ে বিক্রি করছি। যে চাল আমরা ৩৯ টাকা করে বিক্রি করছি তা আনতে খরচ হয়েছে ৪২-৪৩ টাকার মতো।’
এ বিষয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম বলেন, ‘আমরা বেসরকারিভাবে ১৬ লাখ ৯৩ হাজার টন চাল আমদানির জন্য বরাদ্দ দিয়েছিলাম। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত ২ লাখ টনের বেশি এসেছে। এখনও আমাদের অক্টোবর মাস পুরো রয়েছে। অক্টোবরের মধ্যে আরও চাল চলে আসবে। এছাড়া নভেম্বরে আবার আমন উঠবে।’ তিনি বলেন, ‘এখন চাল আমদানির গতি একটু ধীর হওয়ার কারণ হচ্ছে- চালের বাজার এখন স্থিতিশীল। সামনে আমন আসবে। ব্যবসায়ীরা স্বাভাবিকভাবেই তাদের লাভ দেখবেন। এছাড়া যারা সময় চাইছে আমরা তাদের সময় বাড়িয়ে (এলসি খোলার সময়) দিচ্ছি। আমরা চাই তারা চাল আনুন। যারা সৎ আমদানিকারক, তাদের উদ্বুদ্ধ করছি চাল আনার জন্য।’ ‘যেহেতু এলসি খোলা হয়েছে, ব্যবসায়ীরা ফি দিয়ে আইপি (আমদানি অনুমতি) নিয়েছেন। ১১ লাখ ৯৭ হাজার টন চাল আনার জন্য আইপি ইস্যু হয়েছে। আইপি যেহেতু হয়েছে আমার বিশ্বাস চাল আসবে।’ ভারত থেকে চাল আনতে সীমান্তে কিছু সমস্যা রয়েছে জানিয়ে খাদ্য সচিব বলেন, ‘পণ্যজট থাকায় সীমান্তে চালের ট্রাকগুলোকে অপেক্ষা করতে হয়, এতে খরচ বেড়ে যায়। এজন্য হয়তো ধীরে চাল আসছে। আমরা সব কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি, যাতে চাল নির্বিঘ্নে ঢুকতে পারে।’ সরকারি খাদ্যশস্যের মজুত সাড়ে ১৬ লাখ টন জানিয়ে সচিব বলেন, ‘সরকারি মজুতও এখন ভালো অবস্থায় আছে। আমরা নিজেরাও (সরকারিভাবে) চাল আনছি। সেটা অব্যাহত আছে। সরকারিভাবে আরও ৫ লাখ টন চাল আনার চুক্তি হয়ে গেছে। এর মধ্যে এক লাখ টন দেশে চলে এসেছে, জাহাজে ভাসমান অবস্থায় রয়েছে। এছাড়া আরও চাল আনতে টেন্ডার প্রক্রিয়া চলমান।’ আমন সংগ্রহের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিকল্পনা আছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘উৎপাদন পরিস্থিতি দেখে আমরা সংগ্রহের বিষয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করবো। আশা করছি আমন সংগ্রহের আগে মধুপুর, ময়মনসিংহ ও আশুগঞ্জে তিনটি সাইলো হয়ে যাবে। সেখানে আমরা ২ লাখ টনের বেশি মজুত করতে পারবো।’